Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমাদের চিকিৎসকদের মানসিকতার পরিবর্তন কবে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৫ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক পাঁচটি বিষয় হচ্ছে, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। যে দেশ তার নাগরিকদের এই পাঁচটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারে, সে দেশ সবচেয়ে উন্নত এবং সুখীও বটে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যে কিনা এই বিষয়গুলো নিশ্চিতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে না যাচ্ছে। তবে এই পাঁচটি উপাদানের অবস্থাভেদে গুরুত্ব রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চিকিৎসা বা মানুষের সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়া। সুস্থতাকে বলা হয় আল্লাহর সবচেয়ে বড় নেয়ামত। সুস্থ থাকলে এ নেয়ামত সম্পর্কে মানুষ খুব কমই উপলব্ধি করতে পারে। অসুস্থ হলে বোঝে, এর চেয়ে বড় নেয়ামত আল্লাহতাআলা পৃথিবীতে আর কিছুই দেননি। একজন মানুষ সুস্থ থাকলে সে তার মৌলিক অন্য চারটি চাহিদা পূরণ করতে পারে বা চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশের সংবিধানেও মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মিটানোর কথা বলা হয়েছে। এই সময়ে এসে দেশের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমরা কতটা এগিয়েছি, যদি এ বিচার করা হয়, তবে এর জবাবটি হবে মিশ্র, প্রশ্নসাপেক্ষ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপেক্ষিক। খাদ্যের কথা যদি বলা হয়, তবে একবাক্যে বলে দেয়া হবে, আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। অথচ অসংখ্য মানুষকে এখনো খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একবেলা, আধাবেলা, আধাপেট খেয়ে অসংখ্য মানুষের দিন কাটে। সরকারি হিসেবে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে এখনো প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। দরিদ্র মানুষ পাঁচ কোটির বেশি। সরকারি হিসেবেই দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই হতদরিদ্র ও দরিদ্র। তবে সরকারি এ হিসেবের সাথে অনেক বিশেষজ্ঞ এবং খ্যাতিমান সংস্থার দ্বিমত রয়েছে। তাদের হিসাবটি সরকারি হিসেবের চেয়ে আরও বেশি। তাহলে কী দাঁড়ালো? একদিকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলছি, অন্যদিকে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী দুইবেলা পেটপুরে খেতে পায় না। আর এই করোনার সময়ে খাদ্যসংকটে পড়া মানুষের সংখ্যা কত বেড়েছে, তার সঠিক হিসাব করা সম্ভব নয়। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কের ফুটপাতে কিংবা আইল্যান্ডে এখন নতুন চিত্র দেখা যায়। অনেক মানুষ এসব আইল্যান্ড সারিবদ্ধভাবে বসে থাকে। দেখলেই বোঝা যায় তাদের অনেকেই কর্মজীবী। শারিরীক ভাষা ও দৃষ্টিতে কিছু পাওয়ার তৃষ্ণা স্পষ্ট। যদি চলার পথে কেউ দেখে থেমে তাদের সাহায্য করে, এ আশায় বসে থাকে। দেশজুড়ে নিশ্চয়ই এমন আরও অনেক কাজের মানুষ বসে রয়েছে। ধরে নিলাম, খাদ্য সংকটে যারা ভুগছে, তাদের এ অভাব ধীরে ধীরে পরিবর্তন হবে। আধাবেলা বা একবেলা খেতে পারবে কিংবা তিন বেলাও খেতে পারবে।
আমাদের শিক্ষার চিত্রটি কেমন তা ইতোমধ্যে সকলেই জেনে গেছেন। এখানে কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটি বেশি। শিক্ষার মানের চেয়ে পাশের হার বেশি। বেশিরভাগই সার্টিফিকেট সর্বস্ব হয়ে শিক্ষিত হচ্ছে। বস্ত্রের ক্ষেত্রটি যদি ধরি, তবে বলতে হবে গার্মেন্ট শিল্পের অসামান্য অগ্রগতির কারণে সস্তায় মানুষ জামা-কাপড় পরতে পারছে। এক্ষেত্রে তেমন সংকট নেই। সবার জন্য বাসস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। এখনও অসংখ্য মানুষ খোলা আকাশের নিচে কিংবা অস্থায়ী শেডের নিচে কোনো রকমে দিনগুজরান করে। এবার আসা যাক, চিকিৎসায়। সরকারের ভাষায়, এ খাতে দেশ প্রভূত উন্নতি সাধান করেছে। মাঝে মাঝে এ কথাও বলে, এখন আর চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে ভুক্তভোগীরা জানে, আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল হকিকত কি এবং এতে চিকিৎসা পেতে কত কষ্ট করতে হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার চিত্র সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে দেশে দৃষ্টিনন্দন ভবনে অনেক নামি-দামি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। দেখলেই মনে হয়, এসব হাসপাতাল শুধু দেখার জন্য ঢুকতে টিকেট লাগবে। আর চিকিৎসা করতে কত খরচ হবে, তা হিসাব করতে গিয়ে একজন সুস্থ মানুষেরও মাথা চক্কর দিয়ে উঠবে। অর্থাৎ হাসপাতালগুলোর চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, এগুলো যেন সেবাকেন্দ্র নয়, কোনো শপিং মল কিংবা ব্যবসা কেন্দ্র, যেখানে চিকিৎসা সেবা নয়, পণ্য হিসেবে বিকিকিনি হয়। আমাদের সামনে এমন কত নজির রয়েছে, বিল পরিশোধ করতে না পারায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ আটকে রেখেছে। স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালের নান্দনিক পরিবেশ ভারি হলেও কর্তৃপক্ষের মন গলেনি। আবার ভুল চিকিৎসায় মারা গেলেও তার প্রতিকার পায়নি। আমরা এমন চিত্র দেখিনি যে, ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনায় মৃত ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। নিদেনপক্ষে হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অবশ্য এটা অসম্ভব ঘটনা। কারণ, ভুল স্বীকার করা মানে হাসপাতালের বারটা বাজা, পুলিশ কেইস থেকে শুরু করে হাসপাতালের ইমেজ ক্ষুন্ন হওয়া এমনকি হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর এসব হাসপাতালের সাথে জড়িয়ে থাকে সরকার সংশ্লিষ্ট কিংবা সরকারের ঘনিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা। কাজেই ভুল চিকিৎসায় কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অকল্পনীয় ব্যাপার।
দুই.
সরকার যতই বলুক, চিকিৎসা ক্ষেত্রে আমরা অনেক উন্নতি করেছি এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পেরেছি, এ যে শুভংকরের ফাঁকি, তা করোনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। করোনা মহামারী আকার ধারণ না করলে আমরা হয়তো বুঝতেই পারতাম না, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা পিছিয়ে রয়েছে এবং সরকার এ খাতে কোনো ব্যবস্থাপনাই গড়ে তুলতে পারেনি। চিকিৎসকদেরও সেবামূলক মানসিকতা বলতে কিছু নেই বা তাদের এ মনোভাবাপন্ন করে তুলতে পারেনি। প্রতিবছর যে, ডাক্তারি পাস করে মানবসেবার পরিবর্তে কেবল একদল ব্যবসায়ী বের হচ্ছে, তা বোঝা যেত না। অবশ্য এর যে ব্যতিক্রম নেই তা নয়, তবে তা শতকে বা হাজারে দুয়েকজন। এতেই আমরা অনেক সময় অভিভূত এবং আপ্লুত হই। আর সব চিকিৎসক যদি শুধু সেবা ও মমতা নিয়ে চিকিৎসা করতো, তাহলে আমরা কী সুখী এবং সুস্থ জাতি হিসেবেই না গড়ে উঠতে পারতাম! তাতে যদি মৃত্যুও হয়, তারপরও সান্ত্বনা থাকত এ কারণে যে, বলা যেত, ডাক্তার অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সেবা করেছেন। চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি। কিংবা আমাদের দেশে এ চিকিৎসা ব্যবস্থার যন্ত্রপাতি, ওষুধ বা আনুষাঙ্গিক উপকরণের অভাব রয়েছে বলে নিজেদের প্রবোধ দেয়া যেত। দুঃখের বিষয়, আমাদের অধিকাংশ চিকিৎসকের মানসিকতাই এমন, তারা সেবার চেয়ে অর্থটা ভাল বোঝে। তা নাহলে, এই করোনার সময় তারা কেন করোনার বাইরের রোগীর চিকিৎসা দেবেন না? চেম্বার বন্ধ করে বাসায় বসে থাকবেন? এটা তাদের কোন চিকিৎসা সাস্ত্রে রয়েছে? এটা সবার জানা, করোনা সারাবিশ্বের জন্যই এক অজানা-অচেনা রোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর গতিপ্রকৃতি সনাক্ত করতে এবং সুরক্ষার বিষয়টি জানতে বেশ সময় লেগেছে। তবে এক্ষেত্রে চিকিৎসকরাই সবার আগে এর সুরক্ষা বিষয়ে জানবেন, এটাই স্বাভাবিক এবং সেভাবেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রোগীর সেবায় প্রস্তুতি নেবেন। দেখা গেল, আমাদের চিকিৎসকদের সিংহভাগই করোনার ভয়ে চিকিৎসা বাদ দিয়ে ঘরে ঢুকে গেছেন। সেখান থেকেই দাবী তুললেন, তাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা (পিপিই) না দিলে চিকিৎসা করতে পারবেন না। তাদের এ দাবী যৌক্তিক। সরকার চিকিৎসা ক্ষেত্রে তার প্রধান যোদ্ধা চিকিৎসকদেরই যদি সুরক্ষিত না রাখে, তবে রোগের সাথে যুদ্ধ করবে কী দিয়ে? সরকার পিপিই’র ব্যবস্থা করল। পাশাপাশি চিকিৎসকদের হুমকি-ধমকিও দিল। ধীরে ধীরে চিকিৎসকরাও যেন গর্ত থেকে বের হতে শুরু করলেন। দম নিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, বুকে সাহস ধারণ করে হাসপাতালে যেতে শুরু করলেন। তারা হাসপাতালে গেলো ঠিকই, তবে এ যাওয়া যেন শুধুই যাওয়া এবং দেখানোর জন্য। করোনা রোগীর ধারে-কাছেও ঘেঁষোন না। দূর থেকে কেমন আছে, তা দেখেই চলে যান। নার্সরাও তাই করে। রোগী অসহায় ও আতঙ্ক নিয়ে তার মতো করে পড়ে থাকে। হায়াৎ থাকলে বাঁচবে, না থাকলে বাঁচবে না, এমন মনোভাব ধারণ করে। বাস্তবতা হচ্ছে, করোনা রোগীর জন্য কিছু হাসপাতাল ও বেড রেডি করা ছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং রোগীর সেবা-যত্নের কোনো ব্যবস্থাই করা হয়নি। ফলে বেশিরভাগ মানুষ করোনার চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে হাসাপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে। তারা মনে করছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে যে হয়রানি এবং অবহেলা ও অযত্নের শিকার হতে হয়, তার চেয়ে বাসায় সাবধানে থেকে মরলেও ভাল। এখন করোনায় আক্রান্ত হওয়া মানে চিকিৎসা না পাওয়া এবং প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পন করে বসে থাকা। মানুষের মধ্যে এ সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতার বিশদ বর্ণনার আলোকে। নেট দুনিয়ায় এখন এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি মানুষের কথা অহরহ শোনা যায়। তার অর্থ হচ্ছে, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোনোভাবেই প্রস্তুত নয় এবং প্রস্তুতি নেয়ার মতো সক্ষমতাও অর্জন করেনি। তাহলে সরকার যে স্বাস্থ খাতের উন্নতির কথা বলছে, এ কথা যে অসার এবং ফেইক তা করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে। সরকার মানুষের স্বাস্থ সুন্দর করার পরিবর্তে ইট-পাথরের বড় বড় অট্টালিকা আর স্থাপনার স্বাস্থ সুন্দর করছে। দেখাচ্ছে আমরা কত উন্নত। অথচ এটা ভাবছে না, মানুষই যদি না থাকে, তাহলে এই বড় বড় অট্টালিকা আর স্থাপনা দিয়ে কী হবে? কারা এগুলো দেখবে, ব্যবহার করবে? এগুলো বানাতে যে সুস্থ মানুষ প্রয়োজন, তা কোথায় পাবে? অসুস্থ মানুষ নিয়ে কি উন্নতি করা যায়?
তিন.
আমাদের স্বাস্থ্যখাতের কী করুণ দশা তা একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। গত সপ্তাহে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ রাজধানীর নামী-দামী হাসপাতালের কোনোটিতে আইসিইউ সাপোর্ট না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার মেয়ে সুস্মিতা আইচও একজন চিকিৎসক। তিনি সরকারের স্বাস্থ্যসেবার ৩৩৩ হটলাইনে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং একজন চিকিৎসকের বাবা হয়েও গৌতম আইচকে হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। পাঠক, বিষয়টি একবার ভাবুন। তারপর বলুন, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন কোথায় আছে। শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থা নয়, আমাদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসকদের মানসিকতা কোন পর্যায়ের, তা ভাবুন। আর আমাদের মতো অতি সাধারণ কিংবা সাধারণ মানুষের কী অবস্থা এবং কোথায় আছি? রাষ্ট্র আমাদের কোন দৃষ্টিতে দেখে? এসব প্রশ্নও ভাবুন। গৌতম কীভাবে মারা গেলেন তার বর্ণনা মেয়ে সুস্মিতা যখন দেন তখন বিবেকবান মানুষমাত্রই ক্ষোভ ও দুঃখে ফেটে পড়েন। সুস্মিতা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, ‘বাবা কিডনী রোগী। ডায়ালাইসিস করতে হয়। ডায়ালাইসিসের সময় প্রায়ই হঠাৎ প্রেসার বেড়ে যায়, শ্বাসকষ্ট বাড়ে এবং ফুসফুসে পানি চলে আসে। আইসিইউ সাপোর্ট দিলে ঠিক হয়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার (৭ মে) ল্যাবএইড হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের সময় তার প্রেসার বাড়ার পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট শুরু হলে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে আমাকে ফোন করা হয়। আমি বাবাকে ভর্তি করাতে বলি। তখন তারা বলে, সুযোগ না থাকায় তারা আইসিইউ সাপোর্ট দিতে পারবে না। তাই প্রেসার কমানোর ওষুধ দিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে বলে। আমার কাছে মনে হয়েছে, বাবাকে বাসায় নেয়া ঠিক হবে না, এই মুহূর্তে অক্সিজেন দিতে হবে। বাবাকে নিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে যাই। আমি নিজে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে তাদের সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। তখন তারা করেনা সন্দেহে কোনো রেফারেন্স ছাড়া বাবাকে ভর্তি করাতে পারবে না বলে জানায়। তাদের ওখানে করোনা টেস্ট করাতে বললে তারা আইইডিসিআর-এর কথা বলে। কিন্তু আইইডিসিআর তো করোনা পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে। পরে বাবাকে নিয়ে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাই। তারাও করোনা টেস্ট করানোর কথা বলে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। সেখানে ভর্তি করাতে না পেরে আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালে নিয়ে আসি, কিন্তু তারা বাবাকে দেখেনি, চেকও করেনি। তারা ভর্তি নিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। আবার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাই। এখান থেকে বলা হলো ভর্তি নেয়া সম্ভব নয়, এখানে করোনা টেস্ট বন্ধ রয়েছে। স্কয়ার থেকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাই। তারা জানায়, বাবা কিডনীর রোগী, তাই তাকে কার্ডিয়াক সাপোর্ট দেয়া দরকার। আমাদের এখানে এ সাপোর্ট শুরু হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েও কথা বলি, তারাও জানায় এই মুহূর্তে ভর্তি নেয়া সম্ভব নয়। তারপর মিরপুর রিজেন্ট হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি। আশপাশের এমন কোনো হাসপাতাল নেই যেখানে বাবাকে ভর্তি করানোর চেষ্টা করিনি। পরে হতাশ হয়ে রাত সাড়ে ৯ টার দিকে বাসায় চলে যাই। এমন সময় এক আত্মীয় ফোন করে জানায় অনেক চেষ্টার পর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে একটা সিট ম্যানেজ করতে পেরেছেন। বাবার করোনার উপসর্গ না থাকলেও সেখানে নিয়ে যাই। সেখানে সরকারি কোনো ডাক্তার বাবাকে দেখতে আসেননি। তারা আমাকে ওষুধ বুঝিয়ে দিয়ে যায় আর আমি ওষুধ খাওয়াই। আমার ভাই বাবাকে অক্সিজেন দেয়। শুক্রবার সারাদিনেও বাবার করোনার টেস্ট করানো হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর বলেছে, আগে নমুন নেয়া দরকার ছিল।’ এ ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, এর মধ্যে দেশের পুরো স্বাস্থব্যবস্থা এবং চিকিৎসকদের মানসিকতার চিত্র ফুটে উঠেছে। একজন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং তার চিকিৎসক মেয়ে তাদের পেশাগত মর্যাদার দিক থেকে কোনো ধরনের সাপোর্ট পাননি। অথচ স্বাভাবিকভাবে তাদের এই সাপোর্ট পাওয়ার কথা। বাবার ক্ষমতা আর মেয়ের চিকিৎসক হওয়ার ফেলোশিপ অর্থাৎ সহকর্মীদের সাপোর্ট-এর কোনোটাই কাজ করেনি। অন্তত সহকর্মী হিসেবে তো সুস্মিতাকে বাবার চিকিৎসায় তার সহকর্মীরা সহযোগিতা করতে পারত! করেনি। তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অবস্থান কোথায়? এক করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে, আমাদের দেশের পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা কোন স্তরে রয়েছে। এক করোনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে অন্য সব চিকিৎসা ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। করোনার ভয়ে হাসপাতালগুলো সাধারণ ও জটিল চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলো কেবল নামকাওয়াস্তে চিকিৎসা চালাচ্ছে। চিকিৎসকরা মধ্যে করোনা ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। এই যদি হয় চিকিৎসকদের মানসিকতা, তাহলে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কোথায়? অথচ চিকিৎসকদের কাজই হচ্ছে, চিকিৎসার মাধ্যমে মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা। আমরা এই করোনাকালেই তার নজির দেখেছি। করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে শত শত চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন। এমনকি যেসব চিকিৎসক অবসরে চলে গিয়েছিলেন, তারা পুনরায় লাইসেন্স রিনিউ করে চিকিৎসা শুরু করেছেন। তাদের আত্মত্যাগের কথা আমরা এখন নেট দুনিয়ায় পড়ি এবং আপ্লুত হই। অথচ আমাদের দেশের চিকিৎসকদের মানসিকতা এমন হয়ে পড়েছে যে, তারা মানবসেবা নয়, নিজেদের রক্ষায় গা বাঁচিয়ে চলছেন। জাতির এই ক্রান্তিকালে রোগীর সেবাদানে গাফিলতি করছেন। রোগীদের মানুষ বলে গণ্য করছেন না। রোগী বাঁচানোর চেষ্টার পরিবর্তে রোগীদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। অপেক্ষায় আছেন, করোনা চলে যাওয়ার পর পুনরায় চিকিৎসা বাণিজ্য শুরু করার। সরকার যে তাদের এত সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছে, তাতেও তাদের মন গলেনি। তাদের মানবিক চেতনা জাগ্রত হচ্ছে না। বলা বাহুল্য, তারা ভাল করেই জানেন, নিজেকে সুরক্ষিত রেখে কীভাবে করোনা রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে। এই যে সুস্মিতা একজন চিকিৎসক হয়েও বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেন, তিনি কি পারবেন তার কলিগদের এ আচরণকে ক্ষমা করতে? কিংবা তিনি যে চিকিৎসক হয়েছেন, এ পেশাকে সম্মান জানাতে?
চার.
ভারতে প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে কয়েক লাখ রোগী চিকিৎসা করতে যায়। এতে ভারতের ব্যাপক আয় হচ্ছে। দেশটিও বাংলাদেশের রোগীদের টার্গেট করে হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে এবং আমাদের দেশে তার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারা আমাদের দেশের রোগীদের আস্থা অর্জন করেছে এবং করছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর অনেক মানুষের আস্থা নেই। অথচ চিকিৎসার মাধ্যমে যে শত শত কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, সরকার ইচ্ছা করলে তা রোধ করতে পারে, স্বাস্থব্যবস্থার দিকে নজর দিয়ে। বড় বড় স্থাপনা গড়ার আগে স্বাস্থখাতকে উন্নতির দিকে যদি সরকার মনোযোগী হয়, তাহলে এ খাতের মাধ্যমেই আমরা সুস্থজাতি হিসেবে উন্নতি লাভ করতে পারব। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের মানুষ ভারতের অনেক বিখ্যাত হাসপাতালের নাম এবং কোন হাসপাতালের চিকিৎসা কত ভাল, কত সাশ্রয়ী তা মুখস্ত বলে দিতে পারে, অথচ আমাদের দেশে এমন কোনো হাসপাতাল গড়ে উঠে নাই যার গুণগান সাধারণ মানুষের মুখে শোনা যায়। এ থেকেই বোঝা যায়, চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমরা কত পিছিয়ে আছি। সর্বশেষ করোনা তা বুঝিয়ে দিয়েছে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চিকিৎসক

১৩ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন