Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কিশোর অপরাধ রোধে দরকার সকলের সচেতনতা ও সক্রিয়তা

মো. সাইফুদ্দীন খালেদ | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০২০, ১২:১৮ এএম

শিশু-কিশোররাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির উন্নতি। সেই শিশু-কিশোরদের যথোপযুক্ত ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য পরিবার, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র সঠিক কর্মপন্থা ও নীতি আজও নিরূপণ করতে পেরেছে কি? শিশুরা ভুল করবে, এটা স্বাভাবিক। ভুল করতে করতেই তারা শিখবে জীবনে চলার পথে। হাঁটতে গিয়েও তো তারা ভুল করে পড়ে যায়, তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু এ ভুলের মাত্রা কতটুকু ধরে নেব আমরা? উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে বখাটেপনা এবং নিত্য নতুন অপরাধ প্রবণতা মাথাচড়া দিয়ে উঠছে ক্রমেই। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, বস্তির প্রসার ও অপরিকল্পিত নগরায়ন, যৌথ পরিবার প্রথার বিলুপ্ত, যথাযথ অভিভাবকত্ব না থাকা এবং সামাজিক অস্থিরতা ও অবক্ষয় তাই সমস্ত অপরাধ এবং বখাটেপনার সৃষ্টি করছে। ছেলে-মেয়ে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাওয়া এবং বখে যাওয়ার পেছনে অভিভাবকরাই অনেকাংশে দায়ী। তাদের উদাসীনতা এবং আস্কারাতেই সন্তানরা বখাটে হয়ে যাচ্ছে। পত্রিকার প্রতিবেদন মোতাবেক, দেশের বিভিন্ন স্থানে সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›দ্ব, রাজনৈতিক গ্রæপিং এবং প্রেম-মোবাইল-প্রতিহিংসার কারণে কিশোররা পর্যন্ত হামলা, নির্যাতন, হত্যা, অপহরণ, ছিনতাই প্রভৃতি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন এবং পরিবারের শান্তি-স্বস্তি বিনষ্ট হওয়া ছাড়াও সমাজে নৈরাজ্য ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। বিশেষত সা¤প্রতিককালে কিশোর অপরাধ দেশে একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা দল বাঁধছে এবং এক দল অন্য দলের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে। খুনের মতো সহিংসতায় মেতে উঠতে তাদের বাধছে না। তেরো-চৌদ্দ থেকে ষোলো-সতেরো বছরের কিশোররা এসব করছে।

আবার শিশুদের প্রতি অনাকাক্সিক্ষত আচরণ ক্রমান্বয়ে তাদের অপরাধে জড়িয়ে ফেলে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই শিশু-কিশোররা নানারকম বাজে আচরণ কিংবা দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে থাকে। যেমন স্কুলে কোন ছেলেকে কেউ মারধর করলে শিশুর মননে ক্ষোভের জন্ম নিতে পারে। এক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষেরই উচিত যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। পরিবারেরও এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়ে তথা কিশোর-কিশোরীদের চলাফেরা, আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথাবার্তা, লিঙ্গভেদে পোশাকের তারতম্য, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়ে অভিভাবক মহল সচেতন না হওয়ায় তারা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। সন্তান কোথায় যায়, কী করে, সময়মতো ক্লাসে গেলো কি না, ক্লাস শেষে সময়মতো বাসায় ফিরলো কি না, আবার স্কুলে গেলো ঠিক কিন্তু মিথ্যা কোনো কারণ দেখিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে গেলো কি না, কাদের সাথে বন্ধুত্ব করছে, আড্ডা দিচ্ছে এসব খোঁজ খবর রাখা দরকার বাবা-মার। আবার অতি আদরের নামে সন্তানের আবদার রাখতে গিয়ে এমন কিছু জিনিস তাদের দিয়ে দেয়া হয় যার দ্বারা সে খারাপ পথে চলে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় স্মার্টফোনের কথা। এছাড়া সন্তানের চুলকাটা, নখ কাটা, রুচিশীল ও ভদ্রোচিত পোশাক পরা এসব বিষয়েও বাবা-মার খেয়াল রাখা উচিৎ। এখনকার কিশোর-তরুণ সমাজ কিংবা বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে বলে মনে হয়। তবে পরিহাস করে বলতে হয়, এখন বুক বা বই একটা পড়ছে আর সেটা হচ্ছে ‘ফেসবুক’! প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব যে কত ভয়ানক হতে পারে তা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিশু-কিশোররা এখন আর মাঠে খেলা করতে যায় না, পার্কে বিনোদনের জন্য যায় না, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যায় না কিংবা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সরাসরি দেখা করি না। এখন সব ফেসবুকেই সেরে ফেলছি! বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ইউটিউবের ন্যায় গণমাধ্যমগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। তাই উক্ত গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে কুরুচিপূর্ণ যৌন আবেগে ভরপুর ম্যাগাজিন ও পত্রিকা কিশোর-কিশোরীদের মন-মানসিকতার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশু অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার ও সংশোধনের জন্য পৃথক আদালত ও সংশোধনাগার আছে। শিশুদের বয়স বিবেচনায় নিয়ে শিশু ও কিশোর অপরাধের বিচার ও সংশোধন করার জন্য এ ব্যবস্থা। আমাদের দেশে শিশুদের জন্য পৃথক বিচার ব্যবস্থার সূচনা ১৯৭৪ সাল থেকে। ১৯৭৪ সালের শিশু আইন ও ১৯৭৬ সালের শিশু নীতিই আমাদের প্রথম আইন ও বিধি। এর পর থেকে বিভিন্ন আইনে শিশুদের কথা বলা আছে। কিন্তু শিশুদের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন ১৯৭৪ সালের আইনটিই। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়ে আরো পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করে। বাংলাদেশ মূলত ১৯৮৯ সালের শিশু অধিকার সনদে সাক্ষর করার মাধ্যমে শিশু বা কিশোর অপরাধ ও বিচার ব্যবস্থার ওপর জোর দেয়। অর্থনৈতিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে কিশোর অপরাধের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। দরিদ্রতার কারণে মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে কিশোররা বিভিন্ন প্রকারের অপরাধে লিপ্ত হয়ে থাকে। কিশোর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে পারিপার্শিক সামাজিক পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম বিধায় আবাসিক পরিবেশ, সঙ্গীদের প্রভাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা ইত্যাদি উপাদানগুলো শিশু-কিশোরদের আচরণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উত্তম স্থান হলো পরিবার। জন্মের পর শিশু পারিবারিক পরিবেশে মাতা-পিতার সংস্পর্শে আসে। শিশুর সামাজিক জীবনের ভিত্তি পরিবারেই রচিত হয়। তাই তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। পরিবারের কেউ অপরাধ প্রবণতার সাথে যুক্ত থাকলে শিশু-কিশোররাও তাতে প্রভাবিত হয়। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে পরিবার, সমাজের মুরব্বি, শিক্ষক-শিক্ষিকা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিডিয়াসহ প্রত্যেকের সচেতনতা ও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কিশোর-অপরাধ
আরও পড়ুন