তিনি ছিলেন আদর্শিক জীবনের মাইলফলক
ব্যক্তি পরিচয় অতিক্রম করে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিস্তৃত আবহে নিজেকে মেলে ধরে আদর্শিক জীবনের মাইলফলক হয়ে উঠা
১৯৮৫ সাল। ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ। আমন্ত্রণ পেয়ে আমি আলহাজ্জ হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর বনানীস্থ বাসভবনে উপস্থিত হই। বৈঠক খানায় উপস্থিত হওয়ার পর দেখতে পেলাম এ. কে. এম. মহিউদ্দিন আহমাদ সাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর তিনি বললেন, চলুন, আমাদের দোতলায় যেতে হবে। আমরা দোতলায় একটি কামরায় হাজির হলাম। সেখানে হযরত মাওলানা সাহেব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সালাম ও মোসাফাহা সম্পাদনের পর মাওলানা সাহেব আমার পরিচয় জানলেন এবং আমাকে ধর্মীয় বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আমি সাধ্যানুসারে তার প্রশ্নের উত্তর প্রদান করলাম। তিনি খুবই প্রীত এবং পুলকিত হলেন এবং বললেন: আচ্ছা বলুন তো? কোন শ্রেণির মানুষ সর্বোত্তম ও সর্বাধিক বুদ্ধিমান? এই প্রশ্নের উত্তরে সেদিন আমি যা বলেছিলাম, তার সারাংশ আজ আমি আপনাদের উপহার দেয়ার মনস্থ’ করেছি। আসুন, এবার সেদিকে নজর দেয়া যাক।
বর্তমান বিশ্বে অগণিত লোক বসবাস করছে। স্থান, কাল, পাত্র হিসেবে তাদের অন্তরের বিশ্বাস এবং জীবন চালনার রীতিনীতি পৃথক পৃথক। পন্ডিত ব্যক্তিরা বলেন, বর্তমান পৃথিবীতে সাড়ে সাতশ’ কোটির অধিক লোক বসবাস করে। স্থলভাগের কোনো কোনো অংশে মানুষের সংখ্যা এত অধিক যে, যেদিকে তাকানো যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। আবার কোনো কোনো অংশে লোকসংখ্যা খুবই কম। যাই হোক, এত সব মানুষের সকলেই কিন্তু আল্লাহপাকের বান্দাহ। আল্লাহপাক তাদের প্রতিপালক বিধায় সকলের রিজিকের দায়-দায়িত্ব নিজেই বহন করে চলেছেন। তাদের প্রয়োজন পূরণের যাবতীয় উপায়-উপকরণ পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছেন। মানুষ পরিশ্রম করে নিজেদের প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য-সামগ্রী এই পৃথিবী থেকেই আহরণ করতে পারে। কিন্তু তাই বলে সকল মানুষ মহান আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন নয়। তাদের মধ্যে উদাসীন লোকের সংখ্যাই বেশি। যারা সচেতন দলের অন্তর্ভুক্ত, তাদের মধ্যে চারটি বিষয় সম্পর্কে সর্বদাই খেয়াল ও সতর্কতা বিরাজ করে।
প্রথমত: তারা স্মরণ করে যে, আল্লাহতায়ালা প্রতিশ্রুতি গ্রহণের দিন (ইয়াওমে মিছাক) বান্দাহদের নিকট হতে অঙ্গীকার গ্রহণের সময় কিছু মানুষের প্রতি ইঙ্গিত করে ইরশাদ করেছিলেন, এ সমস্ত লোক জান্নাতী। আল্লাহ পাকের এই সিদ্ধান্ত অমোঘ। আবার তিনি কিছু লোকের প্রতি ইঙ্গিত করে ইরশাদ করেছিলেন, তারা জাহান্নামী। আল্লাহ পাকের এই সিদ্ধান্তের সত্যতাও প্রশ্নাতীত। কারণ, আল্লাহপাক যা ইচ্ছা করেন তা-ই পরিসাধিত হয়। এ জন্য মানুষের উচিত এ কথা স্মরণ রাখা যে, যা সে প্রতিপালন করে যাচ্ছে, তা কোন দলের অন্তর্ভুক্তির ইশারা প্রদান করছে। জান্নাতীর দলের, না জাহান্নামীর দলের?
দ্বিতীয়ত: সচেতন লোকেরা একথাও জানে যে, মহান আল্লাহপাকের নির্দেশে ফিরিশতাগণ যখন মাতৃগর্ভে শিশুর ভিতরে রূহ ফুৎকার করে, তখন তারা আরজ করে, হে আল্লাহ! তাকে কী সৌভাগ্যবান বলে লেখা হবে, নাকি বদনসিব লেখা হবে? তারপর আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী, তারা তা লিপিবদ্ধ করেন। মানুষ জানে না, সে কোন দলের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য সচেতন দলের লোকেরা পৃথিবীর জীবনে সৌভাগ্যের পথে চলার জন্য প্রয়াসী হয় এবং দুর্ভাগ্য তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না।
তৃতীয়ত: সকল মানুষই জানে যে, মানুষ মরণশীল। মৃত্যুর তুহীন শীতল পরশ একদিন সকলকেই পরিবৃত করবে। মালাকুল মউত বা মৃত্যুর ফিরিশতা বান্দাহর রূহ বের করার সময় আল্লাহপাকের দরবারে ফরিয়াদ করে, হে বারে এলাহী, তাকে কি অনুগত বান্দাহদের সাথে রাখা হবে, নাকি অবিশ্বাসীদের দলভুক্ত করা হবে? আল্লাহপাকের নির্দেশ মোতাবেক, মৃত ব্যক্তির রূহকে যে কোনো দলের সাথে রাখা হয়। এ জন্য সচেতন মানুষ সর্বদাই এই চিন্তায় নিমগ্ন থাকে যে, তার রূহ যেন অনুগত বান্দাহদের সাথে রাখা হয়। এ জন্য তারা নেক আমলের প্রতি অনুরাগী হয় এবং দুনিয়ার জীবনকে পুণ্য লাভের পথে পরিচালিত করে।
চতুর্থত: সচেতন লোকেরা আল্লাহপাকের কালামের নির্দেশের প্রতি সর্বদাই সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মহান আল্লাহপাক আল কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন: হে পাপিষ্টের দল! আজ (শেষ বিচারের দিন) তোরা পুণ্যবানদের থেকে আলাদা হয়ে যা। এই নির্দেশের সাথে সাথে অসচেতন বদকার লোকেরা পৃথক হয়ে যাবে। তাই, সচেতন বান্দাহগণ পুণ্যাশ্রয়ী জীবনযাপন করে এবং অবিশ্বাসীদের থেকে দূরে অবস্থান করে।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার, উদাসীনতার বিশাল আবরণ ছিন্ন করে যারা সচেতনতার মুক্ত অঙ্গনে বিচরণ করার সৌভাগ্য লাভে ধন্য হয় তাদের জীবন চলার পথে চারটি নিদর্শন সুস্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে। প্রথমত: তারা দুনিয়ার জীবনে স্বল্পে পরিতুষ্ট হয় এবং ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে জীবন অতিবাহিত করে। কাজেকর্মে কখনো তারা তাড়াহুড়া করে না এবং বুঝেশুনে পথ চলে।
দ্বিতীয়ত: তারা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয় না বরং পরকালীন জীবনের মুক্তি ও নিষ্কৃতির প্রতি খুবই উৎসাহী হয় এবং তজ্জন্য যা কিছু করা দরকার তা অতি তাড়াতাড়ি সম্পাদন করে।
তৃতীয়ত: তারা মনে করে যে, আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা অবলম্বন করাই উত্তম। যে জীবনযাত্রার অনুমোদন আল্লাহর নিকট হতে আসেনি, তা বর্জন করাই শ্রেয়। তাই তারা জীবন ও জগতের যাবতীয় কাজ-কর্ম চেষ্টা-তদবির ও অজ্ঞান এবং প্রজ্ঞার আলোকে সম্পাদন করার প্রয়াস চালায়।
চতুর্থত: সকল সৃষ্ট জীবের সাথে তারা উপদেশ ও সৌজন্যমূলক আচরণ করে। তাদের চিন্তা-চেতনায় সৃষ্টির সেবার বিষয়টি সততই প্রাধান্য লাভ করে। তাই, এই শ্রেণির লোকেরাই হয় উত্তম মানুষ হওয়ার গুণে অভিষিক্ত। যাদেরকে বুকে ধারণ করে পৃথিবী গৌরব বোধ করে।
বস্তুত সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাধিক বুদ্ধিমান লোক তারাই, যারা সচেতন শ্রেণির দলভুক্ত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত। একদা জনৈক ব্যক্তি পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ কে? জবাবে তিনি বললেন: যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী। আবার জিজ্ঞেস করা হলো: হে আল্লাহর রাসূল! সর্বাধিক বুদ্ধিমান কোন ব্যক্তি? উত্তরে তিনি বললেন: যে ব্যক্তি মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করে এবং তার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে, সেই ব্যক্তিই সর্বাধিক বুদ্ধিমান।
আমার প্রদত্ত এই উত্তর শুনে আলহাজ্জ হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন: মারহাবা, মারহাবা, আল্লাহ আপনার হায়াত দারাজ করুন। তার কোমল হাতের মধুর পরশ আজও আমার দেহ-মন-মগজে অনুপ্রেরণার চঞ্চল স্রোত প্রবাহিত করে চলেছে। আল্লাহপাক তাঁকে কুরব ও মানজেলাতের উচ্চ হতে উচ্চতর মাকাম দান করুন, আমীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।