যেভাবে মাছ ভাজলে ভেঙে যাবে না
বাঙালির প্রতিদিনের খাবারে মাছ তো থাকেই। এটি সব খাবারের মধ্যে পুষ্টির অন্যতম উৎস। তাড়াহুড়ো করে
অস্ত্র, গোলাবারুদ, ক্ষেপনাস্ত্র বা পারমাণবিক বোমার কোন যুদ্ধ নয় এটি; এই কয়েকটা মাস জুড়ে যেই অদৃশ্য শত্রুর কারণে সারা বিশ্বে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মিছিল তার নাম কোভিড-১৯। এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হতে হবে। এই যুদ্ধে জিততে হলে নিজের বিবেক-বুদ্ধি খাটাতে হবে এবং বিজ্ঞানকে বুঝতে হবে। কৌশল হবে যতো শক্তিশালী, ভাগ্য ততোই সহায় হবে ইনশাআল্লাহ। শেষ সময়ে লড়াই এর হাতিয়ার এখন মাত্র ৫ টি:
১. মাস্ক:
কোন কারণে বাসার বাইরে গেলেই মাস্ক পরতে হবে। বাসায় ফিরা পর্যন্ত মাস্ক খোলা যাবে না। আমার নিজেরই প্রথম প্রথম মাস্ক পরে থাকতে অস্বস্তি লাগতো, কিন্তু এখন ঠিকই অভ্যাস হয়ে গেছে। অন্যজন ব্যবহার করতেছেন না, তাই আমিও করবোনা। এই ধরণের আত্মঘাতী কথা বলবেন না প্লিজ। মাস্ক পরা নিয়ে আর নয় কোন বিতর্ক। দেখা যাচ্ছে কথা বলার সময় মাস্ক খুলে থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখার একটা প্রবণতা, এতে কিন্তু নিজেকেই রিস্কে ফেলছেন। মাস্ক পরেই কথা বলতে হবে। সার্জিক্যাল মাস্ক না পেলে কাপড়ের তৈরী তিন লেয়ারের মাস্ক পরুন, তাও ভাল। মাস্কের হাতলে বা ফিতায় শুধু ধরবেন, বডিতে স্পর্শ করা যাবেনা। কাপড়ের তৈরী তিন লেয়ারের মাস্ক ধুয়ে বারবার ব্যবহার করা যাবে। মাস্ক বিভিন্নভাবে সুরক্ষা দিবে।আক্রান্ত ব্যক্তির হাচি-কাশির মাধ্যমে ভাইরাস ৩ ঘন্টা বাতাসে থাকতে পারে। মাস্ক থাকলে সেক্ষেত্রে সুরক্ষা পাওয়া যাবে। আবার কথা বা কাশি দেয়ার সময় যে থুথু ঝরায়, মাস্ক আটকে ফেলে। তাতে কথাবলার সময় নিজের এবং অন্যের সংক্রমনের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া মাস্ক থাকলে,অবচেতন মনে নাকে-মুখেও হাত দেয়া হবেনা। পরোক্ষভাবে এটাও একটা মাস্কের উপকার কারণ ভাইরাস নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে। যেহেতু কতদিন পর্যন্ত এই ভাইরাস থাকবে সে বিষয়ে আগাম বলাটা অত্যন্ত কঠিন। তাই মনে রাখবেন ভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক পরিধান এবং নাক-মুখ-চোখে হাত স্পর্শ না করা সহ এই সব অন্যান্য স্বাস্থ্য বিধির বিকল্প নেই। আমি বলি মৃত্যু আছে বলেইতো,আমরা আপন প্রাণকে এতো ভালোবাসি। তাহলে মাস্ক পরিধান করতে-অন্যজন থেকে দূরত্ব মেনে চলতে কেন এত অনীহা?
২. সামাজিক দূরত্ব (Physical Distance):
মনে রাখবেন এখন সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে আমাদের আশেপাশের লক্ষণহীন করোনা ভাইরাস এর বাহকরা। দয়াকরে চেষ্টা করবেন অতি প্রয়োজন ছাড়া বাসার চার দেয়াল থেকে যত কম সম্ভব বের হতে।তারপরও জীবিকার তাগিদে-প্রয়োজনের তাগিদে অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই সময় বের হতে হচ্ছে। তাই বাসার বাইরে গেলে এখন আশেপাশের প্রত্যেককে সন্দেহজনক মনে করে অবশ্যই ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলবেন নিজের স্বার্থে-পরিবারের অন্য সদস্যদের স্বার্থে। বাজারে, ব্যাংকে বা রাস্তাঘাটে নির্দিষ্ট শারিরীক দূরত্ব (Physical distance) বজায় রেখে থাকতে পারলে, সেক্ষেত্রে সংক্রমনের হার অনেক কমে আসে- গবেষনায় প্রমাণিত। কিছুদিনের জন্য অসামাজিক হয়ে যেতে হবে বেচে থাকার তাগিদে। কারণ আল্লাহ না করুন, আক্রান্ত হলে কেউ আসবে না আপনার পাশে। চেষ্টা করবেন বারবার যাতে নিত্য প্রয়োজনীয় বাজারে যেতে না হয়, তাই যখন বের হবেন সেই অনুযায়ী হিসাব করে কয়েকদিনের জন্য নিয়ে আসবেন। কোন ধরণের ভিড়ের মধ্যে যাওয়াই যাবেনা এখন। বাসায়তো আপনি জানেন আপনার পরিবারের সদস্যদের শারিরীক অবস্থা। তারপরও যদি বাসার কারো এই সময়ে সাধারণ সর্দি-জ্বর হয় তবে অবশ্যই নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্ব(Physical distance) বজায় রেখে অবস্থান করবেন এবং সহযোগিতা করবেন।
৩. হাত ধোয়া:
বাইরে থেকে বাসায় এসে সবার আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে। এমনকি বাসায় থাকলেও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে সংক্রমণের এই সময়। বারবার হাত হাত ধোয়ার সময় যেনো ২০-৩০ সেকেন্ড সময় নিয়ে আংগুলের ফাক, হাতের পিছন দিক ও প্রতিটা আংগুল ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। কারণ অপরিষ্কার হাত যখন নাক-মুখ-চোখে স্পর্শ করবে তখনই ভাইরাস শরীরের ভিতরে প্রবেশ করবে। মনে রাখবেন স্যানিটাইজারের চেয়ে সাবান বেশী কার্যকর ভাইরাসের বিরুদ্ধে। একান্ত সাবান না পাওয়া গেলে বাইরে-অফিসে স্যানিটাইজার ব্যবহার করবেন। তাছাড়া আমরাতো জানিই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংগ।
৪. ঘরে থাকুন:
যুদ্ধ জয়ের সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল। এই ছুটিকে দয়াকরে অন্যসব ছুটির মতো নিবেন না। প্লিজ এই ক্রান্তিকালে ঈদ শপিং কে না বলুন। কোন কোন মার্কেট খুলছে, তাতে কি হলো? আপনি না গেলেই তো হয়। ক্রেতা না থাকলে ভীড় হবে না-বিক্রি হবেনা। এখনও প্রয়োজনের তাগিদে চলার পথে এবং অনলাইন নিউজে দেখি অলিতে-গলিতে, হাট-বাজারে চলছে অপ্রয়োজনীয় আড্ডা,তাও মাস্ক বিহীন। আমরা সবাই স্বাস্থ্য বিধি জানি কিন্তু কেউ মানতে চাই না। এ যেনো এক উদাসীনতা। নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে। কারো উপর দোষ না চাপিয়ে নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে দয়াকরে ভেবে দেখুন না কিভাবে চলা উচিত ভাইরাস সংক্রমণের এই বিপদজনক সময়ে। অন্য মানুষ যা ইচ্ছা করুক। উল্টোপথে হাটা সেইসব ব্যক্তিদের বলুন- ভাই আমি একটু ভীতু তাই করোনা ভাইরাসকে ভয় পাই। আপনি নিজে ঘরে থাকুন এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের বুঝিয়ে আগলে রেখে মাটি কামড়ে কষ্ট করে বাসায় থাকুন। কারণ যার উপরে ভাইরাসের হিংস্র থাবা আসে কেবল সেই ব্যক্তি আর তার পরিবারই বুঝেন এর ভয়াবহতা। বলবেন ঘরে থাকলে পেট চলবে কেমনে? তখন আমার উত্তর, "প্রয়োজনের তাগিদে বের হলে অবশ্যই মানতে হবে উপরের ৩টি অতি জরুরী নিয়ম- ১.মাস্ক, ২.শারীরিক দূরত্ব (physical distance) এবং ৩.বারবার হাত ধোয়া। প্লিজ কথা দিন, মানবেনতো?"
৫. বাড়াতে হবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা:
গবেষণা বলছে একজন মানুষ এর দেহ থেকে আরেকজনের দেহে চোখ-নাক-মুখ দিয়ে ছড়াতে ছড়াতে আবার করোনা ভাইরাস নিজের জিনগত গঠনেও সবসময় পরিবর্তন আনছে-যাকে বলে মিউটেশন। তাই এর বিরুদ্ধে নেই কোন কার্যকর ভ্যাকসিন বা ঔষধ।
তাই চিকিৎসকরা বারবার গুরুত্ব দিচ্ছেন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (Immunity) বাড়ানোর জন্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কি খেলে এবং কি করলে করোনা ভাইরাস এর বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে? পুষ্টিবিদদের মতে করোনা প্রতিরোধে এসময়ে পুষ্টিসমৃদ্ধখাবার বেশি করে খেতে হবে। যেমন-করলা (বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ), বাঁধাকপি মটরশুঁটি, পেপে, মিষ্টি আলু খেতে পারেন।এছাড়া শাকের মধ্যে পালংশাক, লাল শাক এবং অন্যান্য সবুজ শাক খাওয়া উচিৎ। ফলের মধ্যে-পেয়ারা, জাম্বুরা, মাল্টা,লেবু, কমলা,তরমুজ, জলপাই, আনারস ইত্যাদি যা সহজলভ্য সেগুলো দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এই সময়ে রাখতে পারেন। এছাড়া ক্যারোটিনসমৃদ্ধ খাবার রোগ প্রতিরোধে খুব সাহায্য করে। সেক্ষেত্রে গাজর, কুমড়া বেশি করে খান। উপরের সব খাবারে আছে শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট যা সহজে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহয়তা করে।
মধু রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাই এই মুহূর্তে বাসার খাবার টেবিলে উন্নতমানের মধু রেখে দিন। সারা দিনে চাহিদামত প্রচুর পানি পান করুন। আমিষ জাতীয় খাবার ডিম অথবা দুধ রাখার চেষ্টা করবেন খাদ্য তালিকায়, যা শরীরের ইমিউনিটি বাড়াতে অত্যন্ত কার্যকর। তাই সব ধরণের সুষম খাবারই ভারসাম্য রেখে খেতে হবে পরিমাণ মতো।
যেকোনও ধরনের গলা খুশ খুশ বা কাশি দেখা দিলেই আর অপেক্ষা করা উচিত হবে না। বরং ওই মুহূর্ত থেকে যে কাজটি করতে হবে তা হলো আদা (জিঞ্জার), লবঙ্গ এবং দারুচিনি দিয়ে রং চা খেতে হবে। এর ফলে গলার ভেতরের কোষগুলোতে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে। কোষগুলোর ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে।
নিজ নিজ প্রাত্যহিক ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। নিয়মিত প্রার্থনা করলে মন থাকে নির্ভার, সাথে শরীরও থাকে সতেজ।
সারাদিন বাসায় থাকতে থাকতে শরীরটা অলস হয়ে যাচ্ছে। তাই শারিরীকভাবে ফিট থাকার জন্য বাসায় থেকে ফ্রি হ্যান্ড Exercise /ব্যায়াম করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। ফুসফুসের ব্যায়াম/Breathing exercise গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, কারণ করোনাভাইরাস ফুসফুসকে আক্রমণ করে। এই Free hand exercise এবং Breathing exercise এর নমুনা ইউটিউব থেকে দেখে নিতে পারেন।
সবশেষে বলি, করোনা মহামারীর পরীক্ষার সিলেবাস কিন্তু এই কয়েকটি বিষয়। প্রিয় বাংলাদেশে মরণঘাতী এই করোনা ভাইরাস কিন্তু তার চূড়ান্ত ভয়াবহতা দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমার-আপনার সামান্য কিছু সু-কৌশলই পারে আল্লাহর ইচ্ছায় একে রুখে দিতে। এখন সিদ্ধান্ত আপনার-জীবনও আপনার। কিন্তু আপনার কিছু হলে চিকিৎসক অথবা প্রতিবেশী হিসেবে আমিওতো ঝুকিতে,তাই আমার এই অনুরোধ।
সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং সচেতনতা অবলম্বন করে মহান আল্লাহর তায়ালার কাছে হায়াতের জন্য দোয়া করে যেতে হবে। বেচে থাকা মহান আল্লাহর রহমত। বেঁচে থাকলে জীবনকে উপভোগ করা যাবে। সচেতন না হয়ে স্বাস্থ্য বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভাইরাসের সমুদ্রে ঝাপ দেয়াতো আত্মহত্যার শামিল।
মনে রাখবেন মহান আল্লাহ চাইলে বেঁচে থাকাই হবে ২০২০ সালের সবচেয়ে বড় সফলতা।
লেখক : ডা: মো: আব্দুল হাফিজ শাফী
এম.বি.বি.এস; বিসিএস (স্বাস্থ্য)
নাক-কান-গলা বিভাগ, বি.এস.এম.এম.ইউ (প্রেষণে), ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।