পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তফা কামাল। ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা’ শিরোনামে বাংলাদেশের এটি ৪৯তম, অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় ও আওয়ামী লীগ সরকারের ২১তম বাজেট। অর্থমন্ত্রী হিসাবে আ. হ. ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রথম পেশ করেন। সে বছর ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ ও অর্থনীতির জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে প্রাক্কলিত জিডিপির আকার ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে আগামী অর্থ-বছরে মোট জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
বিশ^ ব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছরে বৈশি^ক অর্থনীতি সংকুচিত হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এদেশের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশের ওপর যাবে না বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ধারণা। চলতি অর্থ-বছরে (২০১৯-২০) বাজেটে ঘোষিত রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত বাজেটের যে প্রবৃদ্ধির (৮.২%) তা অর্জন করা কঠিন। সিপিডি বলেছে, প্রবৃদ্ধির হার ২.৫০ শতাংশের বেশি হবে না।
কোভিড-১৯ কতদিন থাকবে, অর্থনৈতিক সংকট কত দিন বিরাজ করবে, তার উপর নির্ভর করবে বাজেট বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কোভিড-১৯ মহামারিতে প্রবৃদ্ধি ভিত্তিক উন্নয়ন কমে মানুষের উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দরিদ্র আরো বেশি দরিদ্র ও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে মানুষের জীবন রক্ষার প্রাক্কালে বাজেট প্রণয়ন, বাজেটে অর্থায়ন সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সময় প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মানুষের জীবনের গুরুত্ব, জীবন রক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিৎ।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান এর প্রতিফলন, কেমন হবে সেটার উপর সবার নজর রয়েছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশের স্বাস্থ্য খাতের যে বেহাল দশা তা সকলের নিকট পরিষ্কার। তাই বাজেটে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সরকারের কী পরিকল্পনা সেদিকে সকলের নজর ছিল। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ নিয়ে কিছু না বলে বলা দরকার এখাতে অবকাঠামোগত উন্নতি দরকার। এখাতের অপচয় রোধ করতে হবে। এখাতের উন্নতির জন্য সরকার তাৎক্ষণিকভাবে যেসকল জনবল নিয়োগ দিয়েছে এবং দিচ্ছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এ সকল নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তার নার্স ও টেকনোলজিস্টদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদেরকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এখন প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে মোটা দাগে কয়েকটি কথা বলা দরকার। এ বাজেটে আয় ব্যয়ের সমন্বয় করা বড় কঠিন হবে। বর্তমান খারাপ পরিস্থিতিতেও এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে, যা বাস্তবায়ন করা কঠিন।
ব্যয়ের খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম ভর্তুকি, প্রণোদনা, অবসর ভাতা, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়। এসব খাতে আয়ের টাকা দিয়ে ব্যয় কুলাবে না। ফলে বড় আকারের ঋণ করতে হবে। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ। ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে ৮৪৯৮০ কোটি টাকা, সঞ্চয় পত্র থেকে ২৫ হাজার কোটি ও বিদেশি ঋণ ৭৬ হাজার কোটি টাকা নেয়া হবে। এতে বিনিয়োগ কমে যাবে, কর্মসংস্থানের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ না নিয়ে বরং খেলাপি ঋণ কীভাবে আদায় করা যায়, কীভাবে ব্যাংক খাতে শৃংখলা আনা যায় সে দিকে নজর দেয়া উচিৎ। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত বাজেটে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এ বাজেটটি একটি সাধারণ বাজেট হয়েছে। করোনার মোকাবিলার চেষ্টা এ বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। এসময়ে আর্থিক খাতের সংস্কার করার বিরাট সুযোগ রয়েছে, কিন্তু বাজেটে তার দেখা মেলেনি।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিষয়টি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক। এ সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিৎ। বলা হয়েছে, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর প্রদান করলেই এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করা হবে না। এর ফলে হয়তো কিছু ফ্ল্যাট, বাড়ি ক্রয় করা হবে ঠিকই কিন্তু অর্থনীতি ও দুর্নীতি রোধে কোনো ভূমিকা রাখবে বলে কেউ মনে করে না। বাজেটে মুদ্রাস্ফিতি ধরা হয়েছে ৫.৪%। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, কারণ মানুষের হাতে এ মুহূর্তে টাকা নেই, খরচ বেশি করার সুযোগ নেই, তাই মুদ্রাস্ফিতি ঠিক থাকতে পারে। তবে কৃষিতে প্রতিবারের মতই ভর্তুকি বাড়ানো হলেও কৃষিকে আরও আধুনিকায়ন ও টেকসই করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। কারণ, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর জোর না দিলে মানুষের জীবন হুমকির মধ্যে পড়বে।
যেসব শ্রমিক বিদেশ থেকে ফেরত আসছে তাদেরকে কর্মে নিয়োজিত করার জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকা উচিৎ। বেকার যুবক, শ্রমিক যারা কাজ হারাচ্ছে বা হারাবে তাদেরকে কাজে ফিরিয়ে আনা অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেটে পোশাক শিল্পের পূর্বের সুযোগ বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে, পাশাপাশি পণ্য রপ্তানিতে উৎস কর ০.৫ শতাংশের বিষয়টি প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এ খাতে কোনো শ্রমিক যেন চাকরি না হারায় সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও ফান্ড থাকা চাই। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব কতদূর যায় সেটার উপর এ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতা নির্ভর করবে।
কোভিড-১৯ এ স্বাস্থ্য সংকটের পাশাপাশি উদ্ভূত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে কৃষি উৎপাদন ও বহুমুখী বাজারজাতকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারিত করে বেকার ও কর্মহীন মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া উচিৎ।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তায় ৯৫ হাজার ১ শত ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ। তাছাড়া এ বছরে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ১১ লাখ ৫ হাজার সুবিধাভোগী। আগামী অর্থবছরে ৫০ লাখ দরিদ্র কর্মজীবী মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হবে। তাছাড়া অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মুদ্রা সরবারহের উপর জোর দেয়া হবে। মুদ্রা সরবারাহ বৃদ্ধি করা হবে। আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং, ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থপাচার ও কর ফাঁকির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবারের বাজেটে এসব হিসাব ভুয়া হিসাব প্রমাণিত হলে তার ওপর ৫০ শতাংশ হারে কর আরোপের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পের কর ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বাজেটে এসব ভালো দিক থাকলেও এনবিআর এর জন্যে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা বর্তমান পরিস্থিতিতে একেবারেই অনভিপ্রেত ও অগ্রহণযোগ্য। বর্তমানে পুঁজি বাজার মৃতপ্রায়। ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থায় পুঁজিবাজার এর আবস্থা আরও নাজুক হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তবে বাজেটে করমুক্ত আয় সীমা ৩ লাখ টাকা করায় সাধরাণ মানুষের ভোগান্তি কিছুটা কমবে। করমুক্ত সর্বনি¤œ হার এবং কর্পোরেট ব্যয় হার কমানোর উদ্যোগ ভালো হয়েছে।
প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ানো একটি স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গেছে। তাছাড়া প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা, রাজস্ব আয়, এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিশাল আকারে বাজেট দেখে মনে হয়, এটি করোনাকালীন মহামারির কোনো বাজেট নয়, স্বাভাবিক সময়ের একটি সাধারণ বাজেট। বাজেটে দেশের মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যার চিত্র, স্বাস্থ্য , ব্যবসা-বাণিজ্যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সমস্যার চিত্র যথাযথভাবে ফুটে উঠেনি। বৈশি^ক মহামারিতে সমাজের উচ্চ, মধ্য, নি¤œ ও খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগের বাস্তবচিত্র বাজেটে ফুটে উঠলে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো থেকে এই সংকটকালীন সময়ে বিভিন্ন অনুদান সাহায্য পেতে সহজ হতো। বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ব্যাবস্থা থেকে বেশি ঋণ ও বৈদেশিক উৎস থেকেও বেশি ঋণ পাওয়ার আশা করা হয়েছে। যেটা পাওয়ায় চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ ব্যাংকিং সেক্টর বর্তমান চরম সংকটজনক অবস্থায় আছে। এখাতে সংস্কার করার ও ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা থাকলেও তা আজও সম্ভব হয়নি। দেশের ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী থাকলে বর্তমান নাজুক পিরিস্থিতিতে বাজেট প্রণয়ন অনেক সহজ হতো। অথচ দুর্বল ও প্রায় ভঙ্গুর এ সেক্টরের উপর ঋণ ও প্রণোদনার বোঝা চাপিয়ে দেওয়ায় বেসরকারি ঋণ প্রবাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা থাকলে বাজেটটি আরোও বাস্তবমুখী হতো ও বাস্তবায়ন সহজ হতো। বাজেটে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কর কমানো হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম কমতে পারে। নি¤œ ও প্রান্তিকদের জন্য আগামী অর্থ বছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা বাড়ানো হয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে তা প্রকৃত ভুক্তভোগীরা যাতে পায় সে বিষয়ে কঠোর নজরদারী দরকার।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।