Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যৌন নির্যাতন ও হয়রানি রুখতে হবে

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৯ এএম

একজনের উপর অন্যজনের চাপিয়ে দেওয়া যৌন আচরণকে যৌন নির্যাতন বা উৎপীড়ন বলা হয়। যখন প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে জোর করা হয় তখন তাকে যৌন লাঞ্ছনা বলা হয়। যদি হানিকর হয় তাহলে অপরাধীকে যৌন নির্যাতক বা উৎপীড়ক বলে অভিহিত করা হয়।যদি কোন প্রাপ্তবয়ষ্ক লোক বা তরুণ কোন শিশুকে যৌন কাজে লিপ্ত হওয়ার জন্যে অনুপ্রেরণা দেয় তাকেও যৌন নির্যাতন বলা হবে।শিশু বা নাবালকের সাথে যৌন কাজে লিপ্ত হলে তাকে শিশু যৌন নির্যাতন বা বিশেষ আইনের আওতায় ধর্ষণ বলা হয়।

যৌন হয়রানিমূলক আচরণের মধ্যে রয়েছে ক. অযাচিত যৌন আচরণ, শরীরের সংস্পর্শ বা ধাবিত হওয়া খ. প্রশাসনিক, কর্তৃত্ব বা পেশাগত ক্ষমতাবলে কোনো ধরনের শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন বা যৌনতা সম্পর্কিত আচরণের চেষ্টা করা গ. অযাচিতভাবে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো কিছু দেখানো বা প্রদর্শন করা ঘ. যৌন সুবিধা গ্রহণের দাবি বা অনুরোধ করা ঙ. অশ্লীল বা কুরুচিপূর্ণ কোনো কিছু দেখানো চ. যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য বা অঙ্গভঙ্গী করা ছ. কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি, অকথ্য ভাষার ব্যবহার করা, ধোকা দেওয়া, যৌন উপাদান মিশ্রিত হাস্যরস। জ. চিঠি, ফোনালাপ, মোবাইল ফোন, ক্ষুদ্র বার্তা প্রেরণ, নোটিশ, ব্যাঙ্গচিত্র, চেয়ার, টেবিল, নোটিস বোর্ড, দেওয়াল, কারখানা, শ্রেণিকক্ষে, টয়লেটে বা গোসলখানায় আলপনা আঁকা বা এমন কিছু লেখা যার মধ্যে যৌনতা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রকাশ ঘটে ঝ. চরিত্র হনন বা চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ছবি বা ভিডিও করা। ট. জেন্ডার পরিচয়ের বা যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বাধা প্রদান ঠ. ভালোবাসার প্রস্তাব দেওয়া বা সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী প্রস্তাব করা এবং প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ বা ভয়ভীতি দেখানো ড. মিথ্যা আশায়, ছলনা বা প্রতারণার মাধ্যমে কারো সাথে যৌন সম্পর্কের চেষ্টা করা।

যৌন হয়রানি বিষয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ এবং গুণগত মানসম্পন্ন তথ্য বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যায়। তবে অ্যাকশন এইড পরিচালিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদন, ‘ওমেন অ্যান্ড দ্য সিটি-৩: সাত দেশে নারী ও মেয়েদের উপর সহিংসতার প্রাথমিক তথ্যের সার সংক্ষেপে’ দেখা যায়, বাংলাদেশে যৌনতা প্রকাশ পায় এমন অঙ্গ-ভঙ্গি বা মন্তব্য করা, কটূ কথার মাধ্যমে উত্তক্ত করা এবং যৌন তাৎপর্যপূর্ণ কৌতুক করার মত ঘটনাগুলোই সাধারণভাবে ঘটে থাকে এবং ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির শিকার নারীদের এ ধরনের অভিজ্ঞতাই সবচাইতে বেশি। নারীদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সকল পাবলিক প্লেসের মধ্যে রাস্তায়ই সব থেকে বেশি সহিংসতার মত ঘটনাগুলো ঘটে অথবা সেখানেই নারীরা সব থেকে অনিরাপদ বোধ করে।

সমীক্ষাটি সাতটি জেলা সদরে পরিচালনা করা হয়। সেখানে দেখা যায়, ৮৪% নারী জানিয়েছে, তারা কটূ কথা বা যৌন মন্তব্য, ৫৬% জানিয়েছে, তারা যৌন হয়রানি/ইভটিজিং এবং ২২% জানিয়েছে, তারা যৌন আক্রমণ, ধর্ষণ বা ধর্ষণ আতঙ্কের শিকার। এসব অভিজ্ঞতা হয়েছে গত এক মাসে বা বছরে। রাস্তায় আলোর স্বল্পতা, রাতে কাজ করা বা যাতায়াত করা এবং উত্তরোত্তর ভয়ের অনুভূতি বৃদ্ধি বা প্রকৃত সহিংসতার চিত্র ব্যাপক প্রচার পাওয়ার মত বিষয়গুলোর মধ্য দিয়েই নিরাপত্তার ঘাটতি তৈরি হয় বলে নারীরা মনে করে। যেসব কারণে নারীরা যৌন হয়রানি বা যৌন আক্রমণের অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকে সেগুলো হলো: এ ধরনের অভিযোগ করে কোন লাভ হয় না, অভিযোগ করার প্রক্রিয়াটি খুব জটিল ও বিরক্তিকর, সামাজিক অপবাদ বা কলঙ্কের ভয় এবং আরও নিপীড়নের আশঙ্কা।

শিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে শিশুরা কোন প্রাপ্তবয়স্ক বা বড় শিশুর দ্বারা যৌনতামুলক আচরণের শিকার হয়।এক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন বলতে বুঝায় কোন শিশুর যৌনতামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা, যার উদ্দেশ্য কোন ব্যক্তির শারীরিক সন্তুষ্টি লাভ বা বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়া।এই ধরনের যৌন নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে কোন শিশুকে যৌনতামুলক কাজ করতে বলা বা চাপ দেওয়া, যৌনাঙ্গের প্রদর্শন করতে বলা বা বাধ্য করা, শিশুকে পর্নো দেখানো, কোন শিশুর সাথে সত্যিকার অর্থে যৌন সঙ্গির মত আচরণ করা, শিশুর যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা বা দেখা বা শিশু পর্নো তৈরী করা এবং শিশুদের যৌনতামুলক সেবা বিক্রয় করা।

শিশু যৌন নির্যাতনের প্রভাবের মধ্যে লজ্জা ও আত্মগ্লানি, হতাশা, দুশ্চিন্তা, ট্রমা পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, আত্মসম্মানের অভাব, যৌন অক্ষমতা, প্রজনন অঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা, আসক্তি, নিজেকে আঘাত করা, আত্মহত্যার প্রবণতা, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, পরবর্তীতে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা, প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর পুনরায় উক্ত ঘটনা ঘটানো/ঘটনার শিকার হওয়ার প্রবণতা, বুলিমিয়া নার্ভোসা এবং শিশুর শারীরিক আঘাতও হতে পারে অন্যান্য সমস্যারগুলোর একটি।আত্মহত্যার প্রচেষ্টার ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাবক হল শিশু যৌন নির্যাতন।নির্যাতিত হওয়ার অনেক বছর পরেও নির্যাতিতের মাঝে অধিকাংশ ক্ষতিই দৃশ্যমান থাকে।পারিবারিক সদস্যদের মাধ্যম দ্বারা যৌন নির্যাতিত হলে লম্বা সময়ের জন্যে মানসিক ট্রমাসহ ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পাড়ে।

বিশ্বে ১৮ থেকে ১৯% মহিলা এবং ৮% পুরুষ তাদের শৈশবকালে যৌন নির্যাতিত হওয়ার কথা প্রকাশ্যে এনেছে।মেয়েদের উচ্চমাত্রায় নির্যাতিত হওয়া বা ছেলেদের যৌন নির্যাতনের কথা প্রকাশ্যে না আনার প্রবনতা বা উভয় কারণের জন্য লিঙ্গ বৈষম্যই মূলত দায়ী। অধিকাংশ শিশু যৌন নির্যাতনকারী নির্যাতিতের পূর্বপরিচিত; ৩০% নির্যাতনকারী খুব নিকট আত্মীয় এমনকি কাকা, মামা অথবা কাজিনও হতে পারে; অন্যান্য ৬০% পরিচিতের মধ্যে পারিবারিক বন্ধু অথবা প্রতিবেশী হতে পারে; এছাড়া মাত্র ১০% নির্যাতনকারী অপরিচিত হয়ে থাকে। অধিকাংশ শিশু যৌন নির্যাতন পুরুষের দ্বারা হয়ে থাকে; মহিলাদের দ্বারা সংঘটিত নির্যাতনের ১৪% মেয়েদের প্রতি এবং ৬% ছেলেদের প্রতি হয়ে থাকে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।

বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, কোন প্রতিষ্ঠানে কোন মহিলা কর্মীর সাথে তার পদমর্যাদা বা অবস্থান নির্বিশেষে, একই প্রতিষ্ঠানে কোন ব্যক্তি এমন কোন ব্যবহার করতে পারবে না যা অশোভনীয় বা সেই মহিলা শ্রমিকের শালীনতা কে হানি করে। ২০০৯ সালে মে মাসে পূর্ববর্তী ২০০৮ সালের পিটিশন নং ৫৯১৬ এর শুনানিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট যৌন হয়রানি বিষয়ক বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করে এবং নিয়োগকর্তাদের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। যৌন হয়রানি বিষয়ক নির্দেশিকা সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা আবশ্যক এবং যৌন হয়রানি বিষয়ে শুরু থেকে শেষ অবধি এবং প্রতিকূল পরিবেশে শ্রমিককে ধারণা প্রদান করতে হবে। এই নির্দেশিকা যৌন হয়রানি অপরাধের প্রতিরোধ সংক্রান্ত পদক্ষেপসহ সচেনতা বৃদ্ধি এবং ব্যাপকভাবে নারী-পুরুষের সমান অধিকার এবং যৌন অপরাধ সম্পর্কে আইনি বিধানমালা প্রচার করার কাজ চিহ্নিত করে থাকে। এছাড়াও এই নির্দেশিকার মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, অভিযোগ প্রক্রিয়া সহ কর্মস্থলে একটি অভিযোগ কমিটির প্রতিষ্ঠা এবং ফৌজদারি মামলা সমুহের বিবরনিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি অবৈধভাবে তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তার শরীরের যে কোন অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোন নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোন নারীর শ্লীলতাহানি করেন তা হলে তার এই কাজ হবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন তিন বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন।
লেখক: কলামিস্ট, সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়



 

Show all comments
  • md anwar ali ৬ অক্টোবর, ২০২০, ৮:২৯ এএম says : 0
    পবিত্র কুরআনী আইন ব্যতি রেখে অতীতেও নারী নির্যাতন কখনও বন্ধ হয়নি ভবিষ্যতেও বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষন দেখিনা।
    Total Reply(0) Reply
  • Shahjahan Sarkar ৭ অক্টোবর, ২০২০, ৮:২৫ পিএম says : 0
    মৃত্যুদণ্ড, ক্রস ফায়ার অথবা মাথা পর্যন্ত মাটিতে গেড়ে পাথর মেরে হত্যা করে এই যুগে বিচার হয় না আধুনিক দুনিয়াতে বিচারের ও ধারা পাল্টিয়েছে I আজকের বিচার যেই ভাবে হয় তাহলো যেমন: ফ্রান্সে ১৫ থেকে ৩০ বছরের কারাদন্ড, বিশেষ ক্ষেত্রে আজীবন কারাদন্ড দেওয়া হয় I ধর্ষককে।শাস্তি হিসেবে ইসরায়েলে কমপেক্ষ ১৬ বছর কারাদন্ড, যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ আমৃত্যু কারাদন্ড, ভারতে ১০-১৪ বছর কারাদন্ড এবং বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় ধর্ষককে। রাশিয়ায় ধর্ষণের শাস্তি তিন থেকে ২০ বছর কারাদন্ড, নরওয়েতে চার থেকে ১৫ বছর কারাদন্ড। যৌন নিগ্রহ অথবা খুন এর বিচার ২১ শতাব্দীর এই ভাবেই হয় হত্যা যা দিয়ে নয় I
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন