পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যখন বাংলাদেশের মেডিসিন ও সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বলছেন যে, অঘোষিত লকডাউন শিথিল করার ফলে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে, তখন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ আব্দুল্লাহ কিভাবে বলেন, মে মাসেই বিদায় নেবে করোনা। সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। গত ২ মে শনিবার একটি বাংলা নিউজ পোর্টালে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ বলেছেন, বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ এ মাসেই শেষ হতে পারে। তিনি বলেন, করোনার যে গতি প্রকৃতি বোঝা যাচ্ছে, তাতে এখনও আমি মনে করি, এই মাসের মধ্যেই করোনার প্রকোপ বাংলাদেশে কমে আসবে এবং বিদায় নেবে। তিনি বলেন, যদিও এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক কার্যকরণ পাওয়া যায়নি, তারপরও আমি মনে করি, বৃষ্টির কারণে করোনার প্রকোপ কমে যাবে। কারণ অন্যান্য অনেক ভাইরাসই বৃষ্টির কারণে ধ্বংস হয়। এখন পর্যন্ত যদিও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, বৃষ্টিতে কোভিড-১৯ বিলুপ্ত হয়, তবুও তিনি মনে করেন, আগামী কয়েকদিন যদি এই অবস্থা স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আমরা আশার আলো দেখতে পাবো। তারপর করোনার প্রভাব আস্তে আস্তে কমে যাবে।
আমরা বিগত তিন মাস ধরে করোনার ওপর দেশ বিদেশের অনেক লেখা পড়েছি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংক্রমণ এবং ইমিউনোলজি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এ্যান্থনী ফাউচি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অধ্যাপক ডাঃ নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক রিজওয়ানুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সী প্রমুখের লেখা এবং মন্তব্য পড়েছি। কিন্তু কোথাও দেখিনি, বৃষ্টিপাতের সাথে করোনার প্রকোপের হ্রাস বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক রয়েছে। তবে আবহাওয়া এবং সূর্যের আলো ও বাতাসের আর্দ্রতার সাথে করোনার সম্পর্ক আছে কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। এই বিতর্ক বিদেশে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাংলাদেশেও। তবে অধিকাংশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী মনে করেন, তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার সাথে করোনার প্রকোপ কম বা বাড়ার কোনো সম্পর্ক নাই।
দুই
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডাঃ এস এম আলমগীর বলেন, করোনার সাথে ঐগুলোর কোনো সম্পর্ক নাই। তার মতে ৫৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কোনো ভাইরাস আংশিক মরে যায়। তাপমাত্রা এর নিচে হলে মরেনা। আর তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি হলে সম্পূর্ণ মরে যায়। আমরা যে পানি ফুটিয়ে পান করি সেটি ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ফুটাই। তাই সেটি জীবাণুমুক্ত হয়। এদের বক্তব্যে যুক্তি আছে। বলা হয় যে, ২৫ ডিগ্রি এর ওপর হলে করোনা ভাইরাস কমে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ৩১ থেকে ৩৬ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। কিন্তু এই তাপমাত্রায় করোনার প্রকোপ কমা তো দূরের কথা, বরং লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এই কলামটি লিখছি রবিবার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে দেখা গেলো, আজ (গত ২৪ ঘন্টার হিসাব) করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিগত ১ মাস ২৭ দিনের মধ্যে (৮ মার্চ থেকে) সর্বোচ্চ। সংখ্যাটি হলো ৬৬৫ জন। এটি নিয়ে বর্তমানে মোট সংক্রমণের সংখ্যা দাঁড়ালো ৯ হাজার ৪৫৫ জন। গত ২৪ ঘন্টায় নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫ হাজার ৩৬৮ টি। এ পর্যন্ত মোট পরীক্ষা করা হয়েছে ৮১ হাজার ৪৩৪ টি নমুনা।
ডাঃ আব্দুল্লাহর বক্তব্য বাংলাদেশের আর কোনো বিশেষজ্ঞ সমর্থন করেছেন বলে কোনো মিডিয়ায় দেখিনি। বরং মিডিয়াতে এবং বিশেষজ্ঞ মহলে বলা হচ্ছে, অঘোষিত লকডাউন শিথিল করার ফলে সামাজিক সংক্রমণ এখন গণ সংক্রমণে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মিল মালিকদের অবস্থা হয়েছে, এখন বসতে চাইলে শুয়ে পড়ার মতন। সরকার সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুধুমাত্র রপ্তানীমূখী পোশাক শিল্প খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশের এক সপ্তাহ পর দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র তৈরি পোশাক শিল্পই নয়, অন্যান্য শিল্প কারখানা এবং দোকানপাটও খুলে গেছে। আলোচ্য জাতীয় দৈনিকের ৩ মে সংখ্যার রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মুখেই পোশাক শিল্পের বাইরে অন্য শিল্প কারখানাও চালু হচ্ছে। ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকার রি রোলিং মিল, সিমেন্ট, কেবল্স, ট্যানারি, পাকেজিং, জুতাসহ বিভিন্ন ধরণের কারখানার আংশিক বা পুরাদমে উৎপাদন শুরু হয়েছে। রিপোর্টে আর বলা হয়েছে, পুরাপুরি স্বাস্থ্যবিধি এবং নির্দেশনা না মানায় কয়েকজন পোশাক শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অন্য শিল্প কারখানর শ্রমিকরাও করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শিল্প পুলিশ সূত্রে ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনায় শিল্প কারখানা রয়েছে ৭ হাজার ৬০২ টি। এর মধ্যে রবিবার পর্যন্ত উৎপাদনে ছিলো আড়াই হাজারেরও বেশি কল কারখানা। ঐ দিকে গত ২৬ এপ্রিল থেকে খুলনায় রাষ্ট্রায়াত্ত¡ পাটকল সমূহ চালু হয়েছে। পাটকলগুলোতে সর্বমোট ২৪ হাজার শ্রমিক রয়েছে। অবশ্য সব শ্রমিক এখন কাজে যোগ দেয়নি।
তিন
নারায়ণগঞ্জে ঔষুধ, স্পিনিং, সিমেন্ট, প্যাকেজিং ও রি রোলিং মিলসহ ১২৪টি কারখানার বেশিরভাগই চালু হয়েছে। কিন্তু কারখানার অভ্যন্তরে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। দেশে চামড়জাত সামগ্রী ও জুতা তৈরির কারখানা রয়েছে ১৫০টিরও বেশি। এসব কারখানার শ্রমিক সংখ্যা ২ লক্ষ। এসব কারখানার অধিকাংশ খুলেছে বলে খবরে প্রকাশ। কিছু কিছু ট্যানারি শিল্পও খুলেছে। সেখানেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছেনা বলে অভিযোগ রয়েছে।
দৈনিক ‘ইনকিলাব’সহ একাধিক জাতীয় দৈনিকে মে মাসকে বাংলাদেশের জন্য ভয়ঙ্কর বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একটি জাতীয় দৈনিকের গত রবিবার সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, চলতি মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ বা পিক টাইম হিসাবে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এসময় সারাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও। এরই মধ্যে সাধারণ ছুটির শর্তাবলী শিথিল, পোশাক কারখানা, রেস্টুরেন্ট প্রভৃতি খুলে দেওয়া এবং প্রশাসনের ঢিলেঢালা ভাবের কারণে পাড়া মহল্লার দোকানপাট যে হারে খুলছে, তাতে ভবিষ্যতে সংক্রমণের সংখ্যা কি দাঁড়াবে সেটি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কিত। সমগ্র মার্চ মাসে যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫১, সেখানে ২৪ এপ্রিলের পর থেকে সেই সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। গত দেড় দুই সপ্তাহ ধরে সেই সংখ্যা সাড়ে ৫ শতের কিছুটা ওপরে নীচে ওঠানামা করছে। রবিবার এই সংখ্যা ৬৬৫ জন। সোম, মঙ্গলবারে কি হবে সেটি আল্লাহ মালুম। উল্লম্ফন গতিতে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ টেস্টিং ল্যাবের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সেই সাথে টেস্টের সংখ্যাও বৃদ্ধি। রবিবারে ৩২টি পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা করা হয়েছে। আগামী ৩/৪দিনের মধ্যে আরও ৩টি ল্যাব সংযুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
করোনায় আক্রান্ত রেগাীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হলো, অঘোষিত লকডাউন শিথিলতা। টেলিভিশন খুললেই দেখা যায় রাস্তাঘাটে লোকজন। ২৩ এপ্রিল অঘোষিত লকডাউন শিথিল করার পর রাস্তায় দেখা যাচ্ছে প্রাইভেট কারের ভীড়। এখন রিক্সা, ইজিবাইক, লেগুনা, ট্রাক রাস্তায় প্রচুর। শুরু থেকেই পুলিশের পাশাপাশি রাস্তায় নামানো হয়েছে র্যাব এবং সামরিক বাহিনী। বারবার বলা হচ্ছে, আপনারা ঘরে থাকুন। কিন্তু ঐ বলা পর্যন্তই। সরকারের নির্দেশ বা স্বাস্থ্যবিধি, যথা ঘরে থাকা এবং বাইরে শারীকির দূরত্ব বজায় রাখার জন্য পুলিশ, র্যাব বা সেনাবাহিনীর সেই কঠোরতা লক্ষ্য করা যায়নি। তাহলে সেনাবাহিনী নামানো হলো কেন? রাস্তায় মাইকিং করার জন্য বা তিন ফুট অন্তর অন্তুর গোল চিহ্ন দেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই সেনাবাহিনী নয়।
অথচ গত ২১ এপ্রিল আন্তঃ মন্ত্রণালয় মন্ত্রীদের এক জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে চলতি মে মাসে কম করে হলেও ৫০ হাজার এবং উর্ধ্বে ১ লক্ষ ব্যক্তি করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন। সেই শঙ্কা সামনে রেখেই ছুটি ৫ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয় এবং একই কারণে ১৬ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হচ্ছে। যখন লেখাটি প্রকাশিত হবে, তখন হয়তো ছুটি বৃদ্ধি সম্পর্কে গেজেট নোটিফিকেশন হয়ে যাবে। ২১ এপ্রিল যেখানে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ব্যক্তির সংক্রমণের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে তার একদিন পর ২৩ এপ্রিল একদিকে ছুটি বৃদ্ধি করা হয়, অন্যদিকে আবার লকডাউন শিথিল করা হয়। সরকারি সিদ্ধান্তের এই প্যারাডক্স বা বৈপরীত্য সচেতন মানুষের কাছে বোধগম্য হয়নি। শুধুমাত্র গার্মেন্টসই খুলে দেওয়া হয়নি, দোকানপাট খোলা রাখার সময়ও দুই ঘন্টা, অর্থাৎ দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। গার্মেন্টস খুলতে না খুলতেই দুইটি ফ্যাক্টরী বন্ধ করা হয়েছে। একটি হলো সাভারের জিরানী বাজারে অবস্থিত স্প্রিং ট্রেড লিঃ ও যশোরে অবস্থিত ডিভাইন গার্মেন্সট লিঃ। এই দুইটি কারখানা বন্ধের কারণ, এই দুই কারখানার দুই দুইজন শ্রমিকের করোনা টেস্ট পজিটিভ হয়েছে।
পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ, সরকার বলেছিল, ৩০ শতাংশ জনবল দিয়ে কারখানা খুলতে। কিন্তু সেখানে নাকি ৮০ শতাংশ জনবল দিয়ে ফ্যাক্টরী খোলা হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডাঃ রশিদ- ই- মাহবুব বলেছেন, এপিডোমিওলজি বা মহামারী বিজ্ঞান বলে যে সংক্রমক মহামারীতে লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব তথা শারীরিক দূরত্ব কঠোর ভাবে পালন করতে হবে। কিন্তু হাজার হাজার পোশাক কারখানা, লক্ষ লক্ষ দোকানপাট এবং গণ পরিবহণের অধিকাংশ শিথিল করে সরকার মহামারী নিয়ন্ত্রণের মূলনীতি নিষ্ঠার সাথে পালন করছেনা। ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।