পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমাদের দেশে যখন পিতামাতা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন, বেশিরভাগই চিন্তা করেন তাদের ছেলেমেয়েরা ডাক্তার, নয়তো ইঞ্জিনিয়ার হবে। কেউ যদি বলে সে এমবিবিএস পাশ করেছে, সবাই বুঝে নেয় সে ডাক্তার। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার শব্দযুগলও এ দেশের মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। কিন্তু কেউ যখন বলে সে মাইক্রোবায়োলজি গ্র্যাজুয়েট- তখন অনেকেই বলে উঠেন, ‘সেটা আবার কী?’
‘মাইক্রোবায়োলজিস্ট’ মানে কী? তা জানার আগে চলুন জেনে নেই মাইক্রোবায়োলজিস্টরা এখন কী করছেন দেশে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা টেস্টিং ল্যাবগুলোতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট মাইক্রোবায়োলজিস্টরা ভলান্টিয়ার হিসেবে টেকনিশিয়ানদের ট্রেনিং দেয়ার পাশাপাশি নিজেরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনোরকম স্বাস্থ্যবীমা ছাড়াই করোনা টেস্টিং-এর কাজ করে যাচ্ছেন। শহরাঞ্চলের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে সরকারি চাকরিজীবীরা যাতে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেজন্য মাইক্রোবায়োলজিস্টগণ তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে করোনার প্রথম জিনোম সিকুয়েন্সিং সম্পন্ন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ড. সমীর সাহার নেতৃত্বে, তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে। সরকারি অর্থায়ন ছাড়াই তিনি নিজের উদ্যোগে বিদেশি সংস্থার আর্থিক সহায়তায় এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন। করোনার একদম শুরুর দিনগুলোতে যখন হঠাৎ দেশে স্যানিটাইজারের ঘাটতি পড়লো, মাইক্রোবায়োলজির শিক্ষার্থীরা তখন নিজেদের অর্থায়নে, শিক্ষকদের সহায়তায় স্যানিটাইজার বানিয়ে হাসপাতালে এবং নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করেছে। সবকয়টি কাজেই মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নিরলসভাবে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছে বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিক্যুলার বায়োলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি প্রভৃতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
উন্নত দেশে মাইক্রোবায়োলজিস্ট মানে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তারদের পাশাপাশি পরিপূরক হিসেবে নিয়োজিত মহৎ একটি পেশা। মাইক্রোবায়োলজিস্ট মানে গবেষণার মাধ্যমে দেশের নীতি নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে এরকম সম্মানিত একটি পেশা। আর বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাইক্রোবায়োলজিস্ট মানে দেশে পর্যাপ্ত চাকরি ও গবেষণার সুযোগের অভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো, কিংবা নিজের ফিল্ড পরিবর্তনে বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হওয়া। যে দেশে ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকার বাজেটের বিপরীতে গবেষণায় বরাদ্দের পরিমাণ সর্বোসাকুল্যে মাত্র ০.০০৯৫ শতাংশ, সে দেশের গবেষণাভিত্তিক বিষয়ের শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী এরকম পরিণতিই হয়তো স্বাভাবিক!
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সোসাইটি অফ মাইক্রোবায়োলজি প্রতিষ্ঠার পর, ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগত ৪১ বছরে দেশের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এত বছরেও বিসিএস এর টেকনিক্যাল ক্যাডারে মাইক্রোবায়োলজিস্টদের কোনো ঠাঁই মিলেনি। ফিসারিজ (মৎস্য) ক্যাডার হিসেবে রয়েছে ‘মাইক্রোবায়োলজিস্ট’ পদ, যাতে আবেদন করার অনুমতি নেই মাইক্রোবায়োলজির শিক্ষার্থীদের। অথচ দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে বিসিএস-এ মাইক্রোবায়োলজিস্টদের জন্য আলাদা করে ক্যাডার থাকাটা যে কতটা জরুরি, কোভিড-১৯ এর চলমান সংকটময় মুহূর্তে তা ভালোভাবেই টের পাওয়া গিয়েছে।
বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে লেকচারার পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এর নীতিমালা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। প্রতিটি মেডিকেলে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ থাকলেও, সেখানে আবেদনের সুযোগ দেয়া হয় শুধুই এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তারদের। তবে কী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে ৪ বছর গ্র্যাজুয়েশন, ১ বছর মাস্টার্স করে আসা শিক্ষার্থীদের মাইক্রোবায়োলজি বিষয়ক জ্ঞান কম কিংবা এমবিবিএস এর মাইক্রোবায়োলজির সিলেবাস আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির সিলেবাসে অনেক তফাৎ, এরকম কিছু? বিএমডিসি কর্তৃক প্রণীত এমবিবিএস এর মাইক্রোবায়োলজি সিলেবাসের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি সিলেবাসের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা যাক। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের সিলেবাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ।
এমবিবিএস এর তৃতীয় বর্ষের একটি সাবজেক্ট হিসেবে মাইক্রোবায়োলজি পড়ানো হয়। এই সাবজেক্টের সিলেবাসে ৮টি টপিক রয়েছে। এগুলো হলো, জেনারেল ব্যাকটেরিওলজি, সিস্টেমিক ব্যাকটেরিওলজি, ইমিউনলজি, প্যারাসাইটোলজি, ভাইরোলজি, মাইকোলজি, ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলজি এবং ব্যবহারিক। এগুলোর সবকিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষে ফান্ডামেন্টাল মাইক্রোবায়োলজি, বেসিক টেকনিকস ইন মাইক্রোবায়োলজি, দ্বিতীয় বর্ষে জেনারেল মাইক্রোবায়োলজি, মাইক্রোবিয়াল মেটাবলিজম, মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজি-১, অ্যাপ্লাইড মাইকোলজি, তৃতীয় বর্ষের ভাইরোলজি-১, ইমিউনোলজি-১, মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজি-২, ফার্মাসিউটিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি, চতুর্থ বর্ষের ভাইরোলজি-২, ইমিউনোলজি-২, ডায়াগনস্টিক মাইক্রোবায়োলজি, অ্যানালাইটিকাল মাইক্রোবায়োলজি, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড এপিডেমায়োলজি এবং মাস্টার্সের মলিক্যুলার ভাইরোলজি অ্যান্ড অনকোলজি, এপিডেমায়োলজি অফ ইনফেকশাস ডিজিসেস কোর্সের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস এর মাইক্রোবায়োলজি সিলেবাসের সকল টপিকই পড়া হয়ে যায়। এসব কোর্সের বাইরেও মাইক্রোবায়োলজি সংক্রান্ত আরও ৩০টা কোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজিতে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থী পড়ে থাকেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, করোনা ভাইরাস সনাক্তকরণে ব্যবহৃত আরটি-পিসিআর অথবা অন্যান্য অনেক জীবাণু সনাক্তকরণের আন্তর্জাতিক গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পিসিআর টেকনিক একজন এমবিবিএস শিক্ষার্থীকে হাতে কলমে শেখানো হয় না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ থেকে অনার্স মাস্টার্স পাশ করা সকলকেই এই দুইটি পদ্ধতির নিয়ম, ট্রাবলশ্যুটিংয়ের তত্ত্বীয় জ্ঞান ইত্যাদি যেমন শেখানো হয়, অনেকেই তাদের থিসিস/প্রজেক্টে বহুবার এই পদ্ধতি গবেষণার নিমিত্তে সম্পাদন করে রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠেন। কাজেই মেডিকেল কলেজগুলোতে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের লেকচারার নিয়োগ পরীক্ষায় এমবিবিএস ডাক্তারদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্টদেরকেও সুযোগ দেয়া যৌক্তিক বলে মনে করি।
আপনি যদি জাতীয় ক্রিকেট দলের সেরা একাদশ গঠন করতে চান, আপনি অবশ্যই চাইবেন একটি ভারসাম্যপূর্ণ দল গঠন করতে। টিমে ব্যাটসম্যান থাকবে, বোলার থাকবে, উইকেট কিপার থাকবে। আপনি যদি ১১ জনই ব্যাটসম্যান নিয়ে দল গঠন করেন, নিশ্চয়ই খেলার ফলাফল খুব ভালো হবে না। করোনার এই বৈশ্বিক মহামারীতে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনো প্রতিরোধে জাতীয় সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ধরনের কমিটিতে ডাক্তার, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, মলিক্যুলার বায়োলজিস্ট, পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট, ইকোনমিস্ট প্রভৃতি বিভিন্ন ঘরানার এক্সপার্টদের যুক্ত করার কথা। কিন্তু এগারো জন ব্যাটসম্যান এর মতোই জাতীয় কমিটিতেও শুধুই ডাক্তারদেরকে রাখা হয়েছে। যদি এই কমিটিতে ডাক্তারদের পাশাপাশি মহামারী সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞ মানুষদের নিয়ে সত্যিকার অর্থেই ভারসাম্যপূর্ণ একটি সমন্বয় করা হতো, তবে হয়তো আমরা আরও ভালোভাবে করোনা মোকাবেলা করতে পারতাম।
কাজেই, অতি শীঘ্রই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে মাইক্রোবায়োলজিস্ট ক্যাডার সৃষ্টি, মেডিকেল সেক্টরে মাইক্রোবায়োলজিস্টদের অন্তর্ভুক্তিসহ গবেষণাবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করে গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত সকল ডিসিপ্লিনের মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে দেশে থেকে দেশের উন্নয়নে গবেষণার সুযোগ করে দেয়া এখন সময়ের দাবি।
লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সুপারিশকৃত), বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।