পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন স্যারের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে জাতি একজন কীর্তিমান বুদ্ধিজীবীকে হারালো, যিনি আজন্ম গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত একটি স্বাধীন বাংলাদেশর জন্য লড়াই করে গেছেন। মূলত তিনি ছিলেন দেশের বরেণ্য ও কীর্তিমান একজন শিক্ষক ও অভিভাবক। দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে শাসক শ্রেণির সকল প্রকার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নির্ভয়ে দেশের পক্ষে ও দেশের মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। জনমত গড়তে হাতে কলম ধরেছেন। লিখেছেন মানুষের কথা, দেশের সমৃদ্ধির কথা, গণতন্ত্র ও সুশাসনের কথা। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদাসোচ্চার মানুষটি কোনদিন কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে জাতির পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন।
এই খ্যাতিমান মানুষটি ১৯৩৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ভারতের মালদা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি তার পরিবারের সাথে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চলে আসেন। বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদনা ফজলুল হক কলেজে লেখাপড়া করেন এবং রাজশাহী কলেজ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সাইন্সে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি রাজশাহী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি একটি কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ডিগ্রি শেষে তিনি দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। এমাজউদ্দিন স্যার পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের প্রভোস্ট, প্রক্টর এবং সহ-উপাচার্য হিসেবে সততা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই প্রথিতযশা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ২১তম ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত কৃতিত্ব ও সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন অনন্য ও অদ্বিতীয়, তেমনি প্রশাসক হিসেবেও ছিলেন সততা ও ন্যায্যতার কষ্ঠিপাথরে যাচাই করা খাঁটি সোনা।
চার সন্তানের জনক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন স্যার দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। মূলত তিনি একজন বরেণ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিলেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার পর ১৯৯৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট এন্ড অল্টারনেটিভ-এ ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি তাঁর এই সুদীর্ঘ কর্মজীবনে পঞ্চাশটির মতো মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন এবং প্রায় শতাধিক গবেষণা প্রবন্ধ দেশে-বিদেশের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তা ও সমাজভাবনা নিয়ে তিনি দেশে ও বিদেশের পত্রিকা ও জার্নালে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর যুক্তি ও তথ্যনির্ভর ক্ষুরধার লেখনি ক্রান্তিকালে পথহারা জাতিকে পথ দেখিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা, তুলনামূলক রাজনীতি: রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংকট, সমাজ ও রাজনীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা, জাতীয় নিরাপত্তা অন্যতম। মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৫২ সালের পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা হিসেবে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন কারাবরণ করেন।
মূলত প্রফেসর এমাজউদ্দীন স্যার কোনো দল বা গোষ্ঠির নয়, বরং বাংলাদেশের প্রকৃত অভিভাবক ছিলেন। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামী মানুষের অভিভাবক ছিলেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি সবসময় চেয়েছেন, বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হোক, বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে একটা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হোক, জনগণের মুক্তি হোক। তিনি সারাজীবন ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের জন্য তাঁর লেখনি অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জীবনের সমস্ত ভাবনা জুড়ে ছিলো দেশ, দেশের মানুষ, গণতন্ত্র অর্থনৈতিক মুক্তি, ন্যায়বিচার ও সুশাসন।
তাইতো ১/১১ সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যে কয়জন বুদ্ধিজীবী হাতে কলম ধরেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রফেসর এমাজউদ্দীন স্যার। দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে, মানুষের বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে, ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচারের মানদন্ডে পরিচালিত হবে প্রিয় বাংলাদেশ এমন হাজারো স্বপ্ন দেখতেন এই ক্ষণজন্মা মানুষটি। বাংলাদেশের জন্য তিনি সত্যিকার অর্থে একজন তারকা শিক্ষাবিদ ছিলেন। তিনি ছিলেন সূর্যের মতো আলোকিত একজন মানুষ। সেই আলোতে দেশবাসী আলোকিত হতো। তিনি অসংখ্য লেখা রেখে গেছেন। তাঁর লেখাগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখা এবং সম্পদ। তাঁর লেখা, তাঁর সততা যুগ যুগ ধরে আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে। সাহস যোগাবে সকল অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার।
তাঁর এই লেখাগুলো জাতির প্রেরণা হিসেবে যুগ যুগ ধরে পাঠক সমাজে সমাদৃত হবে। ওয়ান ইলেভেনের পরে যখন দেশে গণতন্ত্র গৃহবন্দি, মানুষ কথা বলতে পারে না সেই সময় তিনি গণতন্ত্রের জন্য মানুষের মুক্তির জন্য নির্ভয়ে কথা বলেছিলেন, হাতে কলম ধরেছিলেন, জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। স্বৈরাচারী ওয়ান-ইলেভেন সরকারের হাত থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এবং একটি নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছিলেন। তিনি দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের আন্দোলনসহ পেশাজীবীদের যৌক্তিক সকল আন্দোলনে সবসময় সোচ্চার থেকেছেন। তিনি দলকানা কোনো বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। তিনি সদা সত্য বলতেন এবং সত্যের পক্ষে কলম হাতে লড়াই করতেন। সত্যের পক্ষে কথা বলতে তিনি কখনোই কার্পণ্য করতেন না। সত্যের পক্ষে বলতে ও লিখতে গিয়ে তিনি সময়ে সময়ে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন, কিন্তু সত্য বলা থেকে পিছপা হননি। গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে বৃদ্ধবয়সে মিথ্যা অভিযোগে মামলার আসামী হয়েছেন। কিন্তু অন্যায় ও অসত্যের সাথে কোনদিন আপোস করেননি। তিনি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যেটা সত্য মনে করতেন, মঙ্গল মনে করতেন তা বলতেন দৃঢ়চিত্তে। দেশের যে কোনো ক্রান্তিকালে জাতি একজন প্রফেসর এমাজউদ্দিনের অভাব অনুভব করবে। প্রার্থনা করি, এই ক্ষণজন্মা পুরুষকে আল্লাহ বেহেশত নসিব করুন।
লেখক: অধ্যাপক, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।