পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভয়াবহ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদপত্র। এর এখন টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। অনেক আগে থেকে সংকটে নিপতিত হলেও করোনা মহামারি এই সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে। একজন সাধারণ মানুষও বুঝে সংবাদপত্র ভাল নেই। কারণ, তারা দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলো হাতে নিলেই বুঝতে পারে আগে এগুলো কেমন ছিল, আর এখন কেমন আছে। গতকাল পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব-এর বিবৃতিতে দেশের সংবাদপত্রের করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, করোনার কারণে সব ধরনের পত্রিকার বিক্রি সংখ্যা কমে গেছে। পত্রিকা বিক্রি কমেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। পত্রিকার আয়ের মূল উৎস যে বিজ্ঞাপন, তার আয় নেমে এসেছে এক চতুর্থাংশে। কোনো প্রতিষ্ঠানের আয়ই যদি কমে যায়, তাহলে সে প্রতিষ্ঠান চলবে কি করে? একটি পরিবারের আয় কমে গেলে, সে পরিবারের কী অবস্থা হয়, তা বোধকরি ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ জানে না, কেউ বুঝতেও পারে না। সংবাদপত্র একটি বিশাল পরিবার। এখানে অসংখ্য সংবাদকর্মী দেশ ও জনগণের কল্যাণে সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে নিবেদিত হয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষও রাষ্ট্রের কল্যাণে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ব্যয় সংকোচনের পন্থা অবলম্বন করে পত্রিকার পৃষ্ঠা কমানো, ছাপার সংখ্যা কমানো, প্রশাসনিক ব্যয় কমানোর প্রক্রিয়া অবলম্বন করে টিকে থাকার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। কোনো কোনো সংবাদপত্র বন্ধও হয়ে গেছে।
করোনা যেমন দেশের বিভিন্ন শিল্পখাতে আঘাত হেনেছে, তেমনি পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশন মিডিয়ায়ও আঘাত হেনেছে। আয়ের উৎস কমে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠান চালানো এবং সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সরকার করোনার শুরুতে দেশের গার্মেন্ট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কৃষিসহ অন্যান্য খাতে প্রায় এক লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনামূলক প্যাকেজ ঘোষণা করে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। দুঃখের বিষয়, সংবাদপত্র শিল্প যা কিনা রাষ্ট্রের সকল স্তরের সংবাদ পরিবেশন করে সরকারকে সহায়তা করছে, এ খাতে কোনো সহায়তা দেয়া হয়নি। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে করোনা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যাসহ সব ধরনের সংবাদ পরিবেশন করে সরকারকে সহায়তা করছে। এসব তথ্য ও সংবাদের ভিত্তিতে সরকারের নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা করণীয় এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। সরকারের নেয়া সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ সংবাদপত্র বিরতিহীনভাবে প্রকাশ করে চলেছে। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমই যদি না থাকে, তাহলে সরকারের এসব কর্মকান্ড কে তুলে ধরবে? এ মাধ্যমের যেসব সিনিয়র সাংবাদিক রয়েছেন, তারা প্রতিনিয়ত দেশের কল্যাণে সরকারকে সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তারা একেকজন ‘স্টলওয়ার্ট’ হয়ে রাষ্ট্র ও সরকারকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। এতে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটি সহজ হয়ে যাচ্ছে। এসব সিনিয়র সাংবাদিক এবং পুরো সংবাদশিল্প আজ এক বিপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত আজ তিলে তিলে শেষ হওয়ার পথে। মালিক পক্ষ সংবাদপত্রের এই দুর্দশার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবী নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কাছে পেশ করেছেন। মালিক পক্ষ বলেছেন, এই সংকটময় মুহূর্তে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সংবাদপত্রশিল্পের টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কিছু বকেয়া বিল পরিশোধের পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সংবাদপত্রের যেসব খাত রয়েছে, সরকার যদি সেসব খাতের দিকে একটু দৃষ্টি দেয়, তাহলেও এ শিল্পের অস্তিত্ব কিছুটা হলেও সংরক্ষিত হবে। য়দি সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ, নিউজপ্রিন্ট আমদানির ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাদ, বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ এবং উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশের বদলে অগ্রিম কর শূন্য শতাংশ করা হয়, তাহলে সংকটের মধ্যেও এ শিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব। দুঃখের বিষয়, সংবাদপত্র একটি সেবামূলক খাত হওয়া সত্তে¡ও সরকারের কাছ থেকে এ ধরনের সুবিধা পাচ্ছে না। এবারের বাজেটে সকল শিল্পের জন্য ২.৫ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স কমানো হলেও সংবাদপত্র শিল্পের এই ট্যাক্স ৩৫ শতাংশই রয়ে গেছে। এটা এটা রীতিমতো দ্বৈতনীতি। বলার অপেক্ষা রাখে না, সংবাদপত্র এখন যে চরম সংকটে রয়েছে, তাতে করপোরেট ট্যাক্সসহ অন্যান্য ট্যাক্স বাদ বা ন্যূনতম পর্যায়ে না আনলে এই খাত টিকবে না। আমরা মনে করি, সরকারও চায় সংবাদপত্র শিল্প ও গণমাধ্যম টিকে থাকুক। কারণ, বর্তমান সরকারের সময়েই এই শিল্পের সবচেয়ে বেশি বিকাশ ঘটেছে। সরকারের সদিচ্ছার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। এই শিল্প যে শুধু সেবামূলক তা নয়, এর মাধ্যমে হাজার হাজার সংবাদকর্মীর কর্মসংস্থান যেমন হয়েছে, তেমনি দেশ ও জাতির সার্বক্ষণিক কল্যাণে তারা নিয়োজিত রয়েছে। দেশের যে কোনো ক্রান্তিকালে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমই মূল সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শিল্প যদি না থাকে, তবে দেশ ও জাতি এক অন্ধকার পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সংবাদশিল্পের অবাদ সম্প্রসারণে সরকারের সদিচ্ছার সুযোগে কিছু ভুঁফোড় সংবাদপত্রও প্রকাশিত হচ্ছে, যেগুলোর প্রচার সংখ্যা বলতে কিছু নেই এবং দেশের কল্যাণের ক্ষেত্রেও কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। দেখা যাচ্ছে, এসব সংবাদপত্রও এক ধরনের দুষ্টক্ষত হয়ে সরকারের বিজ্ঞাপনে ভাগ বসিয়ে প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রের আয়ের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।
বর্তমানে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে যে দুর্দিন চলছে, তা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। অথচ এ শিল্পটিকে রাষ্ট্র ও সরকারের স্বার্থে টিকিয়ে রাখা অপরিহার্য। সরকারের মধ্যে হয়তো অনেকে এমন মতামত পোষণ করতে পারে, সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। তাদের এ ধারণা ভুল এবং আত্মঘাতী। যুগে যুগে দেশ ও জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সংবাদপত্র ‘রাডার’ হয়ে পথ দেখিয়েছে। সঠিক পরামর্শ ও করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিয়ে জাতিকে সহায়তা করেছে। সংবাদপত্র যে কোনো দেশের জন্য অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে। তার এমন দুর্দশা ও অস্তিত্বের সংকট কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এতে কর্মরতরা মানবেতর দিনযাপন করছে। সাংবাদিকতা পেশাই এখন মারাত্মক হুমকির মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এ বিষয়গুলো সরকারের অজানা নয়। আমরা মনে করি, সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম তুলে ধরা থেকে শুরু করে বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা সম্প্রসারণে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম যে অসামান্য ভূমিকা পালন করে চলেছে তাতে তার অস্তিত্ব সংকট দূর করতে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এ শিল্পের সকল সমস্যা নিরসনে এবং মালিকপক্ষ যেসব প্রস্তাব ও দাবী পেশ করেছে তা বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।