পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার ইংরেজি ‘ডেইলি স্টারের’ প্রথম পৃষ্ঠায় চতুর্থ কলামে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। সংবাদটির শিরোনাম, OC Pradeep’s clip viral with torture claim. অর্থাৎ ‘নির্যাতন সম্বলিত ওসি প্রদীপের ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল।’ কোনোরূপ মন্তব্য ছাড়াই আমরা ঐ সংবাদটির হুবহু বাংলা অনুবাদ নিচে তুলে দিচ্ছি।
‘সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। ঐ ভিডিওতে দেখানো হয়েছে যে, রিমান্ডে থাকাকালে সাসপেন্ডেড ওসি প্রদীপ এবং ইন্সপেক্টর লিয়াকতকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই ভিডিওতে তারা কাকে যেন স্যার বলছেন। ২ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের ঐ ভিডিওতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মামলায় অভিযুক্তরা বলছেন যে, র্যাবের কাস্টডিতে থাকাকালে তাদের কাপড় চোপড় খুলে ফেলা হয়, প্রহার করা হয় এবং শরীরে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয়।
বাহ্যিকভাবে মনে হয় যে, এই ক্লিপটি একটি পুলিশ ভ্যানে ধারণ করা হয়েছে। প্রদীপ এবং লিয়াকতের হাতে হাতকড়া লাগানো ছিল। তারা ফোনে কথা বলছিল এবং কাকে যেন ‘স্যার’ বলছিল। এটি পরিষ্কার নয় যে, ভিডিওটি কে ধারণ করলো এবং দুই জন আসামি একটি পুলিশ ভ্যানে মোবাইল ফোন পেল কীভাবে?
‘স্যার আপনাকে এটা দেখতে হবে। ওরা বলছে যে আমাদের বিরুদ্ধে আরও অনেক মামলা বিভিন্ন স্থানে দায়ের করা হয়েছে এবং র্যাব এসব মামলার তদন্ত করবে। প্রদীপ বলে যে, ওরা আবার আমাদেরকে নেবে এবং আমাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে।’
‘এরপর তিনি (প্রদীপ) বেশ কয়েকজন র্যাব অফিসারের নাম বলেন এবং বলেন যে, একজন চিকিৎসকের উপস্থিতিতে তাকে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হয় যাতে করে কোনো ক্ষতচিহ্ন না থাকে।’
অনুরূপভাবে লিয়াকতকে বলতে দেখা যায়, ‘স্যার ওরা আমাদেরকে মারাত্মকভাবে যখম করেছে। আপনি হয়তো র্যাবের ডিজির কাছে আমাদের ছবি দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের কাছে এসেছিলেন এবং আশ্বাস দিয়েছেন যে আমাদের কিছু হবে না। কিন্তু আমাদেরকে নির্যাতন করেছেন র্যাবের এডিজি। তারা সারারাত আমাদেরকে নগ্ন রাখে এবং প্রশ্ন করে যে, কেন আমরা ছবি তুলেছি। পরদিন তারা আমাদেরকে প্রহার করে, ইনজেকশন পুশ করে এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়।’
মেজর (অব.) সিনহার হত্যাকান্ডের পর তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনায় প্রদীপসহ পুলিশের বিরুদ্ধে ৭টি মামলা করা হয়েছে। র্যাব নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কেমন করে পুলিশ ভ্যানে ভিডিও ক্লিপ ধারণ করা হলো, সেটি জানার জন্য র্যাবের মিডিয়া উইং প্রধান পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
পুলিশ হেড কোয়ার্টারে মিডিয়া প্রধান সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল সোহেল রানা ডেইলি স্টারের ফোন কলের কোনো উত্তর দেন নাই।
দুই
ডেইলি স্টারের রিপোর্টের একটি বর্ণও আমরা পরিবর্তন করি নাই। এক মাসেরও বেশি সময় হলো মেজর সিনহা নিহত হয়েছেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ জানিয়েছেন যে, সেনাবাহিনী তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে তদন্ত করছে। র্যাবও তদন্ত করছে। যেহেতু এই হত্যাকান্ড তদন্তাধীন সেজন্য আমি এই বিষয়টি নিয়ে এতদিন লিখিনি। কিন্তু ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোতে এই রিপোর্ট পড়ার পর এবং ইউটিউবে সেটি দেখার পর স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন আসে, আসামিরা যেখানে কাস্টডিতে আছে সেখানে তাদের হাতে মোবাইল ফোন কীভাবে আসে? কীভাবে প্রিজন ভ্যানে তাদের সংলাপ ধারণ করা হয়? যে ‘স্যারের’ সাথে প্রদীপরা কথা বলেছেন তিনি বা তাঁরা কে বা কারা? র্যাব হোক বা পুলিশ হোক এসব প্রশ্নের উত্তর তাদেরই খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এটি প্রয়োজন পুলিশ বা র্যাবের ইমেজের স্বার্থে। প্রয়োজন ন্যায় বিচারের স্বার্থে। দেশের ইমেজের স্বার্থে।
এবার যাচ্ছি আরেকটি নৃশংস ঘটনার দিকে। সেটি হলো, ইউএনও ওয়াহিদা খানমের নৃশংস হত্যাচেষ্টা। সারাদেশ এই বিভৎস হামলায় ক্ষুব্ধ এবং ব্যথিত। পত্রপত্রিকায় তার যতটুকুই প্রকাশ ঘটুক না কেন, এই কয়েকদিন যে কয়জন ব্যক্তির সাথেই কথা হয়েছে, তারা সকলেই দোয়া করেছেন, আল্লাহতাআলা যেন ইউএনও ওয়াহিদাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু সন্দেহভাজন যে ৬ জনকে এই নারকীয় হামলার দায়ে গ্রেফতার করা হয় তাদের ৩ জন বললো যে, চুরি করার জন্য ইউএনও’র বাসায় ঢুকেছিল, আর ওমনি সে কথায় র্যাব বিশ্বাস করলো এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে সেটি জানিয়ে দিল? একই নিঃশ্বাসে তারা বলে যে, অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন আছে। তাহলে সেই তদন্ত না করেই প্রেস ব্রিফিং করতে হলো কেন? কোনো মানুষই বিশ্বাস করেনি যে চুরি করার জন্য এই হামলা করা হয়েছে।
গত শনিবার বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে, হামলা ছিল পরিকল্পিত। সমিতির সভাপতি হেলালুদ্দিন আহমদ বলেন, কোনো কোনো মহল ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য বিচ্ছিন্ন ও চুরির ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার অপপ্রচার চালাচ্ছেন। সমিতি মনে করে যে, এটি কোনো চুরির ঘটনা নয়। কারণ দুর্বৃত্তরা কোনো জিনিস চুরি করেনি বা খোয়া যায়নি। এটি একটি পরিকল্পিত আক্রমণের ঘটনা এবং এর সাথে আরও অনেক ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে। সচিব হেলালুদ্দিন বলেন, ওয়াহিদা খানম একজন সৎ ও নির্ভীক অফিসার। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল বেআইনী তদবিরে ব্যর্থ হয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত করলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসতে পারে।
তিন
যেদিন বলা হয়েছে যে, চুরির জন্যই এই হামলা হয়ে থাকতে পারে, সেদিনই অর্থাৎ ৪ সেপ্টেম্বর ঐ এলাকার আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি শিবলী সাদিক স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক জাহাঙ্গীর হোসেনের ছত্রছায়ায় ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার সব কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে। হাকিমপুর, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট আসনের এমপি শিবলী সাদিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আসাদুল, জাহাঙ্গীর ও আরও একজন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় সন্ত্রাস ও মাদকের বিস্তারের একাধিক মামলা রয়েছে। এ কারণে তাদের দল থেকে বহিষ্কারের জন্য আমি আড়াই থেকে তিনমাস আগে যুবলীগকে জানাই। স্থানীয় নেতাদের ও সেন্ট্রাল নেতাদের একাধিকবার জানাই। স্থানীয় পর্যায় থেকেও জেলা কমিটিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত চিঠির কোনো রিপ্লাই আসেনি।’
ঐ এলাকার খোদ আওয়ামী লীগের এমপি শিবলী সাদিক বলেন, এরা মাদকাসক্ত। একাধিক মামলার আসামি। জাহাঙ্গীর, আসাদুল, নান্নু-এরা একই গ্রুপে চলাচল করে। জমিজমা কেনা সংক্রান্ত বিশেষ করে ওসমানপুর কেন্দ্রিক বিষয়ে তাদের অনেক দৌরাত্ম্য। আমি একাধিকবার তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দিয়েও জবাব পাইনি। ঘোড়াঘাটের এই এমপি কোনো রাখঢাক না করে প্রশ্ন করেন, ইউএনও’র ওপর হামলার এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ পরিবারের ওপর যে কাদা লেগে গেল, এর জবাব কে দেবে? যারা দায়িত্বে আছেন তাদেরকেই দিতে হবে।
দিনাজপুর জেলা যুবলীগ সভাপতি রাশেদ পারভেজ বলেন, গত ৭ জুন স্থানীয় সংসদ সদস্য শিবলী সাদিকের ডিও সহ অভিযুক্ত যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই চিঠির কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহবায়ক নিরূপ সাহা জানান, জাহাঙ্গীর হোসেন উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে জেলা যুবলীগের কাছে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
ইত্যবসরে ওয়াহিদার ওপর এই বর্বরোচিত হামলার পর তার সম্পর্কে যেসব খবর আসছে সেগুলি বেশ ইতিবাচক। খবরে প্রকাশ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ওয়াহিদা খানম মাদকবিরোধী বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানের ফলে জাহাঙ্গীর হোসেন, আসাদুল হক প্রমুখ স্থানীয় নেতারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এমপি শিবলী সাদিক অভিযোগ করেন যে, জাহাঙ্গীরের দল ঘোড়াঘাটে মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটি প্রতিরোধের জন্য এমপি শিবলী সাদিক নাকি ইউএনও ওয়াহিদার সাথে বৈঠকও করেন। এসব কারণে স্থানীয় যুবলীগ নেতারা ইউএনও’র ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।
ঘোড়াঘাট এলাকায় খাস জমি দখলের জন্য নাকি একটি চক্র গঠিত হয়। কট্টর আওয়ামী লীগ পন্থী একটি দৈনিক নিউজ পোর্টালের ৫ সেপ্টেম্বরের খবর মোতাবেক, এই চক্রের হোতা ছিলেন স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান এবং যুবলীগ সভাপতি। এরা খাস জমি দখল করে বেশি দামে বিক্রি করতো। এর মাধ্যমে তারা ভালো টাকা পয়সা কামাই করছিল। খাস জমির এই অবৈধ দখলে নাকি বাঁধ সাধেন ইউএনও। ফলে উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এসব কারণ হামলার পেছনে কোনো ভূমিকা রেখেছিল কিনা সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। চুরির যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ কোনো কিছু চুরি বা খোয়া যায়নি। তাছাড়া এক জন সৎ ইউএনও’র বাসায় মহামূল্যবান কিছু থাকার কথা নয়। তদন্ত টিম এসব বিষয় আমলে নেবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।