Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনাত্তোর পৃথিবী কেমন হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনা মহামারি একদিন শেষ হবেই। কিন্তু এর স্মৃতি থেকে যাবে বহুদিন। অপরদিকে, করোনা শেষ হওয়ার পর কী হবে? মহামারির মধ্যেও এটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপীই। সকলের এককথা, ‘করোনা-পরবর্তী বিশ্ব বদলে যাবে। নতুন রূপ ধারণ করবে।’ তবে সেই নবরূপটি কী, তা আলোচিত হচ্ছে না তেমনিভাবে। অনুমেয় আগামী দিনের কর্ম হবে করোনাকালীন শিক্ষা। তথা করোনাকালে মানুষ যেসব ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ও উপকৃত হয়েছে, সেসবকে ভিত্তি করেই হবে নতুন পৃথিবীর স্বরূপ, যার অন্যতম হবে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা। কারণ, অঢেল ধন-সম্পদ ও ক্ষমতা থাকলেও নিরাপদে থাকা যায় না, করোনাকালে তা প্রমাণিত হয়েছে। ধনী-গরীব, রাজা-বাদশা, ফকির, মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী- কেউই রক্ষা পায়নি করোনার ছোবল থেকে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় এটা হয়েছে। কোনো যাদুবিদ্যা, সামরিক শক্তি কিংবা অলৌকিকতা দিয়েও প্রতিরোধ করা যায়নি। উপরন্তু করোনার শুরু থেকেই বিশ্বজুড়ে অন্য ব্যাধির চিকিৎসাও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এই পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়েছে। এসব রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করা এখন বড় চ্যালেঞ্জের বলে জানিয়েছে হু। তাই করোনা পরবর্তী বিশ্ববাসীর প্রথম শিক্ষা হচ্ছে: সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা। তাই এদিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে সকলেই, যাতে ভবিষ্যতে করোনাসহ সব ব্যাধি ভালভাবে মোকাবেলা করে বাঁচা যায়, করোনাকালের মতো অকালে মরতে না হয়। কিন্তু এটা করতে হবে বিশ্বব্যাপী সমভাবে ও একই সঙ্গে। নতুবা বিচ্ছিন্নভাবে কারও চেষ্টা ফলদায়ক হবে না। উহানের করোনা যেমন নিমিষেই বিশ্বজুড়ে মহামারির আকার ধারণ করেছে তেমনিই হবে ভবিষ্যতেও। তাই সব দেশকেই পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপীই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ বিশ্বে সকলের ও সব ব্যাধির শতভাগ সুচিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, দক্ষ জনবল, ভালো ব্যবস্থাপনা এবং ওষুধ ও মেডিক্যাল সামগ্রী সুলভে ও সহজে পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা খুবই ব্যয়বহুল। এসব করা গরিব ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুব কঠিন। অবশ্য সামরিক ব্যয় হ্রাস এবং দুর্নীতি ও অ-উৎপাদনশীল ব্যয় বন্ধ করলেই তা করা সম্ভব। উপরন্তু এ ক্ষেত্রে হু’কেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। সে সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে গত ১৮-১৯ মে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে। তাতে বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ও হু’র নেতৃস্থানীয় ভূমিকা সমুন্নত রাখার রেজুলেশন গৃহীত হয়েছে। এখন হু’র প্রয়োজন এটা বাস্তবায়ন, সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে সময়োপযোগী ‘বৈশ্বিক হেলথ অর্গানোগ্রাম’ তৈরি এবং এসব বাস্তবায়নে সদস্য দেশগুলোকে উদ্বুদ্ধ করা। উপরন্তু সকলের জন্য হেলথ ইনস্যুরেন্স চালু করারও ব্যবস্থা করা দরকার। গত ২৭ মে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে একটি ফাউন্ডেশনের ঘোষণা দিয়েছে হু, যার কাজ হবে দেশগুলোর পরিকল্পনামাফিক অর্থ সহায়তা দেওয়া, যাতে তারা করোনাকে পরাস্ত করতে পারে ও ভবিষ্যতের কোনও মহামারি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে পারে।

করোনার প্রথম শিক্ষা হচ্ছে: বিশ্ববাসীকে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেই হবে না, সেই সাথে রোগ প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা করতে হবে। নতুবা নিত্য নতুন ব্যাধি সৃষ্টি হয়ে অগণিত মানুষ আক্রান্ত হবে, যা স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েও মোকাবেলা করা যাবে না। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা টেকসই করার জন্য রোগ প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা করতে হবে একই সঙ্গে। ব্যাধি সৃষ্টির প্রধান উৎস দূষণ। তাই সব রকমের দূষণ বন্ধ করতে হবে। এছাড়া, বন উজাড়ের কারণে বিভিন্ন ভাইরাস সৃষ্টি হচ্ছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। তাই বিশ্বের সব বনাঞ্চল রক্ষা, প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল সৃষ্টি ও সর্বত্রই প্রয়োজনীয় বৃক্ষ রোপণ করা দরকার। এছাড়া, সব আবাস, কর্মস্থল ও যানবাহন পরিবেশবান্ধব করা প্রয়োজন। অন্যদিকে, মানুষের ইমিউনিটিও বৃদ্ধি করা দরকার, যা সৃষ্টি হয় নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ ও শিশুদের প্রয়োজনীয় মায়ের দুধ খাওয়া থেকে। এছাড়া, সকলের প্রয়োজনীয় ঘুম, বিশ্রাম, বিনোদন, ব্যায়াম, শরীর, কাপড় ও আবর্জনা পরিষ্কার আবশ্যক। উপরন্তু বাল্য বিবাহ, মাদক, তামাক পণ্য, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস, ভেজাল ও কেমিক্যালযুক্ত খাদ্য, অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন ইত্যাদি পরিহার করা প্রয়োজন। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের স্তম্ভ। সর্বোপরি প্রতিটি দেশের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত।

করোনার দ্বিতীয় শিক্ষা হচ্ছে: প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা। কারণ, করোনা মহামারি রোধ করার জন্য যখন বিশ্বব্যাপীই লকডাউনে সবকিছু বন্ধ হয়ে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিল, তখন প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে বসেই বহু জরুরি কর্ম করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন: টাকা ও পণ্য লেনদেন, বিভিন্ন বিল পরিশোধ, শিক্ষা কার্যক্রম চালানো, বিনোদন উপভোগ, খাদ্য সংগ্রহ, চিকিৎসা, মিটিং, অফিস-আদালত চালানো, ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ, সোশ্যাল ডিসটেন্স তদারকি ইত্যাদি। শিশুরাও প্রযুক্তি নিয়ে সময় কাটাতে পেরেছে। তাই প্রযুক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক। ফলে টেক কোম্পানিগুলোর মালিকদের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়ে তাদের সম্পদের পরিমাণ অনেক বেড়েছে বৈশ্বিক মহামন্দার মধ্যেও। উপরন্তু সব ক্ষেত্রে যখন কর্মী ছাঁটাই চলেছে, তখন জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপক নিয়োগ দিয়েছে তারা। এমনকি ভাইরাস প্রতিরোধী যানবাহনও চালু করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিবিসির খবরে প্রকাশ, স্বাস্থ্য উদ্বেগ থেকে মুনাফা তুলতে চীনে গাড়ি নির্মাতারা ভাইরাস ঠেকানোর ব্যবস্থা সম্বলিত গাড়ি বাজারে ছেড়েছে। নতুন মডেলের এই গাড়িগুলোতে থাকছে ফেস মাস্ক পরলে যে মাত্রার সুরক্ষা পাওয়া যায় গাড়ির ভেতর সেরকম ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি। দেশটির কয়েকটি বড় গাড়ি নির্মাতা সংস্থা এ ধরনের গাড়ি বাজারে ছেড়েছে। তন্মধ্যে আছে গিলি। গিলি এমন জীবাণু প্রতিরোধী পদার্থ তৈরি করছে যাতে গাড়ির ভেতরের জিনিসপত্র ও গাড়ির দরোজার হ্যান্ডেল জীবাণু মুক্ত থাকে। ব্রিটিশ এসএআইসি আরও একটি বাড়তি ফিচার যোগ করেছে তাদের গাড়িতে। এতে গাড়ির ভেতর একটি অতিবেগুনি রশ্মির বাতি ব্যবহার করে গাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে গাড়ির ভেতরের বাতাসকে জীবাণুমুক্ত করা যাবে। গুয়ানঝু অটোমোবাইলও বেশ কয়েকটি নতুন মডেলে তিন ধাপের বাতাস জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা বসিয়েছে। আগামীতে আরো বহু গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি এ ধরনের গাড়ি নির্মাণে এগিয়ে আসবে। ফলে নতুন পৃথিবীতে এসবের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ করোনা প্রযুক্তির ব্যবহারকে অনেক বছর এগিয়ে দিয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে শ্রম বাজারের ৫২ ভাগই চলে যাবে রোবটের দখলে।

করোনার তৃতীয় শিক্ষা হচ্ছে: জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ হলেই কার্বন নিঃসরণ কমে যায়। আইইএ’র গ্লোবাল এনার্জি রিভিউতে ১০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যুতের চাহিদা বিশ্লেষণ করে উপাত্ত তৈরি করে গত ৩০ এপ্রিল বলা হয়েছে, ‘এ বছর বিশ্বজুড়ে জ্বালানির চাহিদা ৬% কমবে। তাই কার্বন নিঃসরণের হার ৮% কমবে। ফলে গত ১০ বছরের মধ্যে এটাই হতে যাচ্ছে কার্বন নিঃসরণের সর্বনিম্ন হার। করোনা মহামারির কারণে স্থবির বিশ্বে জ্বালানি তেল ব্যবহারের হার প্রায় ৪০% কমেছে। ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পিএম ২.৫ এর মাত্রা কমেছে যথাক্রমে ৩৭% ও ১০%। স্মরণীয় যে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ৬% হ্রাসের কারণেই যদি কার্বন নিঃসরণ ৮% হ্রাস পায়, তাহলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হলে বায়ুমন্ডলের উঞ্চতা পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে নিশ্চিত। বিশ্বে প্রতিবছর বায়ুদূষণজনিত জটিলতায় মারা যায় ৮৮ লাখ মানুষ। সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০৭০ সালে পৃথিবী হয়ে উঠবে আরও উষ্ণ। সে সময় বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ তথা ৩৫০ কোটি মানুষ বসবাস করবে পৃথিবীর মারাত্মক উষ্ণতম এলাকাগুলোতে, যাদের বেশিরভাগ হবে দরিদ্র, তাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র তো দূরের কথা, হয়তো বৈদ্যুতিক পাখা কেনার সামর্থ্যও থাকবে না। ছয় হাজার বছর আগে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল ১১-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। এটি গত ৪ মে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সে প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত: জাতিসংঘ বলেছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি-২০১৫ মোতাবেক তাপমাত্রা কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পূরণে ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন বার্ষিক ৭.৬% করে হ্রাস পেতে হবে। কিন্তু করোনার আঘাত হানার আগ পর্যন্ত প্রতি বছর কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তৃতীয়ত: গত ৮ মে একদল বিজ্ঞানী বলেছেন, পৃথিবীর ভূ-ভাগের উষ্ণতা আরও ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে ১.৩ মিটারের বেশি, যা জাতিসংঘের আইপিসিসি’র পূর্বাভাসের তুলনায় বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়েই বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবী চরম হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে মৃত্যু, ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ব্যাধি, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পৃথিবী বসবাসের অনুপযোগী হতে চলেছে। আর আগামীতে বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা আরও বাড়লে পৃথিবীকে বাঁচানোই যাবে না। এ ক্ষেত্রে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কির মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘কভিড-১৯ মহামারি একদিন থামবে; কিন্তু বিশ্ব উঞ্চায়ন থামাতে না পারলে সে বিপদ হবে অনেক বেশি ভয়ংকর। বিপদে পড়বে গোটা মানব জাতির অস্তিত্বই।’ তখন মানুষকে বাঁচার জন্য চাঁদ, মঙ্গল ও অন্য গ্রহে বাস করতে হবে। কিন্তু সেটা কয়জন মানুষের পক্ষে সম্ভব? তাই ধরিত্রীকে বাসোপযোগী করতেই হবে। সে জন্য পরিবেশের প্রধান ক্ষতিকারক ও অধিক ব্যয় সম্বলিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব ও স্বল্প ব্যয়ের নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার করতে হবে শতভাগ। অপরদিকে, পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বনাঞ্চলও আবশ্যক। গত ফেব্রুয়ারিতে বিজ্ঞান সাময়িক ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের জুরিখে সুইস ফেডারাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির একটি গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে, ‘কমপক্ষে এক লাখ কোটি গাছ লাগালে বাতাসে কমবে বিষ। আমাদের বায়ুমন্ডল হয়ে উঠবে ১০০ বছর আগের মতো।’ এছাড়া, বৃক্ষের আরও নানাবিধ ব্যাপক উপকার আছে। তাই বিশ্ববাসীর উচিৎ, প্রয়োজনীয় বৃক্ষ রোপণ ও পরিচর্যা করা। নদী ও শব্দ দূষণেও মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টি হয়। তাই এসব দূষণও বন্ধ করা জরুরি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কয়লা, তেল ও গ্যাস রফতানি নির্ভর দেশগুলো ব্যাপক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই সাফল্যজনক বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে তাদেরকে। নতুবা তাদের ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকার।

করোনার চতুর্থ শিক্ষা হচ্ছে: আত্মনির্ভর কর্মসংস্থান। কারণ, করোনা মোকাবেলায় লকডাউনে সব কর্ম বন্ধ হয়ে বৈশ্বিক মহামন্দা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আকার ১২ লাখ কোটি ডলার ক্ষতি হবে,দারিদ্র বাড়বে, অভূতপূর্ব বৈশ্বিক খাদ্য সংকট দেখা দিবে, ২৬ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষে পড়বে, মানব উন্নয়নের ব্যাপক ক্ষতি হবে, বিনিয়োগ ব্যাপক হ্রাস পাবে, বেকারত্ব ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে, নারীর অগ্রগতি পিছিয়ে যাবে ৫০ বছর, বাল্য বিবাহ অনেক বাড়বে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংকটের কারণে শিশুদের ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকার হবে ইত্যাদি বলে জাতি সংঘ ও তার অঙ্গ সংস্থাগুলো জানিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্য সর্বনিম্ন হওয়া। ফলে জ্বালানি তেল রফতানি নির্ভর দেশগুলোর উন্নতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী দেশগুলো ‘রক্ষণশীল নীতি’ গ্রহণ করে অভিবাসী শ্রমিকের বদলে অভ্যন্তরীণ শ্রম ব্যবহারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। একই সাথে তারা শরণার্থী বিরোধীও হয়েছে। তাই অভিবাসী ও শরণার্থী বিরোধী সুনামি শুরু হয়েছে উল্লেখ করে জাতিসংঘের মহাসচিব গভীর উদ্বেগ জানিয়ে এ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু অভিবাসী হ্রাস পাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো। কারণ, তাদের অর্থনীতির প্রাণ ভোমরা হচ্ছে প্রবাসী আয়, যা বন্ধ হলে বৈশ্বিক মন্দা কেটে গেলেও তাদের মন্দা কাটবে না সহজে। তাই এ দেশগুলোর রক্ষাকবচ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কর্ম বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থানে স্বনির্ভরতা অর্জন করা। অভিবাসীর ক্ষেত্রে আরও অন্তরায় হয়েছে প্রযুক্তি ব্যবহার। এটা যত বাড়ছে, তত শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাচ্ছে। তাই কর্মসংস্থানে স্বনির্ভর হওয়া জনসংখ্যার ঘনত্বে আধিক্য ও গরিব দেশগুলোর জন্য খুব কঠিন। তাই তাদেরকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিতে হবে।

করোনার পঞ্চম শিক্ষা হচ্ছে: দারিদ্র্য নিরসন। করোনা মহামারি রোধে সৃষ্ট লকডাউনের কারণে কর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দারিদ্র্য অনেক বৃদ্ধি পেয়ে ১১০ কোটি হয়েছে, যা করোনার আগে ছিল ৮২ কোটি। এ দরিদ্রদের ঘরে ঘরে চলছে চরম হাহাকার। তাই তারা খাদ্যের জন্য চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষোভ, খাদ্য লুট, রাস্তা অবরোধ ইত্যাদি করছে বিভিন্ন দেশে। ফলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। বহু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে। তাই দারিদ্র্য বিমোচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটা খুব কঠিন। কারণ, দারিদ্র্য বিমোচনে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছিল গত কয়েক দশকে, তা ম্লান হয়ে পূর্বের চেয়ে দারিদ্র্য বেশি হয়েছে করোনার কারণে, যা সহজে দূর হবে না।
করোনার ষষ্ঠ শিক্ষা হচ্ছে: পরিবার কেন্দ্রিক হওয়া। কারণ, করোনাকালে লকডাউনের কারণে সরবরাহ বন্ধ থাকায় অনেক সামর্থ্যবান মানুষও খাদ্য না পেয়ে অনাহারের সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর মানুষ। কারণ, তারা প্রধানত সরবরাহকৃত খাদ্যের উপরই নির্ভরশীল। তাই খাদ্য সরবরাহ বন্ধ থাকায় তাদেরকে চরম কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। এছাড়া, আরও কিছু সমস্যাও প্রকট হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে যাতে এরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয় সে জন্য মানুষ পরিবার ভিত্তিক হয়ে উঠবে নতুন পৃথিবীতে। (ক্রমশ)
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন