তিনি ছিলেন আদর্শিক জীবনের মাইলফলক
ব্যক্তি পরিচয় অতিক্রম করে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিস্তৃত আবহে নিজেকে মেলে ধরে আদর্শিক জীবনের মাইলফলক হয়ে উঠা
ইসলামী সমাজে ওলামায়ে কেরামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব তাদেরই ওপর ন্যস্ত। কারণ, হুজুরে পাক (স.)-এর পর আর কোনো নবী-রাসূল এই ধরাপৃষ্ঠে আগমন করবেন না। আল্লাহপাক ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমেই জগতের মানুষকে হেদায়েতের সহজ-সরল পথ প্রদর্শন করবেন। অর্থাৎ নবী-রাসূলদের কাজগুলো ওলামায়ে কেরামগণই পরিচালনা করবেন। তাই আলিমদের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (স.) বলেন: আলিম সম্প্রদায় নবীগণের উত্তরাধিকারী। (মুসলিম) তিনি অন্যত্র বলেছেন: আমার উম্মতের আলিমগণ বনি-ইসরাইলের নবীদের সমতুল্য।
উপরোক্ত হাদিসদ্বয়ে হুজুরে পাক (স.) একজন আলিমের মর্যাদা যে কত সুউচ্চ তাই বর্ণনা করেছেন।
স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই যে, তাদের মাধ্যমেই মানবগোষ্ঠী জানতে পেরেছে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় প্রভৃতির সঠিক জ্ঞান। তারাই দিয়েছে সেই শিক্ষা, যার কারণে আমরা আজ পৃথিবীর বুকে সুসভ্য জাতি, মুসলমান। কাজেই নবী-রাসূলগণের পর ওলামায়ে-কেরামের মর্যাদা সকল শ্রেণীর নেতাদের ঊর্ধ্বে।
এখন আসুন লক্ষ করা যাক যে, আলিমদের মর্যাদা এত ঊর্ধ্বে তারা কারা? তাদের পরিচয় কী? আল্লাহপাক তাদের পরিচয় তুলে ধরে ঘোষণা করছেন: আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তারাই আল্লাহকে ভয় করে, যারা আলিম। (সূরা ফাতির-২৮) অর্থাৎ আল্লাহপাককে যে ভয় করে সেই তো অন্যায়-অবিচার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আর যিনি অন্যায়-অবিচার থেকে বেঁচে থাকতে সমর্থ হন, তিনি মুত্তাকীর দলভুক্ত হয়ে যান। মুত্তাকীরা বেহেশতের অধিকারী। আল্লাহপাক তাদের বেহেশতের সুসংবাদ দিয়ে বলেন: এবং যারা তাদের পরওয়ারদিগারকে ভয় করে, তাদের দলে দলে বেহেশতের দিকে পরিচালনা করা হবে। (সূরা যুমার-৭৩)
ওলামায়ে কেরামগণ নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারী এর অর্থ এই নয় যে, নবী-রাসূলগণ এই পৃথিবীতে অজস্র ধনদৌলত রেখে যান, যার মালিক হন ওলামায়ে কেরাম। বস্তুত নবী-রাসূলগণ কোনো পার্থিব ধনদৌলত রেখে যান না। তারা রেখে যান আদর্শ। তাদের শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার ও প্রচারের দায়িত্ব পালন করবেন উলামায়ে কেরাম। যে কাজের দাওয়াত রাসূল (স.) দিয়ে গেছেন। নবীর অবর্তমানে সে কাজগুলোই সঠিকভাবে করে যাবেন উলামায়ে কেরামগণ। আর এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন বলেই ওলামায়ে কেরামের মর্যাদা এত বেশি।
হুজুরে পাক (স.) বলেন: যখন কেউ আমার আলিম উম্মতের সাথে শত্রুতা করবে, বাজারে আকাশচুম্বী দালান তৈরি করবে এবং অর্থ-সম্পদের ভিত্তিতে বিয়ে করবে, তখন আল্লাহপাক তাদের প্রতি চার প্রকার আযাব নাজিল করবেন। (১) অভাব-অনটন ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে, (২) শাসকদের পক্ষ থেকে জুলুম-অত্যাচার হবে, (৩) ক্ষমতাবান আমলা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকবে, (৪) তাদের প্রতি বার বার শত্রুর পক্ষ থেকে আক্রমণ হতে থাকবে।
হাদিস এবং আল্লাহপাকের কালাম দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, ওলামায়ে-কেরামের মর্যাদা সাধারণ লোকদের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। আল্লাহপাক বিশ্বাসী ও জ্ঞানী ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন: তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী এবং যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত, তাদের আল্লাহপাক উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করবেন। (সূরা মুজাদালাহ-১১)
এর দ্বারা পরিষ্কার বোঝা গেল যে, একজন আলিমের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। আর এ জন্যই একজন আলিমকে নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে। আলিম সমাজই মানুষকে সঠিক পথ দেখাবে, নেতৃত্ব দেবে, মানুষ যাতে ভুল পথে চলতে না পারে তার জন্য সদা-সর্বদা সতর্ক থাকবে এবং মানবকুল আলিম সমাজের অনুকরণ-অনুসরণ করবে। কিন্তু বড়ই আফসোস যে, অধিকাংশ আলিম বর্তমানে আর নেতৃত্ব দিতে পারছে না। স্বার্থপরতা, হীনমন্যতায় এত বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়েছে যে, তা থেকে বের হয়ে আসার রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ আছে খানকা নিয়ে, কেউ আছে বিশেষ শ্রেণি সৃষ্টি করে তাদের নিয়ে। এসব করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের পাহাড় সৃষ্টি করে চলেছে। সামান্য বিষয়ের ওপর বিবৃতি-অভিমত প্রকাশ করে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করে চলেছে যেন তার মত ও পথ গ্রহণ না করলে কেউ বেহেশতেই যেতে পারবে না। ফলে যারা আমাদের পথ দেখাবে তাদের কথায়ই যখন মিল নেই, তখন মানুষ তাদের কথা কেন শুনতে যাবে? কাজেই যার যেমন খুশি চলছে। আলিম সমাজের ভুল নেতৃত্বের কারণে যদি মানুষ জাহান্নামমুখী হয়ে পড়ে তাহলে তার জন্য দায়ী হবে আলিম সমাজই।
কিয়ামতের কঠিন দিনে আল্লাহপাক যখন জিজ্ঞাসা করবেন যে, তোমরা বিপথগামী হলে কেন? তখন তারা পরিষ্কার উত্তর দেবে, হে পরওয়ারদিগার! আমাদের আলিম সমাজ সঠিক পথ প্রদর্শন করেনি।
আল্লাহপাক তার কালামে পাকে ঘোষণা করেন: তারা আরও বলবে, হে আমাদের প্রভু, আমরা আমাদের নেতাদের এবং বড়দের কথা মান্য করেছি, তারা আমাদের বিপথগামী করেছে। হে আমাদের পরওয়ারদিগার! আজ তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের ওপর নাজিল করুন বড় অভিসম্পাত। (সূরা আহযাব, আয়াত : ৬৭-৬৮)
এই আয়াতে সরাসরি আলিমদের নাম নেয়া হয়নি, নেয়া হয়েছে নেতৃত্ব দানকারীদের নাম। তবে যেহেতু ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দায়িত্ব একমাত্র আলিম সমাজের ওপর সেহেতু আলিম সমাজকে এর দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে। যতদিন আলিম সমাজ দায়িত্ব পালনের কোনোরূপ ত্রুটি করে নাই ততদিন মুসলিম সমাজ বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয় নাই।
অথচ আজ মুসলিম সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতিসহ সর্বপ্রকার নেতৃত্ব বেনামাজী, ফাসিক, মিথ্যাবাদী লোকদের হাতে চলে গেছে বহুলাংশে। তারা সে দিকে মোটেও কর্ণপাত করছে না। এটা খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। মূলত আলিম সমাজের উচিত ছিল সকল ক্ষেত্রে দাতার ভূমিকা পালন করা। স্নেহ ও মায়ার মাধ্যমেই মানুষকে সত্যপথের দিকে অধিক অনুরাগী করা।
হুজুরে পাক (স.)-এর ইন্তেকালের একদিন পূর্বে তার সমস্ত গোলামকে (৪০ জন) আযাদ করে দিয়েছিলেন। সেদিন তার ঘরে সাতটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। তিনি তা জানতে পেরে হযরত বিবি আয়েশা (রা.)-কে ডেকে বললেন: আয়েশা! তুমি এখনই দীনারগুলো দীন-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দাও। কারণ, দুনিয়ার ধন-দৌলত ঘরে সঞ্চিত রেখে আমি প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ করব, এটা খুবই লজ্জাজনক হবে। মা আয়েশা (রা.) দীনারগুলোসহ ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্র এমনভাবে দান করেছিলেন যে, বাতি জ্বালাবার এতটুকু তেল পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল না। সন্ধ্যার পর এক প্রতিবেশীর নিকট থেকে ধার করে তেল এনে বাতি জ্বালানো হয়েছিল।
তাই আলিম সমাজের উচিত লোভ, হিংসা, আলস্য, দম্ভ, অবিশ্বাস, মোনাফেকী, অর্থপূজা, ফাঁকিবাজি, চালাকী, স্বার্থপরতা, চাটুকারিতা ক্ষমতাতোষণ ইত্যাদি কুৎসিত ব্যাধিগুলো ত্যাগ করে সত্যিকারের অরাসাতুল আম্বিয়ার দায়িত্ব পালনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসা জাহান্নামের আযাব থেকে নিজেকে এবং মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হওয়া। আল্লাহ আমাদের হেদায়েত দান করুন। আমীন। (সংকলিত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।