মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
মাত্র ১২ বছর বয়সে দেভাজাম্মানি মহীশূরের রাজপরিবারে বৌ হয়ে আসেন ১৮০৫ সালে। তার সাথে বিয়ে হয়েছিল ১২ বছর বয়সী ওয়াদিয়ারের তৃতীয় রাজ বংশধর কৃষ্ণরাজার। দক্ষিণ ভারতের নতুন রাজা হিসাবে তখন সিংহাসনে বসেছেন কিশোর কৃষ্ণরাজা। আর তার স্ত্রী দেভাজাম্মানি নিজের অজান্তেই বিয়ের অল্প দিনের মধ্যে হয়ে উঠেছেন ছবির মডেল। গুটিবসন্তের নতুন টিকার প্রচারণার জন্য কাজে লাগানো হয়েছে তাকে। তাকে টিকার ‘মডেল’ করে একটি ছবি আঁকানোর উদ্যোগ নিয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
তখন গুটিবসন্তের চিকিৎসা খুবই নতুন। মাত্র ছয় বছর আগে ব্রিটিশ ডাক্তার এডওয়ার্ড জেনার এই রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু তার চিকিৎসা নিয়ে ভারতে তখন তৈরি হয়েছে রীতিমত সন্দেহ আর বিরোধিতা। এর একটা বড় কারণ, তখন উনবিংশ শতাব্দীতে উপমহাদেশে ব্রিটিশরা তাদের শাসনক্ষমতা কায়েম করতে শুরু করেছে। কিন্তু ব্রিটিশরা তখন ভারতীয়দের গুটিবসন্তের টিকা দিতে মরীয়া। তারা বিশাল অর্থব্যয়ে ভারতে বিরাট টিকাদান কর্মসূচি নিয়েছিল। তার সাফল্য কোনভাবে বাধাগ্রস্ত হোক তা তারা চায় না।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনীতি, ক্ষমতা আর যুক্তি খুবই সুদক্ষভাবে চতুরতার সাথে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর প্রথম টিকাদান কর্মসূচি চালু করতে সক্ষম হয় তাদের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ ভারতে। এতে জড়িত হন ব্রিটিশ চিকিৎসকরা, ভারতীয় টিকাদানকারীরা, প্রকল্পে যুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির মালিক এবং ভারতে ব্রিটিশদের বন্ধু রাজাদের। ওয়াদিয়ার রাজারা তখন ব্রিটিশদের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ, কারণ তিরিশ বছরের বেশি নির্বাসিত থাকার পর ওয়াদিরাররা আবার মহীশূরের রাজ সিংহাসন ফিরে পেয়েছেন ব্রিটিশদের সহায়তায়।
কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক ডক্টর নাইজেল চান্সেলার বলছেন ১৮০৫ সালের এই ছবি ভারতীয় এক রানির ব্রিটিশদের টিকাদান কর্মসূচির প্রচারণায় জড়িয়ে পড়ার রেকর্ড তো বটেই, পাশাপাশি সেসময় কীভাবে গুটিবসন্তের টিকা দেবার কাজ শুরু হয়েছিল তা জানার ক্ষেত্রে এই ছবির একটা বিশাল ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তেল রংয়ে আঁকা এই ছবি যখন ২০০৭ সালে নীলামঘর সদাবিতে বিক্রি হয়, তখন ধারণা করা হয়েছিল এটা ভারতীয় তিন নতর্কীর ছবি। পরে ডক্টর চান্সেলার তার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন এটি ওয়াদিয়ারের রানি দেভাজাম্মানির গুটিবসন্তের টিকা প্রচারণার ছবি। তিনি বলেন, ‘ছবির একদম ডানে দাঁড়িয়ে কনিষ্ঠ রানি দেভাজাম্মানি তার বাম হাতে যেখানে টিকা দেয়া হয়েছে সেদিকে ইঙ্গিত করছেন।’ ছবির একদম বামে যে নারী, চান্সেলারের ধারণা তিনি ছিলেন ওয়াদিয়ারের রাজার প্রথম স্ত্রী। তার নামও ছিল দেভাজাম্মানি। প্রথম স্ত্রীর নাকের নিচে এবং ঠোঁটের চারপাশে হালকা হয়ে যাওয়া চামড়ার রং থেকে বোঝা যায় তার ওপর গুটিবসন্তের প্রতিষেধক পরীক্ষা করা হয়েছিল।
তিনি বলছেন, সেসময় এই মারণব্যাধি প্রতিরোধের একটা চালু প্রথা ছিল এরকম - গুটিবসন্ত থেকে সেরে ওঠা রোগীর গুটি থেকে পুঁজ সংগ্রহ করা হতো। তারপর সেই পুঁজ শুকিয়ে, গুঁড়ো করে সেই কণাগুলো সুস্থ মানুষকে নাক দিয়ে টানতে বলা হতো। এতে সুস্থ মানুষ হালকাভাবে রোগাক্রান্ত হতো। এটা ছিল নিয়ন্ত্রিতভাবে সংক্রমণ ঘটিয়ে রোগ ঠেকানোর চিকিৎসা। প্রথম নারীর ঠোঁটের চারপাশে তারই চিহ্ণ।
গুটিবসন্তের প্রতিষেধক টিকা তৈরি হয়েছিল গরুর বসন্ত রোগের জীবাণু দিয়ে। মানুষ পশুর শরীরের রোগজীবাণু নিজের শরীরে নিতে চায়নি। আর যেসব ব্রাহ্মণ বসন্তের রোগজীবাণু সুস্থ মানুষের শরীরের ঢোকাতো তারাও জেনারের টিকার বিরোধী ছিলেন কারণ তারা বুঝেছিলেন এতে তাদের রুজিরোজগার হুমকির মুখে পড়বে। ‘উদ্বেগের সবচেয়ে বড় জায়গাটা ছিল গরুর দেহের রোগজীবাণু মানুষের শরীরে ঢোকানো,’ বলছেন অধ্যাপক বেনেট।
আরেকটা বড় সমস্যা ছিল টিকাদান পদ্ধতি নিয়ে। এই টিকা সবচেয়ে কার্যকরভাবে দেবার পদ্ধতি ছিল একজনের শরীর থেকে জীবাণু নিয়ে আরেকজনের শরীরে ঢোকানো। অর্থাৎ একজনের বাহুতে প্রথম এই টিকা দেয়া হবে। এর এক সপ্তাহ পর যখন সেখানে গরুর গুটিবসন্তে পুঁজ তৈরি হবে, তখন ডাক্তার ওই গুটি কেটে পুঁজ সংগ্রহ করে আরেকজনের শরীরে সেটা স্থানান্তর করবেন। এটাও মানুষের জন্য গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছিল।
এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ও জাতপাতের নারী পুরুষ নির্বিশেষে একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে জীবাণু ঢোকানোর ব্যাপারটা হিন্দুরা মেনে নিতে পারেনি। তারা মনে করেছিল এতে হিন্দুদের পবিত্রতা নষ্ট হবে। তাই ওয়াদিয়ারের রানি যখন এই টিকা নিলেন, তখন হিন্দু সম্প্রদায় আশ্বস্ত হয়েছিল এই ভেবে যে এতে হিন্দু রাজপরিবারের রক্ত যদি কলুষিত না হয়, আমারও তাহলে ভয়ের কারণ থাকবে না।
মহীশূরের রাজার মাতামহ লাকশ্মী আম্মানির স্বামী গুটিবসন্তে মারা গিয়েছিলেন। কেম্ব্রিজের ইতিহাসবিদ চান্সেলার মনে করেন টমাস হিকির আঁকা ছবিতে যে তিনজন নারী আছেন তাতে মাঝেরজন হলেন লাকশ্মী আম্মানি। তার মতে, ওই ছবিতে রাজ মাতামহের উপস্থিতিও তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, গুটিবসন্তের টিকা যে নিরাপদ এবং তা নিলে ভয়ের কারণ নেই, জনসাধারণকে সেই বার্তা দিতেই ছবিতে ওয়াদিয়ার রাজপরিবারের মাতামহকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হাজির করেছিল সফল প্রচারের কৌশল হিসাবে। এই ছবির কাজ সম্ভব হয়েছিল রাজপরিবারের শীর্ষপর্যায়ের এই নারীর উপস্থিতির কারণে। রাজা তখন নাবালক, তার আপত্তির কোন সুযোগ ছিল না, আর দুই রানিরও মাতামহের নির্দেশ অমান্য করার প্রশ্নই ছিল না।
অধ্যাপক বেনেট বলছেন ভারতের মানুষ ক্রমশ বুঝতে পেরেছিল টিকার উপকারিতা। এবং ঐ ছবির মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে ১৮০৭ সাল নাগাদ ভারতে দশ লাখ মানুষকে গুটিবসন্তের টিকা দেয়া সম্ভব হয়েছিল। আর কালের চক্রে একসময় হারিয়ে যাওয়া এই ছবি উদ্ধারের পর এই তিন রহস্যময়ী নারীকে এবং পৃথিবীতে প্রথম প্রতিষেধক টিকাদানের ইতিহাসে এই ছবির মূল্য যে কতটা তা উদঘাটন করেছিলেন ঐতিহাসিক নাইজেল চান্সেলার। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।