পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানুষের মধ্যে কথায় কথায় মামলা ঠুকে দেয়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে গিয়ে আদালতগুলোতে যেমন মামলা জট বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বিচারপ্রার্থীরা আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আদালতগুলোতে বিচারকের অনুপাতে মামলার সংখ্যা দেখলে বোঝা যায়, এ অঙ্গন কতটা চাপের মধ্যে রয়েছে। নিম্ম ও বিচারিক আদালতে মামলার জট কমাতে এক সময় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির উপর জোর দিয়েছিল সরকার। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্র স্থানীয় প্রশাসনে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সদিচ্ছার অভাবে এ উদ্যোগ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। মানহানি মামলার আধিক্য রোধে বাধ্যতামূলকভাবে কোর্টফি বা খরচ বাড়িয়ে দেয়ায় গত কয়েক বছরে এ মামলার সংখ্যা অনেকাংশে কমে এসেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নিম্ম আদালত থেকে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ পর্যন্ত বিচার ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে অত্যধিক মামলার জটে এবং চাপে হিমশিম অবস্থার মধ্যে পড়েছে। বিচারিক আদালতগুলোতে এই মুহূর্তে ৩১ লাখের বেশি মামলার বিপরীতে বিচারক আছেন ২ হাজারের কম। হাইকোর্ট বিভাগে ৯৭ জন বিচারকের হাতে প্রায় ৫ লাখ মামলা, আর আপীল বিভাগের ৭ বিচারপতির হাতে মামলার সংখ্যা প্রায় ২২ হাজার ৬০০। এর মধ্যেই প্রতিদিন বেড়ে চলেছে নতুন মামলার সংখ্যা। আইনজ্ঞ ও বিচার সংশ্লিষ্টরা এই অস্বাভাবিক মামলা জটের জন্য একদিকে যেমন জনসংখ্যা অনুপাতে বিচারকের স্বল্পতাকে দায়ী করছেন, অন্যদিকে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা এবং সহজেই যেনতেন বিষয়ে যারতার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে হয়রানি আদালত অঙ্গণকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে মামলাজট ও মামলা সংখ্যা কমিয়ে আনতে বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তির উদ্যোগকে কার্যকর করার পাশাপাশি অযাচিত মামলার পেছনের সামাজিক-রাজনৈতিক কারণগুলোর দিকে নজর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সব মামলাই আদালতে বিচারযোগ্য নয়। অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় বা মিথ্যা মামলার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি অস্বাভাবিক বিলম্বিত হয়। বিচারকাজ বিলম্বিত হওয়ার কারণে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। এতে ‘জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড’-এর মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে, একশ্রেণীর উকিলও কম দায়ী নয়। তারা নিজেদের আর্থিক সুবিধার জন্য মামলা চালিয়ে নিতে দীর্ঘসূত্রীতার পথ অবলম্বন করে। এটা তাদের এক ধরনের ব্যবসার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। উকিলদের এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে মামলার জট যেমন বাড়তে থাকবে, তেমনি আদালতসহ সংশ্লিষ্টদের উপর থেকে অত্যধিক চাপ কমানো সম্ভব নয়। মামলার জট কমাতে সরকারকে যেমন বিচারক ও বিচার ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করতে হচ্ছে, তেমনি কোটি কোটি টাকাও ব্যয় হচ্ছে। এ তুলনায় রাজস্ব পাচ্ছে না। এটা যেন এক ‘এন্ডলেস’ কাজে পরিণত হয়েছে। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এ থেকে উত্তরণে, মামলা অনুপাতে বিচারক নিয়োগের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার সংখ্যা কমিয়ে আনা জরুরী। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের দেয়া একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে, যা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে আদালতগুলোতে মামলার সংখ্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। হাইকোর্টের অবজারভেশনে বলা হয়েছে, আমলযোগ্য ধারায় মামলা গ্রহণ করার পূর্বে মামলার প্রাথমিক তথ্যগুলো যাচাই করে নিতে হবে এবং পুলিশের যথাযথ তদন্তের পর তা আমলযোগ্য কিনা তা বিবেচনা করতে হবে। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে পুলিশের যথাযথ দায়িত্ব পালনে অনীহার বিষয়টি জড়িয়ে আছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশের পেশাদারিত্বের অভাব এবং দুর্নীতির কারণে আদালতে মামলার সংখ্যা বেড়েছে। আবার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার কারণেও আদালতে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুশাসন নিশ্চিত করার নিমিত্তে এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্র বিনির্মানে এ ধরণের প্রবণতা দীর্ঘদিন চলতে পারে না।
রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এক শ্রেণীর মানুষ সাধরণ মানুষের সম্পদ লুন্ঠন, দখল ও জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যক্তিই আবার দুর্বল প্রতিপক্ষকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করছে। মামলার বিষয়টিকে অত্যন্ত সহজ বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। যে সমস্যা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব, তা না করে একশ্রেণীর মানুষ কূটকৌশলে মামলা করতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। কারণ, ১০ টাকা কোর্টফি দিয়ে মামলা করা যায়। এর ফলে অনাকাক্সিক্ষত মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথে একশ্রেণীর উকিলও জড়িত। তারা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে ভুক্তভোগীকে মামলা করতে প্ররোচিত করে। এতে উকিলের খরচ ও আদালতে হাজিরার ধকল পোহাতে বাধ্য হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে। মানহানি মামলার উপর অতিরিক্ত কোর্ট ফি এবং ভ্যাট আরোপ করায় মামলার সংখ্যা যেমন অনেক কমেছে, তেমনি আদালতের রাজস্ব আয়ও বেড়েছে। আমরা মনে করি, অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও উচ্চহারে কোর্ট ফি ও খরচ নির্ধারণ করা উচিত। এতে কম আমলযোগ্য বা আমলযোগ্য নয় এমন মামলা করা থেকে মানুষ নিরুৎসাহী হবে এবং আদালতেও মামলার চাপ কমবে। স্থানীয় সালিশে অথবা বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তির মাধ্যমে সমাধানযোগ্য অভিযোগগুলো যাতে আদালতে না আনতে হয় সেজন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগকে শক্তিশালী স্বচ্ছ ও সাধারণ মানুষের আস্থায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। মামলার তদন্ত ও সাক্ষী হাজিরার বিষয়ে পুলিশকে আরো দক্ষ, জনবান্ধব ও বিচার সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি, বিরোধ বেড়ে যাওয়া ও মামলা বৃদ্ধির পেছনে যেসব সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সক্রিয় রয়েছে, সে সব বিষয়গুলোর উপর রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।