Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট

| প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০২০, ১২:০০ এএম

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন। এটি দেশের ৪৯ তম এবং অর্থমন্ত্রীর দ্বিতীয় বাজেট পেশ। এবারের বাজেট এমন এক সময় পেশ করা হয়েছে, যখন করোনার কারণে আমাদের অর্থনীতি চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ পরিস্থিতি শুধু আমাদের দেশে নয়, পুরো বিশ্বের অর্থনীতিকে টালমাটাল করে দিয়েছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতির চেয়েও ভয়াবহ অবস্থায় নিপতিত। এমন দুঃসময়ে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের বাজেট তৈরি এবং তা উপস্থাপন করা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল একটি বিষয়। অর্থমন্ত্রী অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার সাথে অর্থনীতির মহামন্দাবস্থার সার্বিক দিক এবং করোনাকালের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা বিবেচনা করে এ বাজেট উপস্থাপন করেছেন। তিনি নিজেও স্বীকার করে বলেছেন, এ বাজেট কোনো স্বাভাবিক ও গতানুগতিক বাজেট নয়, এটি ভিন্ন বাজেট। এ বাজেট মানুষের জীবন রক্ষার, কর্মসংস্থান ও চিকিৎসা দেয়ার। এ বাজেটে দুটো বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রথমত, বিগত দশ বছরে আমাদের উন্নতি ও অগ্রগতির ভিত্তি এবং দ্বিতীয়ত করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর আমাদের অর্থনীতি নিয়ে সারাবিশ্বের চিন্তাভাবনা। বাজেট প্রণয়নে অর্থমন্ত্রীর এ চিন্তাভাবনা নিঃসন্দেহে বাস্তবভিত্তিক এবং দূরদর্শী। এ বাজেট বাস্তবানুগ এবং তা বাস্তবায়নযোগ্য। অর্থনীতির চরম মন্দাববস্থার মধ্যে এ ধরনের সময়োপযোগী একটি বাজেট পেশ করার জন্য আমরা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে আন্তরিক অভিবাদন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
এবারের (২০২০-২০২১) বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০২০) বাজেট ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে জিডিপি টার্গেট করা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, করোনাকালীন মন্দাবস্থার মধ্যেও নতুন বাজেটের আকার কমেনি বরং বেড়েছে। এদিক থেকে এটি একটি সাহসী ও ইতিবাচক বাজেট। স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তবায়নের বাজেট। সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগে আমরা টাকা ব্যয় করব, তারপর আয় করব। বিগত সময়ের বাজেটের বৈশিষ্ট্য ছিল, আগে আয়, তারপর ব্যয়। তিনি এ কথাও বলেছেন, অর্থ কোথা থেকে আসবে, তা পরে দেখা যাবে। অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে, জনকল্যাণের কথা যেমন বিধৃত হয়েছে, তেমনি বাজেট বাস্তবায়নের দৃঢ়তা প্রকাশিত হয়েছে। তা নাহলে, ১ কোটি ৯০ হাজার কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি থাকা সত্তে¡ও এমন কথা বলা কঠিন ছিল। বাজেটে ঘাটতি পূরণে মূল অর্থের জোগান হিসেবে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভর করা হয়েছে। ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮৩ টাকা নেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ব্যাংক এ অর্থ জোগান দিতে পারবে। কোনো সমস্যা হবে না। এছাড়া ঘাটতির অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন, করোনাকাল দীর্ঘায়িত না হলে তাকে দেয়া টার্গেট পূরণ করা অসম্ভব হবে না। এবারের বাজেট যে অর্থনীতিকে ধরে রাখা এবং চাঙা করার, তাতে সন্দেহ নেই। করমুক্ত ব্যক্তিখাতের আয়সীমা বৃদ্ধি, কর্পোরেট কর কমানো, বেসরকারি বিনিয়োগে ১২ শতাংশ টার্গেট নির্ধারণ, অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি, সর্বোপরি আমাদের অর্থনীতির মূলভিত্তি কৃষিখাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার মধ্য দিয়ে এটা প্রকাশিত হয়েছে। এসব সুবিধা ও টার্গেট পূরণ করতে সক্ষম হলে দুর্বল হয়ে পড়া অর্থনীতিকে সবল করা অসম্ভব কিছু হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, অর্থনীতিকে সচল করতে এবং রাখতে আমাদের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক খাতগুলোকে শক্তিশালী করা ছাড়া বিকল্প নেই। বিশ্বমন্দায় বিদেশী আর্থিক উৎসের ওপর নির্ভর করা সমীচীন হবে না। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম মূল দুই স্তম্ভ গার্মেন্ট ও বৈদেশিক রেমিট্যান্স। এই দুই খাত এখন পড়তির দিকে। অর্থের বড় এই দুটি উৎসের উন্নতির বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। ফলে আমাদের বিদ্যমান আভ্যন্তরীণ খাতগুলোকে শক্তিশালী করার দিকে নজর দিতে হবে। যেকোনো মূল্যে আমাদের কৃষিখাতকে এগিয়ে নিতে হবে। কৃষিখাতে প্রণোদনা বৃদ্ধি, কৃষিঋণ আরো সুলভ করা, কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি ও সরবরাহ ব্যবস্থা সহজ করার সর্বাত্মক পন্থা অবলম্বন করতে হবে। উৎপাদিত ফসলের অপচয় এবং কৃষক যাতে ফসল নিয়ে হতাশায় না ভোগে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে সুযোগ-সুবিধা অবারিত করতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের লাভের অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবধরনের বাধা দূর করতে হবে। এতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অধিক বিনিয়োগে উৎসাহী হবে। করোনার কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে চীন থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান সরে আসবে, তাদের আকৃষ্ট করতে এবং দেশে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালানোর পাশাপাশি বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোকে বিনিয়োগকারীদের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা যাতে দুর্নীতি দমন কমিশন ও এনবিআর-এর হয়রানির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতকে অধিক সক্ষম করে তোলা সময়ের দাবী। এবারের বাজেটে এ খাতে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি থোক বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এ খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ দেয়া হলেও, তা যথাযথভাবে ব্যয় করা হয় না। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে বিপুল অর্থের অপচয় হয়। খাতটিকে সক্ষম করে তুলতে যা বরাদ্দ দেয়া হয়, তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে একে অনেক দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব। শুধু স্বাস্থ্যখাতেই নয়, যেসব খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, সেসব খাতের বরাদ্দের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। অপ্রয়োজনীয় ও কমগুরুত্বপূর্ণ খাত বা প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে যেসব খাত বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে সক্ষম তাদের বেশি বরাদ্দ দিতে হবে। সংবাদপত্র শিল্পে কোনো ধরনের সুবিধা না দেয়ায় অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। দুঃখজনক। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ এ খাতের সমস্যাগুলো নিয়ে দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি ছিল।
বাজেট নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন সংস্থা তাদের প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। তারা খাতওয়ারি বক্তব্য তুলে ধরেছে। গতানুগতিক ও অতিআশাবদের বাজেট আখ্যা দিয়ে অর্থের যোগান এবং তা পাওয়া নিয়ে সংশয় নিয়ে বিভিন্ন মতামত দিয়েছে। আমরা মনে করি, তাদের মতামত একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে সরকারকে সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে সংশোধন করার থাকলে তা করা উচিৎ। এ কথাও অনস্বীকার্য, এবারের বাজেট এমন এক দুঃসময়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে মানুষের প্রয়োজনীয়তা এবং বেঁচে থাকাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অনেক কিছুই অবারিত করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মুক্ত বায়ুধারার সাথে অনুসঙ্গ হয়ে কিছু খড়কুটোও উড়ে আসে। জরুরি পরিস্থিতিতে এমন অনেক কিছুই মেনে নিতে হবে। এ বিষয়গুলোও আমাদের বোধবিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। দুঃসময়ে আশাবাদের বাজেট হওয়া এবং দেয়া অস্বাভাবিক ও অকল্পনীয় নয়। তবে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, যে আশা ও স্বপ্ন বাজেটের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, তা বাস্তবায়ণে জোর প্রচেষ্টা চালানো। চাঁদে যেতে না পারলেও তার কাছাকাছি যাতে যাওয়া যায়, এমন অবিচল লক্ষ্য থাকতে হবে। অর্থমন্ত্রী যে বাজেট দিয়েছেন, তা মানুষের স্বপ্ন ও আশা বাঁচিয়ে রাখা এবং স্বনির্ভর অর্থনীতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন এর বাস্তবায়নে সঠিক পরিকল্পনা ও দিক নির্দেশনা এবং যাদের দ্বারা বাস্তবায়ন করা হবে তাদের দক্ষতা ও সদিচ্ছা। অর্থমন্ত্রীর আশা ও স্বপ্নের বাজেট বাস্তবে রূপায়িত হোক, এ প্রত্যাশা রইল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজেট

১৩ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন