Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

শিবগঞ্জে জেম বাহিনীর সহিংসতায় যুবকের মৃত্যু

শিবগঞ্জ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৮ জুলাই, ২০২০, ১:২০ পিএম

সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন সাইফুদ্দিন (৪৮)। পাশের বাড়ির দরজার ফাঁক দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলেন তার বড়ভাই মুকুল হোসেন (৫৬)। ভাইয়ের উপর চর্তুমুখী হামলার খবর পেয়ে তিনি ভাইকে রক্ষায় যাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশীরা তাকে জোর করে বাড়িতে ঢুকিয়ে নেন। শনিবার (১৮ জুলাই) সকালে সরেজমিনে ঠিক যে স্থানে খুন হয়েছেন সাইফুদ্দিন সেই স্থানে এসে নিরবে চোখের জল ফেলেন পারুল বেগম। ঘটনার পর থেকেই ওই এলাকায় সার্বক্ষনিক মোতায়েন রয়েছে পুলিশ। এর আগে মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভার মর্দানা-আইয়ূব বাজার এলাকায় নৃশংসভাবে খুন হন সাইফুদ্দিন। বুধবার গ্রামের গোরস্তানে তার মরদেহ দাফন হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো চাপা আতঙ্কে থমথমে পুরো এলাকা। মুকুল হোসেন বলেন, এক আগে একই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন তার অপর এক ভাই তাইফুর রহমান। চোখের সামনে আরেক ভাই সাইফুদ্দিনকে নৃশংসভাবে কোপাতে দেখেছেন। কিন্তু ভাইকে বাঁচাতে পারেননি। প্রতিবেশীরা তাকে আসতেই দেননি। তিনিও সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের কোপে পড়বেন এ শঙ্কায় প্রতিবেশীরা তাকে আটকে রাখেন। ওই সময় তার বাড়ি, তার আরো ভাই-ভাতিজাদের বাড়িতেও হামলা ও লুটপাট হয়। অবরুদ্ধ থেকে তিনি খবর দেন পুলিশকে। পরে পুলিশ এলে তিনি বেরিয়ে আসেন। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমের নির্দেশেই এ হামলা হয়েছে। এ নিয়ে জেমসহ ৩৪ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন তিনি। এর আগেও সাইফুদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে কয়েক দফা হামলা চালায় জেমের অনুসারীরা। কিন্তু বরাবরই প্রাণে বেঁচে যান সাইফুদ্দিন। দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সাইফুদ্দিন (৪৮)। স্ত্রী-সন্তানদের সাথে দুপুরের খাবারও খেয়েছিলেন। কিন্তু রাতে আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার। ফিরেছে তার ছিন্নভিন্ন নিথর দেহ। শোকের সাগরে ভাসিয়ে গেছেন স্ত্রী পারুল বেগমকে। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে ভাসিয়েছেন অকুল পাথারে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, পুলিশ না থাকলে সন্তারদের নিয়ে বাড়ি থেকে বেরুতেই পারতেননা পারুল বেগম। স্বামীর উপর এমন নৃসংশতায় বাকরুদ্ধ পারুল বেগম। তিনি বলেন, আমার স্বামী দুপুরে বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে বেরিয়েছিলেন। তার পর আর বাড়ি ফেরেননি। আমরা খবর পাচ্ছি, তার উপর হামলা হয়েছে। ফোন দিচ্ছি, সাড়া পাচ্ছিনা। এখানে আমার স্বামীকে একদল সন্ত্রাসী কুপিয়েছে। পরে আমাদের বাড়ি এসে গরুবাছুরসহ জিনিসপত্র লুটে করে নিয়ে গেছে। বসতবাড়ি ছাড়া একবিধা ধানি জমি রয়েছে সাইফুদ্দিনের। বড়ছেলে ইনজামুলকে (২৩) নিয়ে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। মাঝেমধ্যে অন্যের জমি বর্গাচাষ করতেন। একমাত্র মেয়ে সানজিদা খাতুন (২০) রাণীহাটি ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে পারভেজ (১৮) এসএসসি পাশ করে বাবার সাথে কৃষিকাজ করেন। ছেলে-মেয়ের পড়াশোনাসহ সংসার চলতো সাইফুদ্দিনের একার আয়ে। স্বামীকে হারিয়ে কিভাবে বাকি পথ পাড়ি দেবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পারুল বেগম। সন্ত্রাসীদের তা-ব চলাকালে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে বেরিয়ে আসেন আয়েশা বেগম। ছুটে যান ভাইয়ের কাছে। তার ভাষ্য, ভাইকে রক্ষায় এগিয়ে যাবার পর তার গলায় ধারালো অস্ত্র ঠেঁকায় সন্ত্রাসীরা। কিন্তু শুধু নারী হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচেছেন। ওই সময় পরিবারের যে পুরুষ সদস্য আসতো, তাকেই হত্যা করতো হামলাকারীরা। আয়েশা বেগম জানান, তার ভাইয়ের পুরো শরীর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয় সন্ত্রাসীরা। দুই হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়। ওই সময় মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তার ভাই। পানি চাইলে সন্ত্রসীরা তার মুখে প্রসাব করে। সন্ত্রাসীরা দূরে সরতেই পাশের টিউবয়েল থেকে পানি আনেন তিনি। পানি মুখে তুলে দেয়ার সময় সন্ত্রাসীরা আবারো ফিরে আসে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে উল্ল্যাস করতে থাকে। আয়েশার দাবি- ঘটনার দুই ঘণ্টা পর পুলিশ এসেছে। আরো আগে পুলিশ এলে ভাইকে হয়তো বাঁচানো যেতো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসী জানান, গ্রামীণ রাজনীতির বলি সাইফুদ্দিন। সাইফুদ্দিনসহ তার পুরো পরিবার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিরর আবদুস সালামের সমর্থক ছিলেন। আর এ কারণেই বর্তমান কাউন্সিলর খাইরুল ইসলাম জেমের রোষানলে পড়ে পরিবারটি। কেবল এই পরিবারই নয়- যারা কাউন্সিলর জেমের বিরোধীতা করেন তাদেরই সাইফুদ্দিনের মতো পরিণতি বরণ করতে হয়। গত ৫ বছরে এলাকায় অন্তত ৫টি হত্যাকা- ঘটেছে। এর প্রতিটিতেই কোননা কোনভাবে কাউন্সিলর জেমের হাত। প্রতিপক্ষকে দমাতে বরাবরই নৃশংসতা বেছে নিয়েছেন জেম। এলাকাবাসী আরো জানান, প্রতিবারই হত্যাকা-ের পর এলাকায় পুলিশ অবস্থান করে। ওই সময় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ সরে যাবার পরেই আবারো নিজেদের অবস্থান পাকা করে কাউন্সিলর জেমের বাহিনী। ছুতো পেলেই এলাকাবাসীর উপর চলে নৃশংসতা। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চাননা। ঘটনার পর থেকে মর্দানা-আইয়ূববাজার এলাকায় দায়িত্বপালন করছেন শিবগঞ্জ থানার উপপরির্দক ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছেন। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও এলাকায় আসছেন। পরিস্থিতি এখন শান্ত। লোকজন নির্ভয়ে বাইরে বেরুচ্ছেন। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সবধরণের ব্যবস্থা নিচ্ছে। অভিযোগ বিষয়ে জানতে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমের মোবাইল সংযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে এ নিয়ে তার মন্তব্য মেলেনি। এলাকাবাসী বলছে, এ ঘটনার পর আত্মগোপনে খাইরুল আলম জেম। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শিবগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুবুর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত ৮ আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে প্রধান আসামি কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমকে পলাতক। তাকেসহ মামলার পলাতক অন্য আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে আইনত ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জেম

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ