পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আছে। যেমন ধর্মের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ধর্ম। একইভাবে আইনের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য আইন। কথাগুলির জওয়াব এককথায় দেওয়া মুশকিল। অথচ এক কথায় জবাব দিতেই হবে। নইলে আপনি সারা জীবন দিশেহারা হয়ে ঘুরবেন।
প্রশ্ন হলো, আমরা মানুষ কেন? পশুর সাথে আমাদের ফারাক কী? জৈবিক কামনা-বাসনায় পশুর সাথে কোনো ফারাক নেই। অথচ ওদের মা-বোন বাছ-বিচার নেই। মানুষের আছে। পশুদের কোনো হালাল-হারাম জ্ঞান নেই। মানুষের আছে। পশুরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। খাও-দাও-ফূর্তি করো, আর অপরের ঘাড় মটকাও- এটাই ওদের সারাক্ষণের কর্ম। কিন্তু মানুষ নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়ায়। সে ত্যাগের মধ্যেই তৃপ্তি পায়। সে দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাত লাভে ব্যস্ত থাকে। মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও হাতে ধরা পানির পাত্র অন্য প্রার্থীকে দেয়। সে মরে যায়। কিন্তু বেঁচে থাকে তার মনুষ্যত্ব। যুগ যুগ ধরে মানুষ তাকে স্মরণ করে ও পরকালে রূহের মাগফিরাতের জন্য দো‘আ করে। ফল কী দাঁড়াল? মানুষ বড় নয় বরং মনুষ্যত্ব বড়। মনুষ্যত্বই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে। পৃথিবীতে চিরকাল এটাই সত্য। যদিও নাস্তিক ও বস্তুবাদীরা কেবল বস্তুকেই মুখ্য গণ্য করে। মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতা তাদের কাছে গৌণ। আর তাইতো দেখা যায় ছোট ভাই হাবীলের সুনামে ক্ষুব্ধ হয়ে বড় ভাই কাবীল তাকে হত্যা করে। পরে কাবীলও মরেছে। কিন্তু অমর হয়েছে হাবীল। ইব্রাহীম তার পিতা ধর্মগুরু আযরকে নিজ হাতে গড়া মূর্তির অক্ষমতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। তাতে ক্ষেপে গেলেন পিতা, সমাজ ও দেশের সম্রাট নমরূদ। প্রচলিত ধর্ম অবমাননার দায়ে বিচারে তাকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার দন্ড দেওয়া হলো। তিনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হলেন। বিজয়ী হলো সমাজ। কিন্তু পরাজিত হলো মনুষ্যত্ব ও ন্যায়বিচার। ফলে ইতিহাসে অমর হলেন ইব্রাহীম। ঘৃণার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হ’ল তার সমাজ ও সরকার। একই অপরাধে নিজ জন্মভূমি মক্কা থেকে রাতের অন্ধকারে হিজরত করতে বাধ্য হলেন শেষনবী মুহাম্মাদ (সা.)। আপাতত বিজয়ী হলো আবু জাহল, আবু লাহাবরা। কিন্তু পরাজিত হলো তাদের মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতা। পুত্রহারা মুহাম্মাদকে বলা হলো ‘লেজকাটা’। অথচ তাঁর রেখে যাওয়া ন্যায় ও সত্যের অনুসারী কোটি কোটি মুমিন এখন বিশ্বের কোণায় কোণায়। তার সাথে মুনাফেকী করল ইবনে উবাই ও তার সাথীরা। তিনি তাদের ক্ষমা করলেন। উভয়ে মারা গেছেন। কিন্তু চিহ্নিত হয়ে আছে ইবনে উবাই। পলাশীতে গাদ্দারী করেছে মীরজাফর ও তার সাথীরা। সিরাজের পর তিনি বাংলার নবাব হয়েছিলেন। সিরাজ ও মীরজাফর উভয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছেন। কিন্তু সিরাজুদ্দৌলা সর্বদা বাঙ্গালীর গর্ব। তার নৈতিকতা ও দেশপ্রেম চিরঞ্জীব। পক্ষান্তরে সুবিধাভোগী মীরজাফর, উর্মি চাঁদরা বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে।
আখেরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি যার যত তীব্র, তার নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ব তত উন্নত। তাইতো দেখি গুহায় আটকে পড়া ও সাক্ষাত মৃত্যুমুখে পতিত তিনজন ঈমানদার যুবকের মুক্তিলাভের অবিশ্বাস্য ঘটনা (বু. মু. মিশকাত হা/৪৯৩৮)। যা যেকোন মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয় এবং অদৃশ্য আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রতি মাথা নুইয়ে পড়ে। হিজরতের রাতে ছওর গিরিগুহায় শত্রু র সাক্ষাত হামলা থেকে রাসূল (সা.) ও আবুবকর (রা.) এর অকল্পনীয় মুক্তি যেকোন বিশ্বাসী হৃদয়ে দৃঢ়তা আনয়ন করে। ধনলোভী কারূণ, অত্যাচারী নমরূদ ও ফেরাউন ইতিহাসের ঘৃণিত জীব। অথচ সর্বস্বহারা ইব্রাহীম (আ.) ও মুসা (আ.) মানবজাতির গর্ব ও সর্বমহলে প্রশংসিত ও নন্দিত। মুতার যুদ্ধে ২ লক্ষ ৪০ হাজার খ্রিস্টান সেনার বিরুদ্ধে মাত্র তিন হাজার মুসলিম সেনার অবিস্মরণীয় বিজয় সাধিত হওয়ার পিছনে ছিল একই কারণ। সেদিন তরুণ সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা.) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন, আমাদের সামনে খোলা রয়েছে মাত্র দু’টি পথ- হয় বিজয়, নয় শাহাদাত। ব্যস এতেই আল্লাহ্র সরাসরি মদদ নেমে এসেছিল সেদিন। সেনাপতিসহ মাত্র ১২ জন শহীদের বিনিময়ে বিশাল খ্রিস্টান বাহিনী অগণিত হতাহতের মধ্য দিয়ে মর্মান্তিক পরাজয় বরণ করে, যার বাস্তব ফল আজকের মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য। এখন বিশ্বে সংখ্যা বেড়েছে মুসলমানের। কিন্তু বাড়েনি ঈমান ও তাওয়াক্কুল। আর তাইতো দেখি সর্বত্র ধর্ষক, মদ্যপ, ভদ্রবেশী রিলিফ চোর, ব্যাংক লুটেরা ও চোর-বাটপারদের দৌরাত্ম্য।
করোনার ভয়ে নিজ পিতাকে ঘরে উঠতে দেয় না স্ত্রী ও সন্তানেরা। অবশেষে তাদের চোখের সামনে রাত্রিতে বাড়ির উঠানে প্রচন্ড বৃষ্টিপাতে ভিজে মৃত্যুর মুখ থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। মৃত ছেলের লাশ এনেছে অন্য ছেলেরা পরিবারের সদস্যদের শেষবারের মতো দেখানো ও কাফন-দাফনের জন্য। কিন্তু দূর থেকে পিতার নির্দেশ, ওকে উঠানে এনো না। তখন বাধ্য হয়ে উঠানের বাইরে বৃষ্টি-কাদার মধ্যে গোসল-কাফন সেরে গোরস্থানে নিয়ে গেল। কিন্তু সেখানেও লোকদের বাধা। অবশেষে অজ্ঞাত স্থানে লাশ দাফন করা হ’ল। ঐ ছেলেরা ঐ বাপকে বলে গেল, ছেলেটি আপনার। তাই হাসপাতাল থেকে এনেছিলাম আপনার কাছে। আপনি কাছে এলেন না, এমনকি উঠানেও লাশটা রাখতে দিলেন না নিজের মৃত্যুর ভয়ে। অথচ আমরা তো আপনার ছেলে নই। আমাদের কি মৃত্যুভয় নেই? হ্যাঁ এখানেই পিতা ও পরিবার পরাজিত হয়েছে চিরদিনের মতো। পক্ষান্তরে ঐ অচেনা যুবকরা নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বকে উড্ডীন করেছে। ওরা অমর হয়েছে ইহকালে ও পরকালে। বৃদ্ধা মাকে সন্তানরা ফেলে গেছে জঙ্গলে। অবশেষে পুলিশ তাকে শিয়াল-কুকুরের হাত থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনে। অ্যাম্বুলেন্সে একজন রোগী হাঁচি দিয়েছে। তাতেই তাকে রাস্তায় ফেলে পালিয়েছে অ্যাম্বুলেন্সসহ তার আরোহীরা। ঢাকা থেকে রংপুর যাওয়ার পথে একজন যাত্রী হঠাৎ জ্বরাক্রান্ত হয়েছে। গভীর রাতে তার পরিচিত সাথীরা তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে গেছে। পরে লোকেরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। একই ফ্ল্যাটে বসবাসকারী কোটিপতি ব্যবসায়ী অন্য রোগে মারা গেলেন। কিন্তু পাশের ফ্ল্যাটের কেউই তার পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। কেউ হাঁচি দিলেও এখন তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। চিরচেনা বন্ধু আজ অচেনা হয়ে গেছে। তাই আজ মানুষ বাঁচানোর আগে প্রয়োজন মনুষ্যত্বকে বাঁচানো। কিয়ামতের শেষ বিচারে যখন পরস্পরে সাক্ষাত হবে, সেদিন কী জবাব দেবে ঐ নিষ্ঠুর পিতা-মাতা ও ভাই-বোনেরা এবং পরিচিত জনেরা!
তথাকথিত বিশ্ব নেতারা, যারা পূর্বের ন্যায় এখনো বিশ্ব বিপর্যয়ের মূল নায়ক, তারা জঙ্গলের হিংস্র পশুর ন্যায় একে অপরের উপর হামলে পড়ার ছক আঁকায় ব্যস্ত। বঙ্গোপসাগরে ও ভূমধ্যসাগরে পেটের দায়ে ভাসছে হাজারো মানুষ। মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০ কোটির উপর মানুষ সর্বত্র ছুটে বেড়াচ্ছে একটু আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু কোনো নেতা তাদের আশ্রয় দিচ্ছে না। ধর্মভেদ, বর্ণভেদ, অঞ্চলভেদ, জাতিভেদ ইত্যাদি ভেদাভেদের রাজনীতি করে তারা সর্বত্র মনুষ্যত্বকে হত্যা করছে। বনের পশুও এদের চাইতে ভালো। তাইতো দেখি, উহানের জনৈক ব্যক্তির পোষা কুকুরটি পাঁচদিন হাসপাতালের সামনে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পড়ে থাকে মনিবের আগমনের অপেক্ষায়। অবশেষে লোকেরা বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু না, সুস্থ হয়ে সে আবার ছুটে আসে হাসপাতালের সামনে। কেননা সে জানে না যে, তার মনিব মৃত্যুবরণ করেছে। অথচ মোদীর সেনারা সর্বদা কাশ্মীরের মুসলমানদের জান-মাল-ইজ্জত লুট করছে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার জন্য ইতোমধ্যে ২৫ হাজার অ-কাশ্মীরীদের নাগরিকত্ব দিয়েছে। অন্যদিকে সীমান্তে নিরীহ নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা করছে প্রতিদিন। এখন বর্ষা মওসুমে বাঁধের পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারছে। বাবরী মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণকারী মোদীর রাজধানী দিল্লিতে পঙ্গপালের হামলা শুরু হলেও মোদী এখনো তওবা করেনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত-রাশিয়া-চীন কেউ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। ইসরাইলের ইহুদী প্রশাসন গাজায় বিমান হামলা করে ফিলিস্তীনের নির্যাতিত ও অবরুদ্ধ মুসলিমদের হত্যা করে চলেছে। অথচ করোনা ভাইরাস সে দেশেও হানা দিয়েছে। আমেরিকায় করোনার হানা সবচেয়ে বেশি হলেও সেদেশের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হুমকি বন্ধ হয়নি। তারা যে কেবল নগদ স্বার্থ দেখছেন। স্থায়ী স্বার্থের খবর জানে না। আর তাই মানুষ ও মনুষ্যত্ব কোনটাই এদের কাছে নিরাপদ নয়।
করোনার সাথে আবার আসছে ডেঙ্গু ও বন্যা। এ অবস্থায় আল্লাহ্র অনুগ্রহ কামনার সাথে সাথে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবলম্বন করা আবশ্যক। সেই সাথে দেশে দেশে ও মানুষে মানুষে পরস্পরে সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও মানবতা প্রদর্শন করা অপরিহার্য। অতএব, হে মানুষ! সর্বাগ্রে মনুষ্যত্বকে বাঁচাও। করোনার সাথে যুদ্ধের ফালতু হুমকি ছাড়। বরং মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঠেকাও। করোনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তাকে ভয় করো। তাঁর বিধান মেনে চলো। মানুষকে ভালবাস ও মানুষের সেবার মাধ্যমে আল্লাহ্র অনুগ্রহ তালাশ কর। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!।
লেখক : আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ ও সাবেক শিক্ষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।