Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূূলক শাস্তিই এ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে পারে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনা বিশেষ করে প্রতারণা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, দুর্নীতি, খুন, ছিনতাইয়ের ঘটনা দেশের সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। গত ৩১ জুলাই টেকনাফ থানা ওসির নির্দেশে বা প্ররোচণায় গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবরসপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। টেকনাফ থানা থেকে প্রত্যাহৃত এবং গ্রেফতারকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দফায় দফায় পার পেয়ে গেলেও এবার আর তার শেষ রক্ষা হয়নি। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, প্রতারণা, দুর্নীতি ও জালিয়াতিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা প্রদীপ দাশ করেনি। মাদক নির্মূলের ওসিলায় ক্রসফায়ারের নামে কিলিং, লোকজনকে জিম্মি করে অর্থ আদায়, ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগও রয়েছে প্রদীপের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে, রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সে শতশত কোটি টাকা আয় করেছে। চট্টগ্রাম কতোয়ালী থানায় এসআই, পদে চাকরি করাকালীন সময়ে নগরীর পাথরঘাটার এক হিন্দু মহিলার জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত ৩ বছরে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বন্দুক যুদ্ধে ২০৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানা যায় সংবাদ মাধ্যমে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে তার কৃত কার্যকলাপে পুলিশ বাহিনীর ভাবমর্যাদা বিনষ্ট হয়েছে, এটা নিশ্চিত বলা যায়। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, ১৯৯৫ সালে পুলিশের চাকরিতে যোগদান করার পর আজ পর্যন্ত প্রদীপ দাশ শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে। কেন এতদিন পর্যন্ত তা খতিয়ে দেখা হয়নি, কেন তার বিরুদ্ধে অপকর্ম বা অপরাধের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদান করা হয়নি? যদি তা করা হতো তাহলে প্রদীপ এত বাড়াবাড়ির সুযোগ পেত না। এটা কি অস্বীকার করা যায় যে, প্রদীপসহ কিছু অসাধু অসৎ পুলিশ কর্মকর্ত-কর্মচারীর কারণে দেশের পুলিশ বাহিনীর ভাবমর্যাদা বিনষ্ট হচ্ছে।

অমানবিক ঘটনা দেশের প্রায় সর্বত্রই অহরহ ঘটছে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য বা দাবি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন অবনতি ঘটেনি, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। তাদের মতে, জড়িতদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, বিচারও হবে। কেউই ছাড় পাবে না। বিচারের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। বাংলাদেশ হাইকোর্ট-মন্তব্য: দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীরা বরগুনা জেলা শহরে একজনকে কুপিয়ে মারলো, উপস্থিত জনগণ সে দৃশ্য দেখে ভিডিও করলো কিন্তু কেউ বাধা দিল না বা যুবককে বাঁচাতেও এগিয়ে এলো না। সমাজটা কোথায় যাচ্ছে?

হ্যাঁ, আমরাও বলি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এত অবনতির কারণ কী? কেন আজ কিছু মানুষ অমানুষের মতো অপরাধ করে চলেছে। দেশে একটা সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও কেন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টির চেষ্টা চলছে? মানুষ নামের এসব নরপশুদের দৃষ্টান্তুমূলক শাস্তির ব্যবস্থা কি করা যায় না? যাতে অন্যরা এ জাতীয় অপরাধ করতে সাহস না পায়।

রাজধানী ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া বেশ ক’টি খুন, অপহরণ, ছিনতাই, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডই প্রমাণ করে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি সন্তুষজনক নয়। দেশের এ হাল অবস্থায় সাধারণ মানুষ তাদের জান মালের নিরাপত্তাজনিত কারণে অসহায় ও বোবা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের মানুষ নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শংকিত অবস্থায় দিন গোজরান করছে। এ নিয়ে প্রশাসন ও বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক দলের তরফে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব গোটা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে ফেলেছে। তারা দেখেও দেখে না, শুনেও শুনে না বলে সাধারণ মানুষের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। অপরাধ প্রবণতা এতই বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, কে কখন কীভাবে আক্রান্ত হবে, কার সম্পত্তি কে দখল করবে, কে কখন লাঞ্চিত হবে, কে কখন অপহরণের শিকার হবে এ আশংকায় সাধারণ মানুষের চোখে ঘুম নেই। এ অপরাধ প্রবণতারোধে কেউই সক্রিয় হয়ে এগিয়ে আসছে না। সবাই যেন নীরব দর্শক। মূলত কারণ একটাই, ধূম্রজাল সৃষ্টি করে নিজের ফায়দা হাসিল করা।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতদূর অবনতি হয়েছে তা বুঝতে পান্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না। দেশে রয়েছে একটি সরকার। বিধিবদ্ধ আইনের আশ্রয়ে চলছে প্রশাসন। তাদের সহযোগিতায় আছে পুলিশ বিভাগ। অথচ প্রকাশ্যে প্রাণহানি, খুন, উৎখাত ইত্যাদির হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে জনবহুল এলাকায় চলছে অস্ত্রের মহড়া, ছিনতাই, রাহাজানি এবং তারপর খুন। রাজপথে বসছে বাজার, ফুটপাত দেওয়া হচ্ছে লিজ, রাজপথের উভয় পার্শ্বে যানবাহনের অবৈধ স্ট্যান্ড। এদের সরাবার উদ্যোগ তো নেই-ই বরং দৈনিক, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে আদায় করা হচ্ছে চাঁদা। এখানে চাঁদাবাজ কারা, কে তাদের দেখবে, কে গ্রেফতার করবে, বিচার করবে কে?

আবার অপরাধী, দুষ্কৃতকারী, সন্ত্রাসী, খুনীদের কোনো কোনো সময় গ্রেফতার করা হলে প্রতিবাদ, মিছিল, সভা হয়, বিবৃতি প্রদান করা হয়- এটাও ঠিক। অপরাধীরা ঘৃণার পরিবর্তে আশ্রয়প্রাপ্ত ও উৎসাহিত হয়। রাজনীতি দলীয় গোষ্ঠি স্বার্থকে শিক্ষাঙ্গনে অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, এমনকি কারাগার পর্যন্ত এখন আর নিরাপদ নয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীকে মারপিট করে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সত্য সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিককে শুধু ভয় দেখানো হচ্ছে না খুনও করা হচ্ছে। সাগর-রুনি তার একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়-আরো আছে।

আমরা বলে থাকি, দেশের সার্বিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলাজনিত স্বাভাবিক পরিবেশ ও সুষ্ঠু পরিস্থিতি। অথচ সেরূপ পরিস্থিতির নিশ্চয়তার জন্য প্রচেষ্টা কি চালানো হচ্ছে? যদি হয়ে থাকে তবে ফলাফল কোথায়? আসলে আমরা মুখে যা বলি কার্যক্ষেত্রে তাতে বিশ্বাসী নই। দেশের জনগণকে সকল শক্তির- সকল ক্ষমতার উৎস বলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের আশ্রয় দেওয়া হয়। কিন্তু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা কোনদিনেই রাজনৈতিক প্রত্যয় ও অঙ্গীকারে বলিয়ান নয়। তারা লোভী, ভোগ ও সুবিধাবাদী। এ সুবিধাবাদের কারণে তারা দল বদল করে, লেবাস পরিবর্তন করে। তারা অপরাধ করে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে থাকে। জুলুম ও জালেমকে যেখানে আমাদের ঘৃণা করা উচিত সেখানে আমরা কেবল নীরবই থাকি না, তাদের পক্ষে কথাও বলি, নিরপরাধ বলে বিবৃতি, বক্তৃতা দিয়ে থাকি। এটা কি স্ববিরোধিতা নয়? আমাদের মনে রাখতে হবে, ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ আর শাস্তির কঠোর বিধানই সন্ত্রাসের একমাত্র জবাব। একথা অবশ্য আমরা মাঝে মধ্যে বলে থাকলেও কার্যক্ষেত্র তার প্রতিফলন ঘটাতে পারি না। ন্যায় ও নীতির অনুসরণে আইনের প্রতি আস্থাশীল জনসাধারণ সহযোগী শক্তিতে পরিণত হয়।

অন্যদিকে পরিস্থিতির অবনতি লক্ষ করেও ব্যবস্থা গ্রহণের সময় ক্ষেপণ করা হলে অবনতি দ্রুত হয়। প্রতিপক্ষ দুঃসাহসী ও শক্তিশালী হয়, পরিস্থিতি এ সময় আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। পরিস্থিতিকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়া প্রজ্ঞার পরিচায়ক নয়। জনগণকে যতই অসহায় মনে করা হোক না কেন- জনগণই ক্ষমতার উৎস। জনগণের শক্তি অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে যে নৈরাজ্য নেমে আসে তা কারো জন্য কল্যাণকর হতে পারে না- ইতিহাস এর সাক্ষী।

এই লেখাটি যখন শেষ পর্যায়ে ঠিক তখন আমার মনে হলো সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সলের কথা। তিনি আমেরিকাতে গিয়েছিলেন সরকারি সফরে। ওয়াশিংটন বিমান বন্দরে ভিভিআইপি লাউঞ্জে সেখানকার এক সাংবাদিক বাদশাহকে প্রশ্ন করেন, বাদশা ফয়সল, আপনারা বলেন ইসলাম খুব সুন্দর ধর্ম, শান্তির ধর্ম কিন্তু আমরা দেখতে পাই আপনাদের দেশে বিভিন্ন শহরে এমনকি মক্কা-মদিনাতেও শিরচ্ছেদ করা হয়। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? প্রতি উত্তরে মহামান্য বাদশাহ বললেন, হ্যাঁ, এটা সত্য, কোনো ব্যক্তি অপরাধ করে থাকলে সম্ভাব্য কম সময়ের ভিতর সাক্ষী প্রমাণ নিয়ে কুরআন-হাদিসের আলোকে অপরাধের মাত্রানুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হয়। এতে কারও কারও অপরাধের মাত্রা ঐ পর্যায়ের হলে শিরচ্ছেদ করা হয়। এতে অন্যরা অপরাধ করতে সাহস পায় না। ফলে আমাদের সৌদি আরবে অপরাধ প্রবণতা খুবই কম এমনকি গভীর রাতে একজন সুন্দরী যুবতী রাস্তা দিয়ে একা হাঁটলেও কেউ তার গায়ে হাত দেবে না, বস্তাবন্দি করে কোটি কোটি ডলার, পাউন্ড বা রিয়াল নিয়ে হাঁটলেও কেউ ছিনতাই বা ডাকাতি করতে সাহস পাবে না। এতে প্রমাণিত হয়, আমাদের দেশে অপরাধের মাত্রা বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে কম। আর আপনিই বলুন, আপনাদের দেশে প্রতি মিনিটে কতটা ছিনতাই, ধর্ষণ ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে থাকে? বাদশাহ ফয়সলের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শুনে প্রশ্নকারী সাংবাদিক বিস্মিত হয়ে গেলেন। আমার বক্তব্য, আমাদের দেশেও যদি অপরাধীদের সম্ভাব্য কম সময়ের ভিতরে বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় তাহলে অপরাধ প্রবণতা অবশ্যই হ্রাস পাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন