পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানুষ নিখিল সৃষ্টির সেরা জীব, এ বিশ্ব চরাচরে বিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহর প্রতিনিধি খলিফা। ভূ-মন্ডল, নভোমন্ডল তথা- চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, সাগর, পাহাড়, মরু-বিয়াবান, সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলা, মাঠ, মনোরম প্রকৃতি, বন-বনানী কুসুম-কানন, চিত্তহারি দৃশ্যাবলী, সব কিছু তো মহান স্রষ্টা মানুষেরই জন্য সৃষ্টি করেছেন। পরকালের অনন্ত সুখের জান্নাত, তাও মানুষেরই জন্য সৃষ্টি করে রেখেছেন।
মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহকে মেনে তার আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করা। সত্য, ন্যায় ইনসাফ কায়েম করা। বিশ্ব স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে তার সৃষ্টিকে প্রতিপালন করা। মানুষ যেন তার এ দায়িত্ব ভুলে না যায়, অবহেলা না করে সে জন্য যুগে যুগে, দেশে দেশে আল্লাহ তার বার্তাবাহক নবী-রাসূল ও তাঁর বিধি-বিধান পাঠিয়েছেন। মানুষ যখন তা অমান্য করেছে, অগ্রাহ্য করেছে, অস্বীকার করেছে, আল্লাহ তখন এর ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, সাবধান করেছেন। কিন্তু ক্ষমতার মোহে মত্ত হয়ে, দাম্ভিকতার মাতাল অশ্বে আরোহণ করে ধরাকে সরাজ্ঞান করেছে, ন্যায় ইনসাফকে পদদলিত করেছে, জুলুম-অন্যায়-অত্যাচারে পৃথিবীর পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলেছে, তখন আল্লাহ ক্রোধান্বিত হয়েছেন, গজব নাজিল করেছেন, কখনও বা অবাধ্য কওমকে ধ্বংস, নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন।
আল্লাহর গজবের মোকাবেলায় তাদের শারীরিক শক্তি, ক্ষমতার দাপট, ধন-ঐশ্বর্য, কলা-কৌশল, বুদ্ধিজ্ঞান, বাহুবল, জনবল কিছুই কাজে আসেনি। কোনো কিছু দিয়েই পতন রোধ করা সম্ভব হয়নি। ধ্বংস হয়েছে নূহ আ.-এর অবাধ্য কওম মহাপ্লাবনে। ধ্বংস হয়েছে প্রবল প্রতাবান্বিত মিসর সম্রাট ফিরাউন- রামসিস ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা। ধ্বংস হয়েছে লুত আ.-এর কওম। তার সাক্ষী হয়ে আজও বিরাজ করছে ডেড সি- মরু সাগর। ধ্বংস হয়েছে কওমে আদ, কওমে সামুদ, আসহাবে উখদুদ। ধ্বংস হয়েছে হামান, সাদ্দাদ, কারুনেরা এবং এমনি আরও অনেক খোদাদ্রোহী জালিম।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখনও বিদ্যমান রয়েছে তার অসংখ্য নিদর্শন। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ পৃথিবী পরিভ্রমণ করে সে সমস্ত নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘তাদের বৃত্তান্তে বোধশক্তিসম্পন্ন লোকদের জন্য রয়েছে শিক্ষা।’ সুরা ইউসুফ: ১১১। মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর, অতঃপর দেখ যারা সত্যকে অস্বীকার করেছে তাদের পরিণাম কী হয়েছিল।’ সুরা আনআম: ১১। ‘পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ, অপরাধীদের পরিণাম কী রূপ হয়েছে।’ সুরা নমল: ৬৯।
‘তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ, তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে!’ সুরা রূম: ৪২।
পৃথিবীতে খোদায়ী গজব যখন নাজিল হয় তখন ভালো-মন্দ সকলেই সাধারণত তার শিকার হয়। তবে মন্দদের জন্য তা গজব ও বালা আর মুমিন বান্দাদের জন্য তা হয় ইবতিলা বা পরীক্ষা। কাফির-বেদীন ইহকাল ও পরকালে তা দ্বারা হবে মহাক্ষতিগ্রস্ত। আর মুমিন বান্দারা হবে তাতে আরও পরহেজগার, তারা বেশি বেশি করে স্মরণ করবে আল্লাহকে। তওবা করবে, তাওয়াক্কুল করবে, ধৈর্য ধারণ করবে।
আর এজন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মহাপুরস্কার লাভ করবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন ‘আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্য পরীক্ষা করব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে। যারা তাদের ওপর বিপদ-আপতিত হলে বলে, ‘আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তার দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী এরাই তারা যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে আশিস ও দয়া বর্ষিত হয় আর এরাই সৎপথে পরিচালিত।’ সুরা বাকারা: ১৫৫, ১৫৬ ও ১৫৭।
অপরদিকে অবিশ্বাসীদের দিল হয়ে যায় আরও কঠিন। আল্লাহপাক বলেন, ‘এরপরও তোমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেল, তা পাষাণ কিংবা তদপেক্ষা কঠিনতর।’ সুরা বাকারা: ৭৪।
‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুণ বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান যাতে তারা ফিরে আসে।’ সুরা রূম: ৪১।
মহামারী, ডেঙ্গু, করোনাভাইরাস, টর্নেডো, সাইক্লোন, দুর্ভিক্ষ এসব হচ্ছে বিপর্যয়েরই বিভিন্ন রূপ। আল্লাহপাক অন্যত্র বলেন, ‘তোমাদের ওপর যে সব বিপদ-আপদ আপতিত হয় সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের ফল। অনেক গুনাহ তো আল্লাহ ক্ষমাই করেছেন।’ সূরা শুরা: ৩০।
হ্যাঁ, আল্লাহ পরম দয়ালু, ক্ষমাশীল, তিনি অনেক অপরাধই মার্জনা করেছেন। পাকড়াও করেন না। অন্যথা প্রতিটি গুনাহর কারণে যদি বালা নাজিল করতেন তবে পৃথিবীতে একটি মানুষও বেঁচে থাকত না। আর যেগুলো মার্জনা করেন না, সেগুলোর শাস্তিও পৃথিবীতে পুরোপুরি দেন না বরং সামান্য স্বাদ আস্বাদন করান মাত্র। যেন তারা সঠিক পথে ফিরে আসে।
বিপদ তো ক্রমাগত আসছেই। ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, করোনাভাইরাস ইত্যাদি। এরপর আবার শোনা যাচ্ছে পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাবের কথাও। আল্লাহ আমাদেরকে পানাহ দিন। যে সব কারণে আল্লাহতায়ালা বেজার হন তা আমাদের অবশ্যই পরিহার করতে হবে। আমর বিল মারুফ (ন্যায়ের আদেশ দান) অর্থাৎ সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও নাহি আনিল মুনকার (অন্যায় কাজে নিষেধ) অর্থাৎ অসত্য, অন্যায়ের প্রতিরোধের অবশ্যই সঙ্কল্প গ্রহণ করতে হবে।
অন্যথায় দোয়াও কবুল না হওয়া সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হযরত হুজাইফা (রা.) হতে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কসম সেই সত্তার যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা অবশ্যই ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করবে অন্যথায় শীঘ্রই আল্লাহপাক তোমাদের প্রতি শাস্তি প্রেরণ করবেন। অতঃপর তোমরা তার থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করবে বটে কিন্তু দোয়া কবুল হবে না।’ তিরমিজি শরীফ।
অন্য এক হাদীসে আছে, হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহপাক হযরত জিব্রাঈল (আ.)কে অমুক অমুক জনপদ তার অধিবাসীসহ উল্টে দিতে হুকুম করলেন।’ জিব্রাঈল আ. বলেন, ‘হে প্রতিপালক, সেখানে তাদের মধ্যে আপনার এমন একজন বান্দা রয়েছে যে, জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও আপনার নাফরমানি করেনি। তাকেসহ কি এলাকাটি ধ্বংস করে দেব? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ, তুমি তাকেসহই জনপদটি ধ্বংস করে দাও। কেননা সে এমন এক বান্দা যার চেহারা এলাকাবাসীর নাফরমানি দেখে কখনো বিবর্ণ ও মলিন হয়নি।’ বায়হাকী শরীফ।
অন্য এক হাদীসে রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যখন জিহাদে লব্ধ সম্পদ নিজ অর্থ বলে গৃহীত হবে, যখন আমানতের মাল গণিমতের মালের মতো আত্মসাৎ করা হবে, যখন জাকাত প্রদান জরিমানাবৎ বিবেচিত হবে, যখন বিদ্যার্জনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দ্বীন না হয়ে অন্য কিছু হবে, যখন পুরুষেরা স্ত্রীর-আনুগত্য করবে আর মাতার-নাফরমানি করবে, যখন মানুষ বন্ধুদের আপন করে নেবে আর-পিতাকে পর করে দেবে, যখন মানুষ মসজিদে দুনিয়াবী কথায় মশগুল হবে, যখন ফাছেক লোকরা জাতির নেতৃত্বের আসন অধিকার করবে, যখন হীন অভাজনরা সমাজের নেতা বলে গণ্য হবে, যখন মানুষ কাউকে তার ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য সম্মান করবে, যখন গান-বাদ্য হতে থাকবে, মাদকসেবন হবে এবং জাতির পূর্ববর্তীগণকে পরবর্তীরা অভিশাপ দেবে।
এসব আলামত প্রকাশ পেলে তখন তোমরা অপেক্ষা করো প্রবল ঝড়-তুফানের ভ‚মিধসের রূপ-চেহারা আকৃতি-বিকৃত হয়ে যাওয়ার, প্রস্তর বর্ষণের, মালার-সূতা ছিঁড়ে গেলে যেমন একের পর এক দানা ক্রমাগত ঝরে পড়তে থাকে তখন তেমনি দৈব দুর্বিপাকের (অপেক্ষা করতে থাক)। তিরমিজি শরীফ। দয়াময় আল্লাহ এমন অবস্থার সম্মুখীন হওয়া থেকে আমাদের হেফাজত করুন। [ক্রমশঃ]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।