পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ এখন এক অকল্পনীয় ভীতি ও বিভীষিকাময় সময় পার করছে। করোনাভাইরাস মহামারীতে দৃশ্যমান মৃত্যুর ভয় এক প্রকার ট্রমাটিক সিনড্রোমে রূপ নিয়েছে, যদিও করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার শতকরা ১০ ভাগের বেশি নয়। তবে এটি নিছক মৃত্যু নয়, মৃত্যুর চেয়েও যেন বেশি কিছু। অতিরিক্ত সংক্রমণের কারণে আইসোলেশনে থাকা কোভিড-১৯ রোগীরা প্রিয়জনদের সাথে শেষ কথাটা বলার, শেষ দেখাটা দেখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। এমনকি কোথাও কোথাও ধর্মীয় রীতিনীতির অনুসরণে সামাজিক প্রথায় লাশ সৎকারের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। যদিও মৃত ব্যক্তির মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ায় না বলে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। জীবিত প্রতিটি মানুষ ও প্রাণির মৃত্যু সুনিশ্চিত ও অবধারিত। দেশের জন্য, ধর্মের জন্য হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার উদাহরণও ভুরি ভুরি। সময়ের প্রয়োজনে মৃত্যুকে মহিমান্বিত করতে আমাদের কবি লিখেছেন, ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ ছাড়াও ইসলাম ধর্মে শহীদি মৃত্যুর মর্যাদা ও পারলৌকিক পুরষ্কার আরো বিস্তৃত।
সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই, এমনকি প্লেগ ও মহামারীতে মৃত্যুবরণকারীদেরও শহীদি মৃত্যুর পুরষ্কারে ভূষিত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পারলৌকিক শান্তি ও মুক্তির পথই ইসলামে মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আর শহীদ ও সৎপথ প্রাপ্ত বিদ্বানের জন্য বেহেশতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। কোনো স্থানে সংক্রামক ব্যাধির মহামারী দেখা দিলে সে স্থান ত্যাগ না করা এবং সেখানে বাইরের কাউকে প্রবেশ করতে না দেয়ার নির্দেশ রয়েছে হাদীসে। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে প্লেগ ও প্রাণঘাতী মহামারীর অনেক ইতিহাস আছে। করোনা মহামারী রোধে বিশ্বব্যাপী সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে সংক্রামক ব্যাধি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে কোয়ারেন্টাইনের ধারণা প্রথম এসেছিল প্রায় দেড় হাজার বছর আগে রাসূল মোহাম্মদ(স.)এর কাছ থেকে মহামারীতে মৃত্যুবরণ করলে শহীদ এবং বেঁচে থাকলেও অপরিমেয় সওয়াবের কথা বলা হয়েছে। আজকের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে তা’ এক পরম বিস্ময়ের ব্যাপার। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এমন আরো অসংখ্য বিস্ময়কর ব্যাপার রয়েছে, যা যুগে যুগে সত্য সন্ধানী ও বিজ্ঞানীদের বিস্মিত ও অভিভূত করেছে। মিশরের ঐতিহাসিক নিদর্শন ফেরাউনের মমি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ফরাসি চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কোরান, বাইবেল ও বিজ্ঞানের তুলনামূলক আলোচনা করে যে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তা এখনো সারাবিশ্বে বহুভাষায় অনূদিত হয়ে বহুল পঠিত গ্রন্থের তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে। মানব সৃষ্টি ও মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তন, আব্রাহামিক ধর্মসমূহ, চারটি আসমানি কিতাব এবং আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্বসৃষ্টি ও মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতার তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে মরিস বুকাইলি কোরানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। ধর্মবিশ্বাসী মানুষেরা জগতের জৌলুস, চাকচিক্য ও ভোগবাদিতার চেয়ে পরমার্থিক জগৎকেই আরাধ্য মনে করে। সত্যিকারের বিশ্বাসী মানুষ পরম স্রষ্টাকে ভয় করবে অন্য কিছুকে নয়। মৃত্যুকে তো নয়ই। মৃত্যু যেমনই হোক, মৃতের সৎকার হোক বা না হোক, পরম সত্ত্বার কাছে তা কোনো বিচার্য বিষয় নয়।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে এই মুহূর্তে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ গৃহবন্দি জীবন পার করছে। এটি একটি বৈশ্বিক দুযোর্গময় বাস্তবতা। বেশিরভাগ মানুষ স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টান বেছে নিলেও কোথাও কোথাও পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে কঠোরভাবে লকডাউন ও কার্ফিউ বলবৎ রাখতে দেখা যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর সরকার করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর মিছিল থামাতে, লক্ডাউন শিল্পকারখানার ক্ষতি, সেবা প্রতিষ্ঠান এবং গৃহবন্দি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ নিশ্চিত করতে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের উদ্ধার, প্রণোদনা ও সহায়তা তহবিলের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এরপরও অনেকের মধ্যে চরম হতাশা ভর করেছে। জামার্নীর একজন মন্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। করোনাভাইরাস মহামারীর মৃত্যু ভয়ে নিউ ইয়র্কের বহুতল ভবন থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা গেছে। ভারতে অনেক দেরিতে সংক্রমণ শুরু হলেও করোনাভাইরাস আতঙ্কে প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা নাকি ঘটেছে ভারতে। কে. বালাকৃষ্ণ নামের ৫০ বছর বয়েসী ৩ সন্তানের জনক করোনাভাইরাস আতঙ্কে আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া ইতালীয় ও বৃটিশ স্বাস্থ্য বিভাগের দুই তরুণী করোনাভাইরাস সংক্রমণে চোখের সামনে ঘটতে থাকা মৃত্যুর ঘটনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে। এমিলি ওয়েন নামের ১৯ বছরের এক বৃটিশ তরুণী অহেতুক ভীতির কারণে আত্মহত্যা করেছে বলে জানা যায়। এমিলি করোনাভাইরাসের কোনো টেস্ট করেনি এবং তার মধ্যে করোনা সংক্রমণের কোনো লক্ষণও ছিল না। ওভিডের মেটামরফসিস, আলবেয়ার কামুর দ্য প্লেগসহ অতীতের প্লেগ ও মহামারীর ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা ফিকশন ও সাহিত্য কর্মে মহামারীর সম্ভাব্য মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে বাঁচতে এমন আত্মহত্যার ঘটনা দেখা যায়। তবে কোনো ধার্মিক মুসলমান কখনো আত্মহত্যা করে না। ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ। যেখানে মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃতদের শহীদের মর্যাদা দেয়া হয়েছে, সেখানে আত্মহত্যা করে পারলৌকিক মুক্তির পথকে রুদ্ধ করার মতো বোকামি আর হতে পারে কি?
করোনাভাইরাস মহামারীর আতঙ্কে ও সরকারি নির্দেশনায় বিশ্বের কোটি কোটি গৃহবন্দি মানুষের এখন সময় কাটে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলফোন অথবা কোনো কোনো ডিজিটাল ডিভাইসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অথবা ইন্টারনেটের তথ্যরাশি ও জ্ঞানভান্ডারে নিমগ্নতায়। আজ অনেকেই এসব ডিজিটাল ডিভাইসের অন্যতম জনক বা উদ্ভাবক স্টিভ জবসের কথা ভুলে গেছেন। প্রায় ৬ বছর রোগে ভুগে ২০১১ সালে তিনি মাত্র ৫৬ বছর বয়েসে প্যানক্রিয়েটিক ক্যানসারে মারা যান। ব্যাংকে শত শত কোটি ডলারের সম্পদ ও অগাধ বিষয়-সম্পত্তি জমা রেখে তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্তিম সময়ে বুঝতে পারেন, সারাজীবন তিনি যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থসম্পদের পেছনে ছুটেছেন, তা আসলে অর্থহীন। মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষের কাছে তার কানাকড়িও মূল্য নেই। সত্যিকারের ঈমানদার ও আধ্যাত্মবাদী মুসলমানের জন্য বৈষয়িক বিষয়-সম্পদ অনেক বড় বোঝা। ভোগবাদিতা ও সম্পদের প্রাচুর্য তার আত্মাকে কলুষিত করে, তার পারলৌকিক মুক্তির পথকে দূরূহ করে তোলে, কোরান-হাদীসে এমনটাই বলা হয়েছে। জগতে মুসাফির ও রিফিউজি হয়ে মানবাত্মার মুক্তির পথ খোঁজাই হচ্ছে ধার্মিকদের মূল অভিপ্সা। পারলৌকিক মুক্তির জন্য ভোগের বস্তুরাজি, জগতের প্রত্যাশিত প্রাচুর্য, ক্ষমতা ও সম্মানের মোহকে অতিক্রম করে ধৈর্য ও সহনশীলতা ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে সেই মুক্তির পথ খুঁজে নিতে হয়। শত শত কোটি ডলারের সম্পদ স্টিভ জবসকে মরণব্যাধি থেকে রক্ষা করতে পারেনি। মৃত্যুসজ্জায় শুয়ে জীবন সম্পর্কে তার শেষ উপলদ্ধিতে শুধুই আফসোস আর অনুতাপ প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের কবলে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে যদি জীবনের সেই মরমার্থিক উপলব্ধি জাগ্রত হয়, তাহলে এই দুর্যোগ পরবর্তী বিশ্বের অর্থনৈতিক বাস্তবতা যেমনই হোক, পৃথিবী হয়তো আগের চেয়ে ভিন্ন এক মানবিক জীবনবোধে মুখর হয়ে উঠতে পারে।
করোনা মহামারীতে বিশ্বের ক্ষমতাদর্পী পরাশক্তিগুলোর অসহায়ত্ব, দুর্বলতা ও ভঙ্গুরতা স্পষ্ট হয়ে গেছে। শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তাচ্ছিল্য মনোভাব আজ সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহামারীর সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চীনের মতো একেবারে শুরুতেই সংক্রমণ স্থানগুলোকে লকডাউন করে দিতে পারলে এ অবস্থা হয়তো এড়ানো যেত। তবে করোনাভাইরাসের মহামারী রোধ ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং পরবর্তী মন্দা ঠেকাতে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের বেইলআউট বা উদ্ধার তহবিলের ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। সেই সাথে করোনাভাইরাসের ভীতির চেয়ে আগামীর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দায়, চাকরি হারানো, ব্যবসা হারানো, ঋণ ও দারিদ্র্যের কারণে অনেক মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে বলে মার্কিন প্রশাসন মনে করছে। ইতিপূর্বে ১৯৩২ সালের গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার তথ্য জানা যায়। এবারের সম্ভাব্য ডিপ্রেশন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি তীব্র ও গভীর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। গত ৬ দশক ধরে বিশ্বের সব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রযুক্তির নেতৃত্বে আসীন পুুঁজিবাদী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক করোনাভাইরাসের কাছে কত অসহায় দেখা যাচ্ছে! সে দিন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্য স্বীকার করলেন, ‘উই হ্যাভ এনাফ টু ডেস্ট্রয়, নট এনাফ টু সেইভ লাইফ’। যেখানে মারণাস্ত্রই হয়ে উঠে সভ্যতার নেতৃত্বের মূল মানদন্ড, সেখানে অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে ক্ষমতাদর্পী ও অহংকারী রাষ্ট্রনেতাদের এই অসহায়ত্ব তাদের জাতি ও পুরো মানব সমাজের জন্য অনেক বড় শিক্ষা। এখান থেকেই হয়তো আগামী দিনগুলোতে মানবসভ্যতায় প্রত্যাশিত পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটতে চলেছে।
গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সামন্তবাদী বিশ্ব আমূল বদলে যেতে শুরু করেছিল। বলকানযুদ্ধ ও প্রথম মহাযুদ্ধের ফলাফল উপনিবেশবাদ থেকে এক নতুন অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বে পরিণত করার পশ্চিমা কর্মপন্থা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। শতক বিভাজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের এই পালাবদল হাজার বছর ধরেই অব্যাহত আছে। প্রাচীন-মধ্যযুগের ধর্মযুদ্ধ একসময় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের যুদ্ধে পরিণত হয়। ১৯২০ সালে স্পেনিশ ল্ফু অনেকটা প্লেগের মতো মহামারী আকার ধারণ করে ইউরোপের প্রায় এক-চতুর্থাশ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। এই ফ্লুতে এত মানুষের মৃত্যু হয় যে, আগের শত বছরে অসংখ্য যুদ্ধেও এত লোকের মৃত্যু হয়নি। তবে লক্ষনীয় ব্যাপার এই যে, ইউরোপে প্রায় ৬ কোটি মানুষের প্রাণহরণকারী এই মহামারী পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী নীলনকশায় কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সম্পাদিত সাইকস-পাইকট চুক্তির আওতায় ইঙ্গ-ফরাসী-ইতালীয়রা মধ্যপ্রাচ্যের ভাগাভাগি এবং পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণকে নিরঙ্কুশ করতে আরেকটি মহাযুদ্ধের দামামা বাজানোর মতো ঘটনা দেখা গেল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটিই হচ্ছে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ও প্রাণঘাতী যুদ্ধ। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা ফেলে এই বোমার অকল্পনীয়, নারকীয় ধ্বংসক্ষমতার পরীক্ষা করা হয়। হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরদুটিকে মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে শহরের লাখ লাখ বাসিন্দাকে তেজষ্ক্রিয় আগুনে ঝলসে মারা হয়। আর পুঁজির পুঞ্জিভবনের পাশাপাশি বিশ্বের প্রথম এই পারমাণবিক মারণাস্ত্রের অধিকারী হওয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা পুরোনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে পেছনে ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠে নয়া সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি। এরপর ইঙ্গ-মার্কিন যোগসাজশে প্রণীত নতুন বিশ্বব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনী মুসলমানদের ভূমি দখল করে জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়। সেই থেকে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের নিরাপত্তা ও আগ্রাসী শক্তিবৃদ্ধি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম গোপন এজেন্ডা হয়ে উঠেছে। এই করোনাভাইরাস মহামারীতেও অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূ-খন্ডে ইসরাইলের নতুন বসতি স্থাপন এবং ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র মানুষ হত্যা অব্যাহত রয়েছে। এই মুহূর্তে ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে অথবা সংক্রমণের ভয়ে আইসোলেশনে রয়েছেন বলে জানা যায়। তবে সব যুদ্ধ থেমে গেলেও জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনি জনপদকে স্থায়ীভাবে জায়নবাদী ইসরাইলের দখলে দেয়ার পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির ঘোষণা দেয়া হয়েছে, করোনা মহামারীতেও সেই নীলনকশার বাস্তবায়ন চলছে।
আগামী সপ্তাহগুলোকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রাণঘাতী হিসেবে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের মানুষ এখন কোয়ারেন্টাইনে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থা পুজিবাদের রাজধানী নিউইয়র্ক এবং লন্ডনের। ইতালি, স্পেনকে ছাড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ছে মৃতের হার। অন্যদিকে গত দুইমাস ধরে শিল্পোন্নত বিশ্বের কলকারখানাগুলো বন্ধ থাকায় বাতাসে নাইট্রোজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডসহ ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি অবিশ্বাস্য হারে কমে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার, অপরাধ-হানাহানি অনেকটাই কমে গেছে। যুদ্ধের ক্ষেত্রগুলোতে রক্তপাত আগের মতো নেই। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও জাতিসমূহের যুদ্ধবাজ নেতাদের প্রতি সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও যুদ্ধের কালো ধোঁয়া এখন অনেকটাই স্তিমিত রয়েছে। অবস্থা যেমনই হোক, এই মুহূর্তে সিরিয়া, লিবিয়া বা ইয়েমেনের মতো রক্তাক্ত জনপদের চেয়ে বৃটেন, আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনের সুরম্য জনপদের নাগরিকরা বেশি দুর্বিষহ জীবন পার করছে। তারা প্রতিদিনই স্বজন হারাচ্ছে। প্রতিটি নাগরিক মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে নিজ নিজ ঘরে কোয়ারেন্টাইনে আবদ্ধ আছে। প্রাদুর্ভাবের মাত্রা ভিন্ন হলেও বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষের মধ্যে ঝেঁকে বসা মৃত্যুভীতি সব মানুষকে একই অভিজ্ঞতার সমান্তরাল পৃষ্ঠে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের মহামারী বিশ্বের মানুষকে এক বিশ্বজনীন সাম্য ও অনন্য পরমার্থিক অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির কেন্দ্রে দাঁড় করিয়েছে। এই বিশ্ববাস্তবতা আগামীতে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই দুর্যোগে আমাদের মানবিক সত্ত্বা আরো জাগরিত হোক, কর্মহীন অসহায় মানুষের সাথে খাদ্য ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো ভাগাভাগি করার মধ্য দিয়ে এবং মহাপরাক্রমশালী সত্ত্বার কাছে আত্মসমর্পণের শক্তি আমাদের ভয়কে তুচ্ছ করে দেবে। যিনি শুধুমাত্র আল্লাহকে ভয় করেন, জগতের অন্য কোনো কিছুর ভয় তাকে ভীত করতে পারে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।