Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনাভাইরাস রোগ এবং আমাদের কী করণীয়

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০২ এএম

পত্রিকা খুললেই এক খবর। টিভি খুললেও একই খবর। করোনাভাইরাস। অদ্ভুত রোগ। অদ্ভুত তার মতিগতি। গত শনিবার দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠার একটা খবরের শিরোনাম ছিল: বাতাসে ২৭ ফুট ভেসে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকগুলো নির্দেশনা দিয়েছেন করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায়। কিন্তু তিনি নিশ্চিত নন তাঁর দিক-নির্দেশনাগুলো পরিপূর্ণ সুফলদায়ক হবে কিনা। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

অনেকদিন পর এই একটা ইস্যুতে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল একে অপরের দোষ অন্বেষণ না করে এই ভয়ঙ্কর রোগ মোকাবেলায় সবার প্রতি যার যার সাধ্য মোতাবেক কাজ করে যাবার আহবান জানিয়েছেন। এটা অন্তত রাজনৈতিক বিবেচনায় আজকের এ দুঃসময়ে একটা সুসংবাদ।

পত্রিকা পাঠকবর্গ মাত্রই জানেন, করোনাভাইরাস নামের অদ্ভুত রোগটি প্রথম শুরু হয় চীনে। চীন হচ্ছে সেই দেশ যে দেশ এককালের কম্যুনিস্ট একদলীয় শাসন এখনো ধরে রেখেছে। চীনে এই রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও অচিরেই রোগটি ছড়িয়ে পড়ে উন্নত ও আধুনিক মহাদেশ হিসাবে পরিচিত ইউরোপে। বিশেষতঃ ইউরোপের ইতালিতে এই রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব শুরু হলেও অল্পদিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। এমন কি এরোগ ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে পাড়ি জমায় বৃটেনে। বৃটেনে পৌঁছার পর প্রথম দিকেই এ রোগ সংক্রমিত হয় প্রিন্স চার্লসের দেহে। বৃটেনের রাণী এলিজাবেথ করোনাভাইরাসের আক্রমণের ভয়ে সপরিবারে প্যালেস ত্যাগ করেছেন এরকম একটা সচিত্র প্রতিবেদন বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় এ সময়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন হাসপাতালের আইসিইউতে।

তবে চীনে প্রথম শুরু হওয়া এ মারাত্মক রোগ ইউরোপ ছাড়িয়ে বিশাল মহাসাগর পাড়ি দিয়ে সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে গেছে। শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ স্থান দখল করে বসেছে। গত শনিবার দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত এক সংবাদের শিরোনাম ছিল : নিউইয়র্কে ঘণ্টায় ২৩ জনের মৃত্যু। এর সাথে একটা উপশিরোনাম ছিল: সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি আসা এখনো বাকী। এ বক্তব্য দিয়েছে জাতিসংঘ।

যে করোনাভাইরাস চীন থেকে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে সেই করোনাভাইরাস কী চীনের সামান্য দূরে অবস্থিত বাংলাদেশে আসেনি? এরকম বলতে পারলে আমরা নিজেকে সৌভাগ্যবানই মনে করতাম। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। গত রবিবারের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটা খবর থেকে জানা গেছে, ১০ জেলায় করোনার সংক্রমণে আরো দুই জনের মৃত্যু, নতুন আক্রান্ত ৯ জন। এই সংবাদের প্রধান শিরোনাম ছিল: সামনে ভয়ংকর দিন! দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ঐ একই দিনে প্রকাশিত আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল: বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ১১ লাখ। মৃত্যু ৬২ হাজারেরও বেশি। দৈনিক ইত্তেফাক ঐ একই দিনে (রবিবার) করোনাভাইরাস আক্রান্ত প্রধান দেশগুলোর নাম দেয়া হয়েছে এভাবে: ইতালিতে মোট আক্রান্ত ১ লক্ষ ১৯ হাজার ৮২৭, মৃত্যু ১৪,৬৮১, স্পেনে ১, ২৪, ৭৩৬, মৃত্যু ১১২,৭৪৪, যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত ২,৮০,৩৬৭, মৃত্যু ৭,৪৯১, ফ্রান্সে আক্রান্ত ৮৩, ১৬৫, মৃত্যু ৬৫০৭, যুক্তরাজ্যে ৪১৯০৩, মৃত্যু ৪৩,১৩, ইরানের আক্রান্ত ৫৫,৭৪৩, মৃত্যু ৩,৪৫২, চীনে আক্রান্ত ৮১,৬৩৯, মৃত্যু ৩, ৩২৬।

দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় গত রবিবার বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে প্রচেষ্টা রয়েছে আমাদের উদ্বেগ হ্রাস করার। তিনি বলেছেন, উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশ অনেক ভালো

এদিকে বাংলাদেশের করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার প্রথম দিকে অনেকের মধ্যে ঢাকা ত্যাগের হিড়িক শুরু হয়েছিল। তবে অল্পদিন পরেই এর বিপরীত দৃশ্য দেখা যেতে থাকে। গ্রামে যারা গিয়েছিল, তাদের কর্মস্থল ছিল ঢাকা। কাজ করতে না পারলে তাদের সংসার চলবে কী করে? সুতরাং তাদের লক্ষ্য পুনরায় হয়ে দাঁড়াল ঢাকায় ফিরে আসা। ঝুঁকি নিয়ে ফিরে আসা শুরু করে পোশাক কর্মীরাও। এতে তাদের অনেক ঝুঁকিও নিতে হয়।

করোনাভাইরাস রোগে আক্রান্তদের ব্যাপারে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মোটেই অবহেলার যোগ্য নয়। বিশ্বের কোন দেশে কত শতাংশ এই রোগে মৃত্যুবরণ করছে তা দেখলেই এটা বোঝা যাবে। গত রবিবার দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ এই তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: মৃত্যুর হারে বাংলাদেশ ইতালির কাছাকাছি। ঐ একই পত্রিকায় কোন দেশে আক্রান্তের মধ্যে কতজন মৃত্যু বরণ করেছে তার বিস্তারিত হিসাব দেয়া হয়েছে। এই তথ্য মোতাবেক এখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে কত শতাংশ মারা গেছে সেটা জানা যাবে। পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে আমরা সেটা জানিয়ে দিচ্ছি:

ইতালি ১২.১৫, বাংলাদেশ ১১.৪২, যুক্তরাজ্য ৯.৪৪, স্পেন ৯.৪১, ফ্রান্স ৭.৯১, ইরান ৬.১৯, চীন ৪.০৭, শ্রীলঙ্কা ৩.০৮, ভারত: ২.৭০, যুক্তরাষ্ট্র: ৬.৬। এর পাশেই ঐ একই পত্রিকায় আরেকটি সংবাদ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: একদিনে সর্বোচ্চ ৯ জন শনাক্ত, মৃত্যু ২।
বিশ্বব্যাপী একই সময়ে এই বিস্ময়কর ভয়াবহ রোগের আক্রমণের ফলে পেশাগত ও নৈতিকতা বিবেচনায় দায়িত্বপালনরত চিকিৎসক ও নার্সিং পেশায় যাদের কর্মরত থাকতে হয়, তাদের কিন্তু বিরাট ঝুঁকির মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাতে হয় তাদের আত্মত্যাগ ও সেবার মনোভাবের জন্য। তবে এক্ষেত্রে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য করোনাভাইরাস রোগে আক্রান্ত হওয়ার থেকে মুক্ত ও নিরাপদ থাকতে দেশের জনগণকে নিজেদেরও উদ্যোগী হতে হবে নিজেদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস একবার যখন ঢুকে পড়েছে তখন এই রোগে চিকিৎসক ও নার্সদের বাইরে জনসাধারণেরও অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। নতুবা তারা নিজেরাও যেমন এই ভয়াবহ রহস্যজনক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন এবং তাদের অসাবধানতাজনিত অসতর্কতা থেকে আরও নতুন নতুন লোক আক্রান্ত হতে না পারে।

করোনাভাইরাস যখন একবার বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে, তখন আগের থেকে সতর্ক ও সাবধান না হলে এরোগে আরও বহু সংখ্যক লোক আক্রান্ত হতে পারে। তেমনি তাদের চিকিৎসা দিতে এসে চিকিৎসক ও নার্সরাও এ রোগে আক্রান্ত হতে পরেন। এটা যাতে না হতে পারে সে লক্ষ্যে শুধু চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নয়, সবাইকে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।
পরিশেষে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রমণ থেকে আমরা যেভাবে রক্ষা পেতে পারি তা এখন বলে এ লেখার ইতি টানছি।
(এক) করোনাভাইরাস রোগে আক্রান্ত হয়েছে, এমন সমস্ত লোককে যে কোন মূল্যে এড়িয়ে চলতে হবে।
(দুই) রাস্তা দিয়ে হাঁটাহাঁটি যথাসম্ভব বাদ দিয়ে চলতে হবে।

(তিন) মাঝে মাঝে সাবান দিয়ে হাত-মুখ প্রভৃতি অন্তত: ২০ সেকেন্ড ধরে ধুয়ে ফেলতে হবে।
(চার) শ্রমজীবী মানুষদের নিজেদের জীবিকার প্রয়োজনেই বাইরে যেতে হয়। নইলে তাদের জীবন ও জীবিকা অচল হয়ে পড়তে পারে। এদের সহায়তার জন্য সরকার এবং দেশের অপেক্ষাকৃত বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।
(পাঁচ) রাস্তা দিয়ে হাঁটা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে, একথা আগেই বলা হয়েছে। তবে যদি একান্তই কারো বাইরে যেতে হয় তাদের মুখে অবশ্য মাস্ক অথবা কোন কাপড় ব্যবহার করতে হবে।

(ছয়) যখন তখন বিনা প্রয়োজনে হাত দিয়ে নাক-মুখ-চোখ স্পর্শ করার বদঅভ্যাস বর্জন করতে হবে।
(সাত) ভালভাবে রান্না না করা খাবার বিশেষ করে মাছ-মাংস প্রভৃতি পরিহার করে চলতে হবে।
(আট) কারও জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ঠান্ডা, কাশি, হাঁচি, বমি প্রভৃতি হওয়া মাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এসব কাজের মাধ্যমে নিজেও নিরাপদ থাকতে চেষ্টা করুন। অন্যকেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করুন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন