নারী দিবস ম্যারাথনে পাপিয়া চ্যাম্পিয়ন
‘নিরাপদ সমাজ, নিরাপদ নারী’-স্লোগানে অনুষ্ঠিত নারী দিবস রেগুলার ম্যারাথনে রেগুলার বাংলাদেশের পাপিয়া খাতুন চ্যাম্পিয়ন, হামিদা
আগেও অনেকবার এসেছেন এই মাঠে। দুই পায়ের যাদুতে মাতিয়েছেন গ্যালারি। হাজারো উল্লাসধ্বনিতে মুখর হয়েছে প্রিয় প্রাঙ্গণ। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের চেনা আঙিনায় শেষবারের মতো ফিরলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম খেলোয়াড়, জাতীয় দল ও ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাবেক তারকা স্ট্রাইকার এ, কে, এম নওশেরুজ্জামান। কিন্তু নিরব-নিথর হয়ে। দলকে অনেক জয়ের আনন্দে ভাসানো সদা হাসি-খুশি মানুষটি করোনাভাইরাসের বিপক্ষে লড়াইয়ে পেরে ওঠেননি। চলতি মাসের শুরুর দিকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন নওশের। খবর পেয়ে তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে গতপরশু রাত সাড়ে ৯টায় রাজধানীর কল্যাণপুরস্থ ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই গর্বিত সদস্য। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য আতœীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠন ও সংগঠকবৃন্দ।
গতকাল সকাল ১০টায় চির চেনা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রথম নামাজে জানাজা শেষে নওশেরের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় মুন্সিগঞ্জে। পিতার চাকরির সুবাদে সেখানেই জন্ম, বেড়ে ওঠা নওশেরের। তবে তার সর্বশেষ ঠিকানা হয়েছে চাঁদপুরের মতলবে নিজ গ্রামের বাড়িতে। বাদ আসর তৃতীয় ও শেষ জানাজার পর তাকে সম্মানসূচক ‘গার্ড অব অনার’ দিয়ে সেখানেই তার লাশ দাফন করা হয়। এসময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে চাঁদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সংস্থার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বাবু বলেন, ১৯৮২-৮৩ সালে চাঁদপুর জেলা ফুটবল লিগে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলেছেন। বিশেষ করে মোহামেডান আর পূর্ব শ্রীরামদী ক্লাবের পক্ষে নিয়মিত খেলেছেন। তিনি জানান, তারা দু’ভাই ফুটবলার। নওশের ভাই স্টাইকার হিসেবে খেলতেন এবং শরীফ ভাই মিডফিল্ডে খেলতেন। তারা দু’জনেই ঢাকার মোহামেডান ক্লাবে খেলেছেন। তার এই শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হবার নয়।
বাংলাদেশ ফুটবলের সোনালী সময়ের অন্যতম এক নায়ক ছিলেন এ, কে, এম নওশেরুজ্জামান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতে ১৬টি ম্যাচ খেলেছিল। ওই প্রীতি ম্যাচ থেকে পাওয়া অর্থ মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে জমা করেছিল তারা। স্বাধীনতার পর ঢাকা মোহামেডানের প্রথম লিগ শিরোপা জয়ের রূপকারও তিনি। ১৯৭৫ সালে ওই লিগে ২১ গোল করে নওশের পেয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য নওশের ছিলেন দেশসেরা স্ট্রাইাকারদের একজন। স্বাধীনতার আগে তিনি খেলেছেন রেলওয়ে, ওয়ারী, ফায়ার সার্ভিস ও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় খেলেছেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে ওয়াপদা ফুটবল দলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪, ঢাকা মোহামেডানে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত খেলেছেন নওশের। তিনি জাতীয় দলের সদস্য ছিলেন ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে দেশের হয়ে অনেক স্মরণীয় ম্যাচ খেলেন নওশেরুজ্জামান।
ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটেও নওশেরের ছিল সমান দাপট। তৎকালীন ঢাকা ক্রিকেট লিগে নিয়মিত খেলতেন তিনি। ফুটবলে তারকাখ্যাতি পেলেও ক্রিকেটার হিসেবেও পরিচিতি ছিল তার। ফুটবল খেলেন ১৪ বছর। তবে ক্রিকেট আরও বেশি- ১৭ বছর। প্রায়ই বলতেন, ‘আমি আসলে ফুটবলার নই, ক্রিকেটার।’ ১৯৭৪ সালে শুরু প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে। পঁচাত্তরে আসেন মোহামেডানে। ছিয়াত্তরে সাদা-কালো শিবিরের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তিনি! ক্রিকেটে ইতি টানেন ১৯৯০ সালে, ফুটবল ছাড়ারও ১০ বছর পর। ক্রিকেটে শেষ সাত মৌসুম কলাবাগানে খেলে পাঁচ বারই অধিনায়ক। ভিক্টোরিয়ায় ৩ বছর খেলে ২ বছর অধিনায়ক। অলরাউন্ডার নওশের মোহামেডান ছেড়ে গিয়ে মোহামেডানকে গুটিয়ে দেন ১১০ রানে।
ফুটবলার, ক্রিকেটার নওশের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এবং প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় দলের সদস্য ছিলেন। শেষ বিদায় বেলায় তার অনেক কিছু প্রাপ্য ছিল। কিন্তু নওশেরের শেষ বিদায়টা হলো বড়ই মলিন। যেন একটা দায়সাড়া গোছের আয়োজন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। জানাজায় প্রায় শ’খানেক মানুষের উপস্থিতি। যার অর্ধেক তার পরিবার ও আতœীয়-স্বজন। জাতীয় দলের সাবেক তারকা ফুটবলার আবদুল গাফফার নিজ উদ্যোগে নওশেরের লাশ নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) পক্ষে সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ আর নির্বাহী কমিটির দুই সদস্য ইকবাল ও অমিত খান শুভ্র এসেছিলেন। জানাজায় দেখা মেলে খেলার জগতের চেনামুখ বলতে শুধু স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গোলরক্ষক আবদুস সাত্তার, সাবেক তারকা ফুটবলার স্বপন কুমার দাস, শফিকুল ইসলাম মানিক, ইকবাল হোসেন ও অমিত খান শুভ্রর। নওশেরকে শেষ বিদায় জানাতে আসেননি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সতীর্থ জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরা, কাজী সালাউদ্দিন বা সাইদুর রহমান প্যাটেলরা। দুঃখজনক হলেও সত্য নওশেরের প্রথম জানাজায় দেখে মেলেনি ক্রিকেটাঙ্গনের কোন পরিচিত মুখের। সাবেক ফুটবলারদের প্রাণের সংগঠন ‘সোনালী অতীত’ ক্লাবেরও কেউ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আসেননি প্রিয় নওশের ভাইকে শেষ বিদায় জানাতে।
তবে এমন সাদামাটা আয়োজনে স্বল্প সংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে নওশেরের শেষ বিদায় দেখে হতাশ নয় তার পরিবার। তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। তাই তো নওশেরের বড় ভাই বদিউজ্জামান বললেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। উনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আমার ভাই অসুস্থ হবার পর প্রধানমন্ত্রী খোঁজখবর নিয়েছেন বহুবার। তার চিকিৎসার সমুদয় খরচ বহন করেছেন। আমাদের একটি পয়সাও খরচ করতে দেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ আন্তরিকতার কথা আমরা আজীবন মনে রাখব।’
তাকে মনে রেখেছেন আরো কয়েকজন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই খেলোয়াড়কে নিয়ে স্মৃতিচারণে একসময়ের সতীর্থদের চোখ ভিজে উঠল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তার জানাযায় অংশ নিতে এসে কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় আব্দুস সাত্তারের। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফুটবল দলের সেই সংগ্রামী দিনগুলোতে ফিরে গেলেন তিনি, ‘ভারতের ক্যাম্পে আমরা এক সঙ্গে ছিলাম। নওশের ভাই সবাইকে উৎসাহ দিতেন। হাসি-খুশি মানুষ ছিলেন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জন্য তার অবদান অনেক। তার অবদান ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সবসময় অনুপ্রেরণা দিতেন। সহযোগিতা করতেন। এই মাঠে উনি খেলে গেছেন। আজ এই মাঠেই তার জানাজা হচ্ছে। ভাবতেই খারাপ লাগছে।’ দেশের খেলাধুলায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বøু’ পদক পেয়েছিলেন তিনি। তবে একটি আক্ষেপ নিয়েই পরপারে পাড়ি জমালেন নওশের। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ ছিল ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা নওশেরের। সে হতাশা নিয়েই চিরবিদায় নিলেন তিনি। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সতীর্থ আব্দুল গাফফারের কথাতেও উঠে এলো সেই আক্ষেপ, ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল স্বীকৃতি পায়নি; এ নিয়ে অনেক আক্ষেপ ছিল তার। আর তা না দেখেই চলে যেতে হলো তাকে।’
তারপরও খেলার জগতের এ সব্যসাচী নক্ষত্রকে ভুলবে না এ দেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।