পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীসহ ৩০ জন অভিবাসী হত্যার ঘটনা অত্যন্ত বেদনাবহ ও মর্মান্তিক। জানা গেছে, বাংলাদেশী ছাড়া নিহত অপর ৪ জন সুদানী নাগরিক। একই ঘটনায় ১১জন বাংলাদেশী আহত হয়েছে, যাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই চরম বর্বরোচিত হতাহতের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তাদের নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের নেই। এদিকে হতাহতদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাদের মাতম ও হাহাকারের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আমরা তাদের প্রতি জানাই আন্তরিক সহমর্মিতা ও সহানুভূতি। মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে এই হতাহত ব্যক্তিরা যে লিবিয়া গিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে সিআইডি পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। কয়েকজনকে চিহ্নিত করে তদন্ত শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র-উৎসের খবর অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে ৩৮ জন বাংলাদেশী তরুণ পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে প্রথমে ভারতে যায়। এরপর দুবাই হয়ে লিবিয়ায় যায়। লিবিয়া তাদের গন্তব্যস্থল ছিল না, গন্তব্যস্থল ইতালি বা ইউরোপীয় কোনো দেশ। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য। তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তার আগেই নিষ্ঠুর ঘাতকরা তাদের ২৬ জনকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছে। বাকী ১১ জনকে আহত করে হাসপাতালে যেতে বাধ্য করেছে। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, সুদানী কয়েকজনের সঙ্গে এই বাংলাদেশী তরুণরা দু’দফা অপহরণের শিকার হয়। প্রথম দফায় মুক্তিপণের মাধ্যমে তারা ছাড়া পায়। দ্বিতীয় দফায় অপহরণকারীরা মুক্তিপণের দাবিতে তাদের ওপর অকথ্য নিপীড়ন ও নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে অপহরণকারী চক্রের মূল হোতাসহ দু’জন তাদের হাতে নিহত হয়। এই হত্যার প্রতিশোধ নিতেই অপহরণকারী চক্রের লোকেরা তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং হতাহতের এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, ২০১৫ সালের পর থেকে লিবিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমবাজার বন্ধ। সেখানে বৈধভাবে শ্রমিক যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই নেতিবাচক অবস্থা সত্তে¡ও বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় শ্রমিক যাওয়া অব্যাহত আছে। যারা লিবিয়ায় যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই আসলে ইউরোপ যাওয়ার জন্য যাচ্ছে। লিবিয়াকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশীসহ আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রগুলো এই রুটটি কাজে লাগিয়ে তাদের অবৈধ কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে তারা মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ইউরোপে অভিবাসী হতে ইচ্ছুক বাংলাদেশীদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার দীর্ঘদিনের একটি বাস্তবতা। এটি কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। বিশ্বে মানবপাচারের দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। স্মরণ করা যেতে পারে, মানব পাচারবিরোধী আইন থাকলেও তার প্রয়োগ ও কার্যকারিতা নেই। ইতোপূর্বে কয়েকজন মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও কিছু হয়নি; তারা জামিন পেয়েছে। বাংলাদেশী মানব পাচারকারীরা এতটাই আস্থাশীল ও শক্তিশালী যে, পাচারবিরোধী প্রচারণা, আইন ও ব্যবস্থা কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। তাদের খপ্পরে পড়ে কত তরুণ বাংলাদেশী যে, সাগরে ও পাহাড়-জঙ্গলে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে, অপহৃত হয়েছে, পলাতক জীবন কাটিয়েছে কিংবা কারাগারে থাকতে বাধ্য হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। বলার অপেক্ষা না, মানব পাচারকারী চক্রকে, যাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের ঘনিষ্ট যোগসাজস রয়েছে, দমন ও নির্মূল করতে না পারলে মানব পাচার ও এই ধরনের ট্রাজিক ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে লিবিয়া সরকারের কাছে বাংলাদেশী হত্যাকান্ডের বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে। এতে আদৌ কোনো কাজ হবে বলে মনে হয়না। ২০১১ সালে গাদ্দাফী সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত লিবিয়ায় একক কোনো সরকার কর্তৃত্বশীল হতে পারেনি। বিভিন্ন অস্ত্রধারী গ্রুপ ও গোষ্ঠী সেখানে সক্রিয়। জাতিসংঘস্বীকৃত একটি সরকার আছে বটে, তবে তার ক্ষমতা খুবই সীমিত। সুতরাং, হত্যাকান্ডের বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে, এমনটা আশা করা যায়না। তার চেয়ে মানব পাচারকারী চক্রকে কীভাবে দমন ও নির্মূল করা যায়, সেই চিন্তা সক্রিয়ভাবে করা উচিৎ। মানব পাচারকারী চক্র যদি দেশে না থাকে, তবে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশী তরুণদের বিদেশে পাচার করার সুযোগ আপনা আপনি রহিত হয়ে যাবে। মানব পাচারকারীদের শিকার হওয়ার পেছনে এক শ্রেণীর তরুণের অর্থলোভও কম দায়ী নয়। দ্রুত ধনী হওয়ার এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে জমিজিরাত বিক্রী বা ধারদেনার মাধ্যমে টাকা জোগাড় করে মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা প্রতারিত ও বিড়াম্বিত হয়; এমন কি জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। এইসব অনাকাঙ্খিত ঘটনা ও পরিণতি এড়াতে তরুণদের সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। লোভ ও মোহ পরিহার করতে হবে। আমরা আশা করবো, সরকার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মানব পাচারকারীদের খুঁজে বের করবে এবং উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে লিবিয়ায় যারা আটকে পড়ে আছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনবে। আরো একটি কাজ সরকারকে করতে হবে। সেটি হলো, অবৈধ পথে কিংবা মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে কেউ যাতে বিদেশমুখী না হয়, সেটা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে যাতে, কেউ মানব পাচারকারীদের খপ্পরে না পড়ে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।