Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কৃষক-শ্রমিকদের শ্রমমূল্য নিশ্চিত করাই হোক মে দিবসের ভাবনা

| প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০২০, ১২:০৯ এএম

আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও রক্তাক্ত ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত মে দিবসের ডাক এখনো সমভাবেই প্রাসঙ্গিক। প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ও জীবনমানের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন করে এলেও পুঁজির বিকাশের তুলনায় শ্রমিক শ্রেণির অবস্থার তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। প্রতিবছর সারাবিশ্বে ঘটা করে মে দিবস পালিত হলেও এবার বিশ্বজুড়ে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীতে সমগ্র বিশ্বের সব মানুষ জীবনের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকলেও সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। এ জন্য এবারের মে দিবস এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও আঙ্গিকে পালিত হচ্ছে। শ্রমিক দিবসে এবার হয়তো বড় বড় শ্রমিক সমাবেশে আনুষ্ঠানিক দাবি-দাওয়া উত্থাপিত হবে না। তবে করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বের দেশে দেশে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ এবং ঘরবন্দি কোটি কোটি মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার বাস্তবতায় পালিত হচ্ছে এবারের মে দিবস। বিশেষত বাংলাদেশে আমরা এই মে দিবসে কৃষক-শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর এক নতুন উপলব্ধির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা একদিকে কোটি কোটি মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়তে দেখছি, অন্যদিকে বোরো ধানের ভরা মওসুমে শ্রমিকের অভাবে হাওরাঞ্চলের অনেক কৃষক পাকা ধান ঘরে তুলতে পারছে না।
করোনাকালে প্রায় সব শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আমাদের কৃষকরা এবারো ধানের বাম্পার ফলনের দ্বারপ্রান্তে। আগাম বন্যার ঝুঁকি ও শ্রমিক সঙ্কট কাটিয়ে ধান ঘরে তুলতে পারলে হয়তো আগামী মাসগুলোতে দেশে সম্ভাব্য খাদ্য সঙ্কটের আশঙ্কা না থাকলেও কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বাড়তি কর্ম উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশেষত ধানের ন্যায্যমূল্য এবং খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদার অন্যান্ন উৎসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। করোনাকালের চরম সঙ্কটে দেশের পোল্ট্রিখাত, ডেয়ারিফার্মসহ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার খাতগুলো খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। ধানের পাশাপাশি এবার রাজশাহীতে আমের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। করোনা মহামারীতে লকডাউনের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা উৎপাদিত সব্জি বিক্রি করতে না পারায় লোকসানে পড়তে হচ্ছে। ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণে বাম্পার ফলনের পরও উৎপাদন খরচ না উঠার ঝুঁকিতে পড়তে হয় কৃষকদের। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার সরকারি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষকদের বিড়ম্বনা ও মধ্যস্বত্তভোগিদের দৌরাত্ম্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের ধান-চাল ক্রয়ে অস্বচ্ছতা, দলীয়করণ এবং দুর্নীতির কারণে প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চনার শিকার হন। সময়মত ধান ক্রয় শুরু না করার কারণে ঋণগ্রস্ত কৃষকরা আড়তদারদের কাছে নামমাত্র মূল্যে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এসব বিষয় বিবেচনা করে ধান-চাল ক্রয়ে স্বচ্ছতার পাশাপাশি এই কার্যক্রম দ্রুতায়িত করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সাথে কৃষকদের কাছ থেকে ধানক্রয়ে সরকারি মূল্যের পাইকার-মিলারদের মূল্য সমন্বয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যবধান দূর করা আবশ্যক।
করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শ্রমিক কাজ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তরফ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারলে সস্তা শ্রমের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আমাদের গার্মেন্ট শিল্প এ ধরনের বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। ইতোমধ্যে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে ক্রয়াদেশ বাতিল না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। পাশাপাশি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নেও বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প ও শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় প্রয়োজনীয় লবিং জোরদার করার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্বমন্দায় সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত পণ্যের চাহিদা পূরণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প নতুন সম্ভাবনা হয়ে উঠতে পারে। সেই সাথে কৃষিপণ্যের মূল্য সংরক্ষণ এবং পচনশীল ফল ও সব্জি সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রফতানি ও বাজারজাতকরণের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া হলে করোনা মহামারীর সঙ্কট কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন গতি লাভ করতে পারে। কৃষকের ধানকাটা নিয়ে একশ্রেণির জনপ্রতিনিধিকে নাটকীয় ফটোসেশন করতে দেখা যাচ্ছে। কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনাও যেন এ রকম ফটোসেশনে পরিণত না হয়, সে দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় কৃষক, কৃষিশ্রমিক ও কৃষিপণ্যের স্বার্থ সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণই হোক এবারে মে দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। করোনা মহামারীর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে যে সব পোশাক শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছেন তাদের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও স্বার্থ সংরক্ষণে মালিকপক্ষ ও সরকারের কার্যকর উদ্যোগই হোক এবারের মে দিবসের অন্যতম দাবি। দেশের সব কৃষক, কৃষি শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিক ও বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত রেমিটেন্স যোদ্ধাদের প্রতি আজকের মে দিবসে আমাদের শুভ কামনা রইল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন