Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দুর্গন্ধ ছড়ায় হাতিরঝিলের কালো পানি

ইয়াছিন রানা | প্রকাশের সময় : ১১ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০১ এএম

মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হয়ে পড়েছে রাজধানীর অন্যতম প্রধান বিনোদন কেন্দ্র হাতিরঝিলের পানি। আশেপাশের এলাকার পয়োবর্জ্য পানিতে পড়ার কারণে বিকট দুর্ঘন্ধ ছড়াচ্ছে ঝিল থেকে। ঝিলের পানি এতোটাই কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়েছে যে জলজ প্রাণের জন্য তা অনুপোযোগী হয়ে গেছে। ভুল পরিকল্পনা ও ত্রুটিযুক্ত রাজউকের এই প্রকল্প নিয়ে মহা বিরক্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। একদিকে যে উদ্দেশ্যে হাতিরঝিল করা হয়েছিল তা কোন কাজেই আসছে না; আরেকদিকে বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি ও ঝিলের ময়লা দুর্গন্ধ পানির কারণে ভোগান্তির শিকার নগরবাসী।

হাতিরঝিলের পাশে মগবাজারের মধুবাগের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, হাতিরঝিলের পানির দুর্গন্ধ বাতাসের মাধ্যমে এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। আগে ঝিলের ঠান্ডা বাতাস ভাল লাগতো কিন্তু পচাঁ ময়লা পানির গন্ধে এখন বিরক্ত সবাই। সকাল বা সন্ধ্যায় ঝিলপাড়ে অনেকে হাটতে যেত কিন্তু মানুষ গন্ধের কারণে কম যায়।
হাতিরঝিলের বাড্ডা অংশে প্রচুর মানুষ সকালে হাটাহাটি করে। অনেকেই ডায়বেটিসের কারণে সকাল বা রাতে হাটা বাধ্যতামূলক। গন্ধ থাকলেও নাকে রুমাল বা মাস্ক পড়ে এই রাস্তায় হাটেন তারা। সাবিনা ইয়াসমিন নামের একজন গৃহিনীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, অসুস্থতার কারণে প্রতিদিনই হাটতে হয়। পানি পচেঁ গন্ধ হয়ে গেছে, মাস্ক পড়ে এই রাস্তায় হাটি।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সূত্র জানায়, ঝিলের পানি শোধন ও দুর্গন্ধমুক্ত করতে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল তবে এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ এক দফায় এক বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে। করোনার কারণে বিদেশি পরামর্শকরা দেশে ফিরে যাওয়ায় প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।
হাতিরঝিল লেকের পানির দুর্গন্ধ দূর করতে ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ওই বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত। পরে আরও এক বছরের জন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এটি বাস্তবায়িত হলে হাতিরঝিলের পানি দুর্গন্ধ ও দূষণমুক্ত হবে।

সংশ্লিষ্ট কয়েকজন প্রকৌশলীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পের পরিকল্পনার ত্রুটির কারণে এ সমস্যা হয়েছে। এছাড়া স্যুয়ারেজ ড্রেনের নির্মাণের ত্রুটি হয়েছে। দুই পাইপের সংযোগস্থল ভাল করে জোড়া না দেয়ায় ময়লা পানি লিকেজ করে ঝিলের পানিতে মিশ্রিত হয়। ফলে পানি দুর্গন্ধ ও কালো হয়ে যায়। পানি পরিষ্কার রাখতে হলে পুরো ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো লাগবে।

রাজউকের বিশ্লেষণ, হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের লেক একটি স্টর্ম ওয়াটার রিটেনশন বেসিন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু লেকের নালা এলাকায় স্টর্ম ও স্যুয়ারেজ লাইন আলাদা ছিল না। ফলে বর্জ্য মিশ্রিত পানি হাতিরঝিল লেকে পড়ছে। বর্ষাকালে অতি বৃষ্টির সময় লেকের সব নালা বা পথ খুলে দেওয়া হয়। ফলে পয়োবর্জ্য সরাসরি ঝিলের লেকে পড়ে। এর ফলে পানি দিন দিন দূষিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
এর আগে ঝিলের পানি পরীক্ষা করার জন্য জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাওয়া রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হাতিরঝিলের পানি অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে দূষিত। এই পানি জলজ প্রাণের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এই পানি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য মারাত্মক হুমকি। পরে পানি দূষণমুক্ত করার প্রকল্পটি নেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আর বাস্তবায়ন করবে রাজউক।

হাতিরঝিলে মোট ৯টি মেকানিক্যাল স্ক্যানার রয়েছে। এর মাধ্যমে ঝিলের আশপাশের এলাকার বাসাবাড়ি ও বৃষ্টির পানি ঢাকা ওয়াসার ড্রেনের মাধ্যমে হাতিরঝিলে অপসারিত হয়। কিন্তু ৫০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টি কিংবা টানা বর্ষণ হলে এই স্ক্যানারগুলো পানির চাপ সামলাতে পারে না। তখন সব খুলে দেওয়া হয়। ফলে বর্জ্য দুর্গন্ধ ছড়ায়।
এদিকে হাতিরঝিল নিয়ে ‘মিস প্ল্যান’ হয়েছে মন্তব্য করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তিনি স¤প্রতি বলেছেন, হাতিরঝিল নিয়ে মিস প্ল্যান হয়েছে। এখন হাতিরঝিল প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতকে মাথায় রেখে এর প্ল্যান করা হয়েছে। বাংলাদেশ তো বৃষ্টিপ্রবণ দেশ। ৬ ঋতুকে মাথায় রেখেই প্ল্যানটি করা উচিত ছিল। ৫০ থেকে ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে ঢাকার অবস্থা কী হবে সেটাও ভাবার দরকার ছিল।

বর্তমানে হাতিরঝিলের পাশে কয়েকটি এলাকায় পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, হাতিরঝিল করার সময় যদি এই এলাকাগুলো নিয়ে পরিকল্পনা করা হতো, তাহলে এই সমস্যাটা হতো না। মেয়র আরও বলেন, এখন হাতিরঝিলে আরও বেশি পাম্প বসিয়ে পানি আউট করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি হোক শর্ট ওয়েতে পানি নিষ্কাশন করতে হবে।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এবং হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস গণমাধ্যমে বলেছেন, হাতিরঝিলের পানি শোধনের জন্য একটা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা চাচ্ছি কেমিক্যাল দিয়ে পানির স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আনা। প্রতিবছর এই কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হবে। না হলে আবার আগের মতো হয়ে যাবে।

তিনি জানান, আমরা কাজও শুরু করে দিয়েছি। প্রকল্পের মেশিনারিজ ও টেকনোলজি আমদানির বিষয় রয়েছে। আমরা কিছু কিছু মালামাল আমদানিও করেছি। কিছু কিছু শিপমেন্টের বাকি রয়েছে। এগুলো স্থাপনে অস্ট্রেলিয়া ও চাইনিজ বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন ছিল। করোনার কারণে বিদেশিরা আসতে পারছেন না। আর তাদের মতো টেকনিক্যাল সাইট দেখার মতো আমাদের কেউ নেই।

তিনি আরও বলেন, হাতিরঝিলের পানি নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, কাওরান বাজার, পান্থপথ, ধানমন্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান ও বাংলামোটরসহ এই এলাকার বর্জ্য সোনারগাঁও হোটেলের পেছনের অংশ দিয়ে হাতিরঝিলে পড়ে। এটা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্গন্ধ

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১
১৭ আগস্ট, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ