পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সাম্প্রতিককালে সুশাসন কথাটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাষ্ট্র একদিকে রাজনৈতিক সংগঠন আবার সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনও বটে। এ সংগঠনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয় নানাবিধ কর্ম। এসব কর্ম সম্পাদনের সঙ্গে রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদসহ ছাত্র-শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ ওৎপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি চর্চা তথা গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে শিক্ষা তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গণতন্ত্র এক ধরনের ব্যবস্থা, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক সমাজব্যবস্থা, এক ধরনের সিস্টেম। গণতন্ত্র সবার আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে, সবার জীবনকে স্পর্শ করে। সবার জন্য রচনা করে এক বলিষ্ঠ জীবনবোধ। সাম্য, মৈত্রী ও সৌভ্রাত্বের উপত্যকায় সকলকে সংগঠিত করে। এ কারণে গণতন্ত্রকে সমাজব্যবস্থা বলা হয়। অন্যদিকে গণতন্ত্র এক প্রক্রিয়া বটে (a process)। এ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি স্বীকৃত হয় স্বতন্ত্র, সম্পূর্ণ, অনন্য এক রূপে। ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র। ব্যক্তির সম্মতি ব্যতীত ব্যক্তিকে শাসন করার অধিকার কারো নেই। যে কোনো নীতি নির্ধারণে সর্বাধিক ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিফলন হতে হয়। আর সবার সম্মতি নিয়ে পরিচালিত হয় সমাজ ব্যবস্থা। তাই বলা হয় গণতন্ত্রে শাসন নেই, নেই কোনো শাসক বা শাসিত। সবাই মিলে সবার কাজ পরিচালনা করে যে সমাজ সে সমাজকে সুপরিচালিত সমাজ বা সুশাসিত সমাজ বলা হয়। এ ধরনের সুশাসিত সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সুশাসন সম্পর্কে তাত্ত্বিকগণ সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। Sir Kenneth Stowe সুশাসনের নির্দেশক হিসেবে কতগুলো বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যথা:
১. রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এবং একটি অবাধ নির্বাচিত আইন সভা,
২. ব্যক্তিসত্ত্বার অধিকার সংরক্ষণে সংবিধান ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা,
৩. স্থিতিশীল ব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ,
৪. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন,
৫. একটি স্বাধীন নির্বাচিত আইন সভার নিকট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা।
পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে যে সব বিষয়কে সুশাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করা, সরকারি কাজে দক্ষতা অর্জন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, প্রতিনিধিত্বমূলক আইন সভা, আইন ও মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং বহুমুখী সাংগঠনিক কাঠামো। সুতরাং সুশাসন হলো: শাসন ব্যবস্থার এমন এক দিক যা মানুষের সর্বাধিক কল্যাণে নিয়োজিত থাকে।
সমাজবদ্ধ মানুষ এবং মানবসভ্যতা বিকাশে শিক্ষা শব্দটি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ করা হয়। শিক্ষা হচ্ছে ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশের নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। জন ডিউই শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে: ‘শিক্ষা হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবনবিকাশ। পরিপূর্ণ বিকাশ বলতে সে সব গুণের বিকাশকে বুঝায়, যা দ্বারা ব্যক্তি তার পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে, নিজের সমস্ত সম্ভাবনার বিকাশ সাধন করতে পারে।’ শিক্ষা শব্দটির মধ্য দিয়ে জ্ঞান আহরণ, দক্ষতা অর্জন ও কৌশল আয়ত্তকরণ, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, আচরণের উন্নয়ন এবং ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশকে বুঝায়। শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আত্মপ্রকাশের দক্ষতা ও নিপুণতা অর্জিত হয়, পরিবারের সুসভ্য সদস্য হিসেবে পরিচিত হয়, ভালোভাবে জীবিকা অর্জনের ক্ষমতা অর্জিত হয়, নৈতিক চরিত্র উন্নত হয়, আইন ও বিধি-বিধান মেনে চলতে অভ্যস্ত হয় এবং নেতৃত্বের বিকাশ হয়।
প্রায় দু’শ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসানের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান শাসনামল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে সুশাসন বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অস্তিত্ব, সামরিক-বেসামরিক আমলার নেপথ্য পরিচালনায় সরকার পরিচালিত হওয়ায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার জনগণের ইচ্ছাকে ব্যর্থ করে দেয়। এরূপ পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশ সুশাসনের পথে অগ্রসর হতে চাইলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বার বার সামরিক অভ্যুত্থান, ক্ষমতা দখল, সরকারি কার্যক্রমের ব্যর্থতা, জনগণের সাথে সরকারের দূরত্ব, দুর্নীতি, আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতা প্রভৃতি সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারের উপর অর্পিত বিধায় শাসন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চর্চা করে সরকার। কঠোর শাসন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণকে অধিকারহীন করে রাখার অধিকার কোনো রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। কঠোর শাসন নয় বরং সুশাসনই সকলের কাম্য। অথচ বাংলাদেশে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে জনকল্যাণ সাধন করে সেরূপ প্রশাসন ব্যবস্থা ও সেরূপ সরকারের অস্তিত্ব অধিকাংশ সময়ে ছিল না। অথচ সর্বস্তরের জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্খা সবসময় ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার। এ জন্য বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে সর্বস্তরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছে এবং বহু রক্ত দিয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন। বাংলাদেশ সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত শিক্ষা। শিক্ষা হচ্ছে সেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একক উপাদান, যা থাকলে মানুষ অগ্রমনের পথে সকল বাঁধা জয় করতে পারে। অপরপক্ষে শিক্ষার প্রাণ হলো শিক্ষক। আবার কোন জাতির উন্নতি-অবনতি নির্ভর করে শিক্ষার উপর। তাই বলা যায়, শিক্ষা যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তাহলে শিক্ষক শিক্ষার মেরুদন্ড। আর সুশাসনের জন্য সুশিক্ষা ও সুশিক্ষক অপরিহার্য।
জোহান ডব্লিউ ভন গ্যেটের মতে, To rule is easy, to govern is difficult. অর্থাৎ শাসন করা সহজ, পরিচালনা করা কঠিন বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে সর্বোত্তম রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে পছন্দ করে। এ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রুল বা শাসন করার সুযোগ নেই। আছে গভার্ণ বা পরিচালনা করার ব্যবস্থা। এ গভার্ণ বা পরিচালনা করার কাজটি সহজ নয়। এ দায়িত্ব জনগণ যাদের উপর অর্পন করবে সে নেতৃত্বকে অবশ্যই সৎ, যোগ্য, দক্ষ, মেধাবী ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। আর এ ধরণের নেতৃত্ব সৃষ্টিতে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। কেননা শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের রাজনীতি ও নেতৃত্বের ভিতরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যায়। নেতৃত্বের আদর্শ, বলিষ্ঠতা ও দূরদর্শিতা একটি জাতিকে এগিয়ে নেয়। অন্যদিকে নেতৃত্বের ব্যর্থতা অনেক সময় একটি দেশকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সবার জানা। আলবেয়ার কাম্যুর বিখ্যাত উক্তিতে আস্থাশীল হয়ে বলা যায়, Freedom is nothing but a change to be better. অর্থাৎ ‘স্বাধীনতা আরো উন্নত হবার সুযোগ ছাড়া আর কিছুই নয়।’ হাজারো মানুষের জীবনদান এবং আরো অনেকের অপরিমেয় দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীন দেশ পেয়েছি তাকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষা ও শিক্ষককে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কেননা শিক্ষার মাধ্যমে আগামী দিনে যারা নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন তাদের নীতি, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, জাতীয়তাবোধ প্রভৃতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখতে হবে।
সুশাসন ও শিক্ষার উন্নয়নে নিম্নবর্ণিত প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:
১. বাংলাদেশের সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা প্রয়োজন।
২. শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য মেধাবীদের শিক্ষাগত পেশায় নিয়ে আসা ও ধরে রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, এ জন্য শিক্ষককে আকর্ষণীয় বেতন প্রদান করা আবশ্যক।
৩. মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি শিক্ষার মধ্যে সমন্বয়সাধন করা প্রয়োজন।
৪. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একটি সু-শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় নিয়ে এসে এদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
৫. এমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন যার মাধ্যমে আমাদের জাতিসত্ত্বার বিকাশ ঘটবে, দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে জীবনঘনিষ্ঠ, মানবিক, কর্মমুখী ও সময়োপযোগী আদর্শ।
৬. জনগণের কাক্সিক্ষত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে উন্নয়ন ও সুশাসনের রাজনীতি চর্চায় প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনীতির স্থান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পেশাগত জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে রাজনীতি।
৭. সুশাসন প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় বাঁধা দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা। এসব দূর করা আবশ্যক, দারিদ্র নিরসন এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় কর্মকৌশল গ্রহণ করা জরুরি।
৮. গণতন্ত্রের সুশীল চর্চা ও রাজনীতিকে উৎপাদনমুখী করা প্রয়োজন।
৯. বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ তথ্য প্রবাহ ইত্যাদির ফলে শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সময়োপযোগী নীতি কাঠামো তৈরি ও দক্ষতার সাথে তা বাস্তবায়ন করা জরুরি।
বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে সুশাসনের আওতায় আনতে হলে এ জনগোষ্ঠীকে বিবেকবান, দায়িত্বশীল, সুশিক্ষিত ও সচেতন করে গড়ে তোলা আবশ্যক। জনগণ, সরকার, বিরোধী দল পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করলে বাংলাদেশে সুশাসনের সমস্যা সমাধান হবে। তাছাড়া মনে রাখা প্রয়োজন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কারিগরি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সামাজিক রূপান্তরের জন্য মূল চালিকাশক্তি মানব সম্পদ উন্নয়ন, যা শুধুমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।