পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত শনিবার ১১ এপ্রিল বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ওপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে নিয়মিত প্রেস বুলেটিন জারি করে সে বুলেটিনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিককে বেশ আত্মতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট মনে হলো। মন্ত্রী মহাদয়ের এই আত্মতৃপ্তি ও আত্মতুষ্টি দেখে অবাক হয়েছি। আগের দুই দিনের তুলনায় আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। আমি অবাক হয়েছি এই কারণে যে, এর আগের দিন পরীক্ষা হয়েছিল ১১ শত নমুনারও বেশি। আর শুক্রবারে (শনিবারে শুক্রবারের পরীক্ষা দেওয়া হয়েছে) পরীক্ষা করা হয়েছে ৯৫৪টি। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে স্যাম্পল টেস্ট এবং করোনার প্রকোপের যে অবস্থা সেই অবস্থায় উপসংহারে আসার কোনো রকম সুযোগ নেই। আমি সম্মানিত পাঠক ভাইদেরকে পরিসংখ্যানের ভারে আক্রান্ত করতে চাই না। কিন্তু তারপরেও নিরেট সত্যটি বের করে আনার জন্য কিছু পরিসংখ্যানের সমর্থনতো নিতেই হবে। যদিও বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে জানুয়ারি মাসে। কিন্তু দেশে প্রথম করোনা ধরা পড়ে ৮ মার্চ। ৮ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৮ হাজার ৩১৩। এই ৩২ দিনে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮২, মৃত্যুর সংখ্যা ৩০। প্রথম যখন করোনা ধরা পড়ে তখন একটি মাত্র কেন্দ্রে নমুনা পরীক্ষা করা হতো। সেটি হলো, আইইডিসিআর অর্থাৎ রোগতত্ত্ব, মহামারী ও গবেষণা সংস্থা। তখন দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ এর ওপর নমুনা পরীক্ষা করা যেতো না। এপ্রিল মাসের ৩/৪ তারিখ থেকে করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো হয়। দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৯ শত থেকে সাড়ে ১১ শত। কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১৫টি। তারপরেও নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২ দিনে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৮৩১৩। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ২৫৯টি। অথচ বর্তমানে সংস্থাপিত নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা হলো দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার। অথচ হচ্ছে সেখানে ২৫৯টি। এর পরেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন কী করে? যেখানে দক্ষিণ কোরিয়া পরীক্ষা করেছে প্রতিদিন ২৩ হাজার নমুনা, সেখানে বাংলাদেশে দৈনিক ২৫৯টি নমুনা পরীক্ষা করে কীভাবে বুঝবে যে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ কত ব্যাপক? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে শনিবার রাতে বলতে শুনলাম, আমরা পৃথিবীতে দৈনিক সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা করেছি। তারপরেও পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। সেখানে ১৬ কোটি ৬০ লক্ষ লোকের দেশ বাংলাদেশে এত নগন্য সংখ্যক টেস্ট করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তো দূরে থাকুক, পরিস্থিতির ভয়বহতা সম্পর্কে ধারণা করাই সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। গত শনিবারের বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন যে, সারা দেশে বুথ করে নমুনা সংগ্রহ করা হবে। দুদিন আগে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, সরকার আরো ১৩টি কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে। ঐ ১৩টি কেন্দ্র স্থাপতি হলে মোট পরীক্ষা কেন্দ্র হবে ২৮টি এই ২৮টি কেন্দ্রের সংস্থাপিত পরীক্ষার সক্ষমতা হবে ৯ থেকে ১০ হাজার নমুনা।
এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা দাঁড়িয়েছে সেই ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই’। তারপর থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের সর্বোচ্চ তৎপরতার প্রয়োজন ছিল। এখন পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসককর্মী ও প্রশিক্ষিতি স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আগামী ২/১ সপ্তাহের মধ্যে সেটি হবে বলেও মনে হয় না।
দুই
করোনাভাইরাসে পরীক্ষা যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেটি গত ১৬ মার্চ দৃঢ়তার সাথে বলেছেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব। তিনি বলেছেন, You cannot fight a fire blindfolded. And we cannot stop this pandemic if we don’t know who is infected. We have a simple message for all countries: test, test, test.Test every suspected case.
বাংলা: চোখ বাঁধা অবস্থায় আপনি আগুনের সাথে যুদ্ধ করতে পারেন না। যদি আমরা জানতে না পারি যে কে সংক্রমিত হয়েছে তাহলে আমরা এই বৈশ্বিক মহামারীর সাথে যুদ্ধ করতে পারি না। সব দেশের জন্য আমাদের একটি সহজ বার্তা: পরীক্ষা কর, পরীক্ষা কর এবং পরীক্ষা কর। প্রতিটি সন্দেহভাজন কেস পরীক্ষা কর।
যত বেশি সম্ভব তত বেশি নমুনা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় ধনকুবের বিল গেট্স। জোর দিয়েছেন এই সময় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ রোগ প্রতিরোধক এবং সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যান্থসনী স্টিফেন ফাউসি। আরো জোর দিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা ভাইরোলজিস্ট ও জীবাণু বিশেষজ্ঞ গুইডো ভ্যানহ্যাম। ডা. ফাউসি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কর্তৃক গঠিত করোনা নিরোধক টাস্ক ফোর্সের প্রধান। বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন নোবেল পুরুস্কার বিজয়ী ড. ইউনুস, বাংলাদেশের সেরা ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। এই বিষয়টির ওপর আরো জোর দিয়েছেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা হার্ট সার্জন ডা. দেবী শেঠী এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
ওপরে যেসব মনিষীর কথা উল্লেখ করা হলো তাদের উক্তি ও মন্তব্য হাতে নাতে ফলে গেছে রবিবার। রবিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস বুলেটিনে জানানো হয় যে শনিবার সকাল ৮টা থেকে রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৩৯ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৪ জন। পরের দিন সোমবার জানা গেছে, সেদিন সকাল পর্যন্ত নতুন আক্রান্ত হয়েছে ১৮২ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৫। এই নিয়ে বাংলাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ৮০৩ এবং মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৯। এই পরিসংখ্যান থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা যত বাড়বে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও তত বাড়বে।
বাংলাদেশের খ্যাতিমান ভাইরোলজিস্ট (জীবাণু বিষেশজ্ঞ) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন যে, যদিও কয়েক লক্ষ নমুনা পরীক্ষা করলে বাংলাদেশে করোনার বিস্তৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে, কিন্তু কঠোর বাস্তবতা হলো এই যে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যাবের (পরীক্ষাগার) সংকট রয়েছে। অন্যদিকে রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনবলের তীব্র অভাব। আমরা যত দাবি করি আর যত কথাই বলি না কেন আমরা আমেরিকা বা ইউরোপের পর্যায়ে যেতে পারবো না। নিউইয়র্কের জনসংখ্যা ৮৫ লাখ। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইট ভিজিট করলাম। গত রবিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। (বাংলাদেশ সময়) সমগ্র আমেরিকায় পরীক্ষা করা হয়েছে ২৬ লাখ ৮৮ হাজার ৭৬৬ জনকে। উল্লেখ্য, আমেরিকার জনসংখ্যা ৩৩ কোটি। অর্থাৎ গত শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ৮.১৪ শতাংশের টেস্ট করা হয়েছে। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা হলো ১ কোটি ৮৮ লক্ষ ৪ হাজার। আর নিউইয়র্ক শহরের জনসংখ্যা ৮৫ লক্ষ। এখন নিউইয়র্কে রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ৯৮০ জনকে। সমগ্র নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যকে বিবেচনায় নিলে সমগ্র রাজ্যের জনসংখ্যা ২৩.৩৪ শতাংশের পরীক্ষা করা হয়েছে। আর নিউইয়র্ক শহরের জনসংখ্যা বিবেচনায় নিলে সেটি হয় ১৯.৫ শতাংশ।
তিন
এর পাশাপাশি বাংলাদেশের নমুনা পরীক্ষার অবস্থা দেখুন। বাংলাদেশে শনিবার পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৮৩১৩ জন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। দেশের মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় নিলে শনিবার পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ০.০০৫ শতাংশ। অর্থাৎ সমগ্র জনসংখ্যার ১ শতাংশও নয়, আধা শতাংশও নয়। বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ২ কোটি। ঢাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় নিলে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ০.০৪ শতাংশ। অর্থাৎ ঢাকা মহানগরীর কথা চিন্তা করলেও আমরা এখন পর্যন্ত আধা শতাংশ জনগোষ্ঠিকেও পরীক্ষা করতে পারিনি। এসব দিক বিবেচনা করে একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, যদি ২ লক্ষ মানুষকেও পরীক্ষা করা যায় তাহলে ঢাকার জনসংখ্যার ১ শতাংশকে পরীক্ষার আওতায় আনা যেতে পারে। ২৮টি পরীক্ষাগারে সংস্থাপিত পরীক্ষার ক্ষমতা হলো ১১ হাজার। আমরা যদি দৈনিক ১০ হাজার লোককেও পরীক্ষা করতে পারি তবে আগামী এক মাসে ৩ লক্ষ মানুষের পরীক্ষা করতে সমর্থ হব। এর সাথে যদি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্যের মতো বেসরকারি খাতের অন্যরাও এগিয়ে আসে তাহলে দৈনিক ১০ হাজার মানুষকে পরীক্ষা করা অসম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা ৫ কোটি ১২ লক্ষ। সেখানে প্রতিদিন ২০ হাজার মানুষকে পরীক্ষা করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা মাসে ৬ লক্ষ মানুষকে পরীক্ষা করেছে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশকে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সে জন্যই চীনের পরেই দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীতে করোনা মোকাবেলায় সবচেয়ে সফল দেশ হিসাবে প্রসংশিত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কিত তথ্য ‘ওয়ার্ল্ড ও মিটার’ নামক ওয়েব সাইট থেকে নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে বোধগম্য কারণে দক্ষিণ কোরিয়াকে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। তবে দৈনিক ১০ হাজার করে নমুনা পরীক্ষা করতে পারলে একটি বেঞ্চমার্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। একমাত্র তখনই আমরা বলতে পারবো যে, বাংলাদেশে করোনা মহামারী আকার ধারণ করেছে কি না।
শেষ করার আগে একটি বিষয় বলতেই হচ্ছে। সেটি হলো, শুধুমাত্র নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ালেই চলবে না, সেই সাথে সারাদেশকে লকডাউনের আওতায় আনতে হবে। প্রায় সাড়ে ১৩ লক্ষ বর্গমাইলের বিশাল ভারতের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। সেখানে শনিবার পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৮৫০৪ জন এবং মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২৮৯ জন। সেই সমগ্র ভারতকে গত ৩ সপ্তাহ ধরে লকডাউনে রাখা হয়েছে। আরো ৩ সপ্তাহ ঐ লকডাউন বৃদ্ধি করা হয়েছে। লন্ডনের ব্রাইটন থেকে আমার ভাগ্নে শনিবার টেলিফোনে জানিয়েছে যে, সেখানে লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ভারত যেটা পারলো বাংলাদেশ সেটা পারলো না কেন? বাংলাদেশকেও কাল বিলম্ব না করে এর ৫৬ হাজার বর্গ মাইলকেই লকডাউনের আওতায় আনতে হবে। লকডাউন যাতে কার্যকর হয় তার জন্য পুুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীকে যতখানি কঠোর হওয়া প্রয়োজন ততখানিই কঠোর হতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।