Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কৃষকের পাশে সর্বস্তরের মানুষ

| প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০৩ এএম

বোরোধানের বাম্পার উৎপাদন কৃষকদের আনন্দ, তৃপ্তি ও স্বস্তির কারণ হলেও শেষ পর্যন্ত তারা ধান কেটে ঘরে তুলতে পারবে কিনা, তা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না। শ্রমিক সংকটই ছিল এর প্রধান কারণ। প্রবল আশঙ্কা ছিল, যথাসময়ে কাটতে না পারলে হাওর ও নিচু এলাকার ধান বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে অথবা জমিতেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনুরূপভাবে দেশের অন্যান্য এলাকায়ও বৃষ্টিপাত, ঝড়, শিলাপাত ও বান-বন্যায় ধান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ধান নষ্ট কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল দ্রুততম সময়ে সব ধান কাটা। এজন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রমিকের সংস্থান, যার প্রকট অভাব লক্ষ করা যায়। অন্যান্য বারেও বোরোধান কাটার মওসুমে শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়। এবার সে সংকট আরো বেশি করে দেখা যায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে। দেশজুড়ে চলছে সাধারণ ছুটি। কার্যত দেশ লকডাউনে। এছাড়া সামাজিক সঙ্গনিরোধ কর্মসূচি চলছে। দেশের তাবৎ মানুষ প্রায় গৃহবন্দি। সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ। এমতাবস্থায়, শ্রমিক পাওয়া যে অত্যন্ত কঠিন, তাতে সন্দেহ নেই। বোরোধানের মওসুমে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় শ্রমিকরা ধান কাটতে যায়। এবার এ সংখ্যা স্বভাবতই কমে যায়। দলবদ্ধভাবে তাদের যাতায়াত বারিত হওয়ায় এবং গণপরিবহন না থাকায় প্রায় সব এলাকায় শ্রমিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এই প্রেক্ষাপটে স্থানীয় প্রশাসন ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট এলাকার ছাত্র, যুবক, রাজনৈতিক কর্মী এবং শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সকল মানুষ কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা স্বেচ্ছায় ধান কাটার কাজে কৃষকদের সহায়তা করে। কৃষকদের সহায়তায় এভাবে সকলের এগিয়ে আসার, এটি একটি বিরল নজির।
জানা গেছে, স্বেচ্ছা শ্রমিকদের হাত লাগানোর ফলে ইতোমধ্যেই হাওর এলাকার ৫০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। এদিকে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের নিচের দিকের কোনো কোনো এলাকায় পাকা ধান ডুবোডুবো অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। সেই ধান কেটে আনার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে, যদিও প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে এবং পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাওর এলাকায় কম্বাইন্ড হার্বেস্টার মেশিনের মাধ্যমেও ধান কাটা চলছে। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে এরকম ১১১টি কম্বাইন্ড হার্বেস্টার মেশিন ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও বস্তবন্দির কাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, আর অন্তত সপ্তাহ খানেক অবকাশ পেলে হাওর এলাকার প্রায় সমুদয় ধান কাটা সম্ভবপর হয়ে যাবে। এই বৈশ্বিক মহাদুর্যোগকালে এভাবে খেতের ধান ঘরে তোলার যে গণপ্রয়াস লক্ষ করা গেছে, তা অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, দেশের সব এলাকায় বোরোধান একই সময়ে উঠে না। কিছুটা আগপিছু হয়। সাধারণত হাওর এলাকায় এবং উত্তরাঞ্চলের চলনবিল এলাকায় আগে বোরোধান লাগানো ও কাটা হয়। কারণ, এ দুই এলাকায় ধান ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই হাওর এলাকার ধান ঘরে তোলার পর চলনবিল এলাকায় ধান কাটার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। ইতোমধ্যে চলনবিল এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। অন্যান্য এলাকা থেকে কৃষিশ্রমিক এই এলাকায় স্থানান্তর করা হলে এবং কম্বাইন্ড হার্বেস্টার মেশিনগুলো সেখানে নিয়ে যাওয়া হলে ওই এলাকায় ধান কাটা সহজেই সম্পন্ন হতে পারে। কিছুদিন আগে কৃষিমন্ত্রী রংপুর থেকে প্রায় হাজার কৃষিশ্রমিককে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পাঠানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওদিকে পুলিশের তরফে কিছু শ্রমিককে হাওর এলাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখনো এধরনের পরিকল্পিত শ্রমিক স্থানান্তর চলতে পারে, যাতে শ্রমিক সংকট কিছুটা হলেও উপশম হয়। আর স্বেচ্ছশ্রমে ধান কাটার বিষয়টিকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা যেতে পারে।
দেশে বরাবরই কৃষিশ্রমিকের সংকট আছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, এবার বোরোধান কাটতে অন্তত ৮৪ লাখ শ্রমিকের প্রয়োজন। কৃষিশ্রমিকের মোট সংখ্যা ৭৩ লাখের মতো। ঘাটতি অন্তত ১৩ লাখ। এ বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ঘাটতির সঙ্গে করোনাজনিত ভীতি, বিধিনিষেধ ও অচলাবস্থা যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে অত্যন্ত নাজুক করে তুলেছে। অবশ্য পরিকল্পিত উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিলে শ্রমিক সংকট মোকাবিলা করা মোটেই কঠিন হওয়ার কথা নয়। বিআইডিএস-এর মতে, প্রলম্বিত ছুটির কারণে ২ কোটি ৪২ লাখ বেতনভুখ মজুর ও শ্রমিক কর্মহীন হয়ে আছে। এই কর্মহীন মজুর ও শ্রমিকদের কৃষিশ্রমিক হিসাবে কাজে লাগানো গেলে কৃষিশ্রমিকের অভাব যেমন দেখা দিতো না, তেমনি এরা বাড়তি কিছু আয়-রোজগারও করতে পারতো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শ্রমিক সংকট মোচনে শ্রমিক ম্যানেজমেন্টের বিষয়ে চিন্তা করে কিনা, আমরা জানি না। না করলে করা উচিৎ বলে মনে করি। করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট মারাত্মক রূপ নিতে, এমন কি দুর্ভিক্ষ হতে পারে বলে ইতোমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সুতরাং কৃষির প্রতি আমাদের যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। উৎপাদন যতটা সম্ভব বাড়াতে হবে এবং কোনো কারণে উৎপাদন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে। আজকে যে সর্বস্তরের মানুষ কৃষকদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে, তার মূলে আছে তাদের সচেতন খাদ্যচিন্তা। তারা জানে, ধান নষ্ট হলে শুধু কৃষকই নয়, তাদেরও খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। আরো একটি বিষয় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে। কৃষক যাতে তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলে ফসল উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া গোটা দেশের মানুষের ওপরই প্রতিফলিত হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষক


আরও
আরও পড়ুন