পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানুষের অধিকার আদায়ের রাষ্ট্রীয় ও আইনগত পন্থা হলো আদালতে মামলা করা। আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার যৌক্তিক বা আইনগত অধিকার ফিরে পায়। রাষ্ট্রের প্রতিটা নাগরিকের মামলা করার অধিকার আছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে আইনের আশ্রয়লাভের অধিকারের কথা উল্লেখ আছে। সুতরাং সহজেই অনুমেয় যে, যখনই কেউ তার অধিকার নিয়ে শঙ্কিত থাকবে বা আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে তখনই সে আইনের আশ্রয় লাভ করার অধিকারী।
আমাদের বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থায় অধিকাংশ মামলা স্বত্ব বা জমি-জমা এবং বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত। সাধারণত মামলার প্রকৃতি দুই ধরনের: দেওয়ানী ও ফৌজদারী। জমি-জমা বা সম্পদ এবং পদসংক্রান্ত মামলাকে দেওয়ানী মামলা বলা হয়। অন্যদিকে মারামারি, চুরি, ডাকাতি, খুন, জখম, প্রতারণা, দস্যুতা, ধর্ষণ, অপহরণ, বে-আইনি সমাবেশ, ইভটিজিং, জালিয়াতি বা মিথ্যা সাক্ষ্যদান সংক্রান্ত মামলাকে ফৌজদারী মামলা বলা হয়। সুপ্রিমকোর্ট সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে বিচারাধীন মোট মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮টি। তার মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে ২৩ হাজার ৬১৭টি। হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮টি। অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৪৩টি। আর এই মামলাগুলো পরিচালনা করার জন্য বিচারকের সংখ্যাটা বেশ নগন্য। আপিল বিভাগে বর্তমানে বিচারপতির সংখ্যা ৮ জন, হাইকোর্ট বিভাগে ৯৪ ও অধস্তন আদালতে আছে ১৮১২ জন। সুপ্রিমকোর্টের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আপিল বিভাগে বিচারের জন্য বিচারক প্রতি মামলা রয়েছে ২ হাজার ৯৫২টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক প্রতি রয়েছে ৫ হাজার ২০২টি। অধস্তন আদালতে বিচারক প্রতি মামলা আছে ১ হাজার ৭৫০টি। আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, মোট জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে বিচারকের সংখ্যা যুক্তরাজ্যে ১৫৯২৭ জনের বিপরীতে একজন, যুক্তরাষ্ট্রে ১০১৪৭ জনের বিপরীতে একজন, অস্ট্রেলিয়াতে ২৪১১০ জনের বিপরীতে একজন, কানাডাতে ৩১১৮৬ জনের বিপরীতে একজন, নিউজিল্যান্ডে ১১৫৫৪ জনের বিপরীতে একজন ও প্রতিবেশী ভারতে ৭৭৬২২ জনের বিপরীতে একজন। আর বাংলাদেশের ১ লক্ষ ৩৭০ জনের বিপরীতে আছেন একজন বিচারক।
গত এক দশকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট থেকে অধস্তন সব আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি বিচারকের সংখ্যা। সে সময়ে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকের সংখ্যা যা ছিল, এখন তা আরও কমেছে। ২০১০ সালে আপিল বিভাগে ১১ জন বিচারপতি ছিলেন, এখন আছেন মাত্র ৮ জন। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক ছিলেন ১০২ জন, বর্তমানে আছেন ৯৪ জন। তবে অধস্তন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে আছেন এক হাজার ৮১২ জন। আগে ছিলেন ১ হাজার ৬০০ জন বিচারক। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের মতে, বিচার বিভাগের চলমান মামলাজট নিরসনে যত দ্রæত সম্ভব অন্তত পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ দিতে হবে।
সারাদেশে অনেক আলোচিত মামলা আছে যেগুলো এখনো আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি হয়নি। যেমন, সাগর-রুনী হত্যাকাÐ, যেটি ২০১২ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি সংঘটিত হয়েছিলো, ৮ বছর অতিবাহিত হলেও মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি। কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর হত্যা মামলাটিও শ্লথতার শিকার। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার ৪ বছর পার হলেও এখনো রায় হয়নি। ত্বকী হত্যা সংঘটিত হয় ২০১৩ সালে। তারপর কেটে গেছে ৭ বছর। কিন্তু এখনো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। সম্ভত, এসব মামলা নিষ্পত্তি হতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে। আবার কিছু মামলার রায় হয়ে গেলেও আসামী পক্ষ আপিল করায় আপিল পর্যায়ে আটকে আছে। যেমন, ফেনীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলা, নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন মামলা, গাজীপুরের আহসান উল্লাহ মাষ্টার হত্যা মামলার রায় হয়েছে কিন্তু বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এসব মামলার ফরিয়াদী পক্ষরা আপিল বিভাগের রায়ের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
মামলা জটের প্রধান কারণ হলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বিচারক সংখ্যা ও আদালতে এজলাস সংকট। ফলে অধস্তন আদালতে সকালে একজন বিচারক বসেন, আবার বিকেলে একই এজলাসে আরেকজন বিচারক বসেন। বিচারকদের সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় পেশকার, সেরেস্তাদার, কর্মকর্তা, কর্মচারীর সংখ্যাও অপ্রতুল। একজন মধ্যম পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা যতটা সহায়ক লোকবল নিয়ে কাজ করেন, তার থেকে বিচারকেরা অনেক কম লোকবলের সহায়তায় বেশি কাজ করেন। তাছাড়াও সাক্ষ্য ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে দীর্ঘদিন সময় ব্যয়, আইনজীবীদের দূরদর্শিতার অভাব, সাধারণ মানুষের আইন সম্পর্কে বিরূপ ধারণা থেকে অসহযোগিতার মনোভাব, তথ্য-উপাত্তের আধুনিকায়ন না হওয়া মামলা দ্রæত নিষ্পত্তির পথে বড় অন্তরায়।
মামলা জটের পিছনে সাধরাণ মানুষও অনেকাংশে দায়ী। যেমন, ছোট খাটো ইস্যু নিয়ে আদালতে যাওয়া, যেটা সহজে গ্রামেই মধ্যস্ততার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। আইনজীবীদের খামখেয়ালীপনাও এক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী। উভয়পক্ষের আইনজীবীরা চাইলে মামলার সংখ্যা কমাতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে কারণে-অকারণে আইনজীবী তার মক্কেলের জন্য টাইম পিটিশন চায়। আবার আইনজীবী তার ক্লায়েন্টকে হাতে রাখার জন্য ইচ্ছাকৃত ইস্যু তৈরি করে। এটাও মামলা জটের অন্যতম কারণ। বার-বেঞ্চ মূদ্রার এপটি ওপিট। বিচারকদের পাশাপাশি মামলার জট কমাতে আইনজীবীদেরও আন্তরিক হতে হবে। কেননা বার থেকে সহযোগিতা না করা হলে শুধু বিচারকেরা চাইলেই এই অবস্থা বদলাতে পারবেন না।
মামলার জট কমাতে যেসব পদক্ষেপ এখনি নিতে হবে সেগুলোর মধ্যে সংবিধানের ২২নং অনুচ্ছেদের বাস্তবিকভাবে প্রয়োগ অন্যতম। অর্থ্যাৎ বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মামলা পরিচালনার সিস্টেম অর্থাৎ একটা মামলা থেকে একাধিক মামলার উদ্ভব যাতে না হয় তার নিশ্চতকরণ। তৃতীয়ত, জমিজমা সংক্রান্ত যত মামলা দায়ের হয় এগুলোর মূল কারণ হলো, জমিজমার রেকর্ডপত্র, ফাইলপত্র এবং তা সংরক্ষণের কোনো সুব্যবস্থা না থাকা। একই জমির মালিকানা দাবি করেন ৪-৫ জন। ফলে একটা জমি থেকে ৪-৫টি মামলা উদ্ভব হয়। এ মামলাগুলো আবার দ্রæত শেষও হয় না। চলতে থাকে বছরের পর বছর। সুতরাং রেকর্ডপত্র, ফাইলপত্রসহ অন্যান্য বিষয়াদি ডিজিটালাইজড করতে হবে। অধস্তন আদালতের বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ার বিধান সকাল ১০টায় এবং শেষ হওয়ার বিধান বিকাল ৪টায়। মাঝখানে এক ঘণ্টার বিরতি। এই সময়টাও কার্যকরভাবে পালন করা হয় না। সকাল ১০টায় আদালত শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কার্যক্রম শুরু হতে সকাল ১১টা লেগে যায়। ফলে এ সময় বাদী-বিবাদী, ফরিয়াদি-অভিযুক্তকে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। একইভাবে মামলা জট কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়াতে হবে। যদিও ২০১২ সালের পর থেকে দেওয়ানী মামলার উভয়পক্ষকে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির আহŸান করা দেওয়ানী আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটা অবশ্যই ভালো দিক। তবে এখন এটাকে আরো বাস্তবসম্মত রূপ দিতে হবে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে কোনো ঝামেলা ছাড়াই উভয় পক্ষের পূর্ণ সন্তুষ্টিতে দ্রæত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এর ফলে আপিলসহ অন্য আর কোনো নতুন মামলার উদ্ভব হয় না। এখানে সময়, শ্রম ও অর্থের খরচ কমে যায় বিধায় উভয় পক্ষই জিতে যায়। আমাদের আদালতে বিচারাধীন মামলার বেশ বড় অংশই মিথ্যা বা ফলহীন মামলা। সুতরাং মামলা আমলে নেয়ার সময় ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। কেননা মামলা বিচার নিষ্পত্তি করে কমানো সম্ভব নয়, দরকার মামলাকে প্রবেশ পথে আটকানো। আর যারা অপরকে ক্ষতি করার জন্য মিথ্যা মামলা করে তাদের দÐবিধির ২১১ ধারার আওতায় এনে দ্রæত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই মামলা কমানো সম্ভব। উচ্চ আদালতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখে বিচারক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন, রাজনৈতিক পরিচয় দেখে নয়। সর্বোপরি, মানুষকে সচেতন করতে হবে এবং তাদের কোনো অধিকার যাতে লংঘিত না হয় সে দিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। সরকার যখনই তাদের অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হবে তখনই তারা আর কোর্টে দৌড়ানোর প্রয়োজন মনে করবে না।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।