Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টেস্ট সংস্কৃতির অভাব, দায় কার?

ইমরান মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০২২, ১২:০০ এএম

টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার বাইশ বছর পরও ‘সম্মানজনক হার’ নিয়েই যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে চলেছে বাংলাদেশ। সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পিছিয়ে থাকা কোনে দেশ, কিংবা কুলীন এই সংস্করণে কোনো নবাগত দলের কাছে হারলেও যেন তার ক্ষত খুব একটা পীড়া দেয় না বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের- এমন নানান তীর্যক বাক্য বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা প্রায়সই ছুড়ে দেন দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা বিসিবির দিকে। তাদের অভিমত, ‘টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদাই এখনও দিতে শিখিনি আমরা’! বাংলাদেশের দর্শক-সমর্থকরা কষ্ট করে, গাঁটের টাকা খরচ করে যেভাবে মাঠে গিয়ে খেলা দেখেন, নিঃসন্দেহে এটি বাজেভাবে হারের কারণে তাদের মনের কোনে জমানো ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু রাসেল ডমিঙ্গো?
অ্যান্টিগায় অসহায় আত্মসমর্পণের পর সেন্ট লুসিয়ায় যখন তিন দিনেই হারের মুখে বাংলাদেশ দল, তখনই এই টেস্ট সংস্কৃতির অভাবের বিষয়টি তুলেছিলেন বাংলাদেশের হেড কোচ। বৃষ্টিতে কিছুটা বিলম্বিত হলেও বড় হার (১০ উইকেটে) এড়াতে পারেনি সাকিব আল হাসানের দল। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ দুই ম্যাচ সিরিজে হোয়াইটওয়াশের দিনে বাংলাদেশ দেখে ফেলেছে নিজেদের শততম টেস্ট হারও। সেটিও মাত্র ১৩৪ ম্যাচ খেলেই! বাকি ১৬ জয় আর ১৮টি ড্র করতে পেরেছে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে ১০০টা টেস্ট হারল বাংলাদেশ সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে। সাদা পোশাকে বাংলাদেশের রুগ্ন দশারই জানান দেয় যেন তা।
২০১৮ সালে সবশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ একইভাবে দুই ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশড হয় বাংলাদেশ। এবার অনেক আশা নিয়ে এসেও সেই ব্যর্থতার বৃত্তেই আটকে থাকল দল। রাখতে পারল না উন্নতির ছাপ। ব্যাটিং, টেকনিক আর মানসিকতা নিয়ে এক গাদা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে শেষ করল হতাশায় ভরা টেস্ট সিরিজ। পরে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে সেই সংস্কৃতিকেই কাঠগড়ায় তুললেন বাংলাদেশ অধিনায়কও। এই অলরাউন্ডারের কাছে জানতে চাওয়া হয় আমাদের কিছু খেলোয়াড়ের টেস্ট বিমুখীতাই এই পারফরম্যান্সের কারণ কিনা। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সাকিব বলেন, ‘খেলোয়াড়দের উপরই কেবল দোষ দিবেন তা ঠিক না। আমাদের দেশের সিস্টেমটাই এমন। আপনারা কবে দেখেছেন ২৫ হাজার দর্শক এক সাথে টেস্ট ম্যাচ দেখছে? ইংল্যান্ডে কিন্তু প্রতি ম্যাচেই দেখে। আসলে টেস্টের সংস্কৃতিটাই আমাদের দেশে ছিল না কখনো, এখনো নাই।’
তবে সাকিব ক্রিকেটকে টেস্টমুখী করার দায়িত্ব নিতে চান। তার ধারনা সকলের চেষ্টা ব্যাতিত সেটা সম্ভব নয়। তিনি দাবি করেন, ‘সংস্কৃতিটা নেই বলে যে একদমই হবে না তা কিন্তু না। এই ব্যাপারটাতে পরিবর্তন আনাটাই আমাদের বড় দায়িত্ব। সবাই মিলে পরিকল্পনা করে যদি এগিয়ে যাওয়া যায় তাহলে হয়ত সম্ভব হবে। তানাহলে বেশিদ‚র আগানো সম্ভব নয় সেহুতু সংস্কৃতিটাই নেই।’ নিজের দীর্ঘ দিনের টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসা যায়, ‘টেস্ট ক্রিকেটকে আমরা খুব বেশি ম‚ল্যায়ন করি না। এটা সত্য যে আমরা ভাল ফলাফল করতে পারিনি তাই ম‚ল্যায়নও হয়নি। একটির সাথে আরেকটি সম্পৃক্ত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে আমরা যেনো ঘরের মাঠে ধারাবাহিক ভাবে টেস্ট ম্যাচ ভাল খেলি। তখন হয়তে ঘরের বাহিরে একটা বাজে সিরিজ গেলেও খুব একটা চোখে পড়বে না ব্যাপারটা।’
বাংলাদেশ তাদের পরবর্তী টেস্ট খেলবে সামনের নভেম্বরে ভারতের বিপক্ষে। এর মাঝে যে সময়টুকু আছে সেটার যথার্ত ম‚ল্যায়ন করে, সকলের প্রচেষ্টায় সামনে এগোতে চান সাকিব। সাকিব জানান, ‘এই বিরতির মাঝে যারা টেস্ট খেলতে আগ্রহী তারা হয়ত যায যার জায়গা থেকে কাজ করবে। উন্নতি ছাড়া আর কোন পথ নেই। আমাদের এমন কেউ নেই যাদের আনলে আমরা টেস্টে ভালো করে ফেলবো। যারা আছি বা বাইরে যে আর দুই চারজন আছে সবাই মিলে যদি পরিকল্পনা করে আগাতে পারি তাহল ভালো কিছু সম্ভব। তা না হলে এতদিন ধরে যা হয়ে আসছে তার খুব একটা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
কাপ্তান পরিকল্পনা করতে চান কোচিং প্যানেল, খেলোয়াড় ও বোর্ডের একত্রিত চেষ্টায়। এই ব্যাপারে সাকিব বলেন, ‘আমাদের নিজেদের পরিবর্তন জরুরী। এই জায়গায় কাজ করার আছে। সবাই মিলে পরিকল্পনা করতে হবে। একজনকে ছাড়া আরেকজন পরিকল্পনা করে আসলে সফল হওইয়া সম্ভব নয়। সবাই মিলে বসে যদি আমরা একটা পরিকল্পনা ধরে আগাই তাহলেই এক দেড় বছর পর ধারাবাহিক পারফর্ম করা সম্ভব।’
তাহলে গোড়াতেয় গলদ! এই হারেরপরও টেস্ট ক্রিকেটে অন্য দেশগুলোর শুরুর অবস্থা টানতে একটি তথ্য দিয়েছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তার কথা ছিল এরকম, ‘সংস্কৃতি গড়ে উঠতে সময় লাগবে। ভারতের প্রায় ২৬ বছর লেগেছিল প্রথম ম্যাচ জিততেৃ এত অস্থির হলে হবে না। আপনারা আরেকটা ব্যাপার দেখেন, টেস্টের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নিউ জিল্যান্ড। তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে ৮টার মধ্যে মাত্র ২টি সিরিজ জিততে পেরেছে (আদতে সিরিজ নয়, ম্যাচ)। তার মানে কি নিউজিল্যান্ড খারাপ দল হয়ে গেল?’
সমস্যাটা এখানেই। টেস্ট অভিষেকের পর প্রথম টেস্ট জিততে ভারতের মোটেও ২৬ বছর লাগেনি, লেগেছিল ১৯ বছর। কিন্তু সময়ের হিসাব করলে এখানে চলছে না আরেকটি বড় কারণে। ওই ১৯ বছরে তারা যে খেলেছিল মাত্র ২৫ টেস্ট। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কারণে ১০ বছর তো কোন খেলাই হয়নি সেসময়। ভারত তাদের শুরুর ১৯ বছরে যেখানে খেলছিল ২৫ টেস্ট। বাংলাদেশ ২২ বছরে খেলে ফেলেছে ১৩৪ টেস্ট। এবং হেরেছে ১০০টিতেই।
টেস্ট ম্যাচে জিততে না পারলেও ম্যাচ বাঁচানোকেও দেখা হয় বড় করে। বাংলাদেশ সেই জায়গায় দিনের পর দিন ব্যর্থ। সেন্ট লুসিয়ায় হারের পর অধিনায়ক সাকিব সামগ্রিক সংস্কৃতি না থাকাকে দায় দিয়েছেন। সংস্কৃতি না থাকার কথা উঠে আসে অনেকের আলোচনায়। বর্তমান বোর্ড প্রধানও টেস্টে দুরবস্থা স্বীকার করে উন্নতি করার কথা বলেন প্রায়ই। মজার কথা হলো টেস্টে বাংলাদেশের ২২ বছরের পথচলায় যে প্রশাসক সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্বে ছিলেন তিনি নাজমুল হাসানই। গত ১০ বছর ধরেই তিনি বিসিবি প্রধান। প্রশ্ন উঠতে পারে সংস্কৃতি না থাকার দায়টা কি তিনি এবার নেবেন?

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টেস্ট


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ