Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

করোনায় মরবেন না, প্রয়োজন

আরাফাতবিন আবু তাহের | প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০৩ এএম

১. এক অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে বিপর্যস্ত পুরো পৃথিবী। এক আশ্চর্যজনক স্থবিরতার ভেতরে সবাই- সব দেশ সব জাতি কাঁপছে। বিস্মিত বিমূঢ় হয়ে আছে প্রত্যেক প্রান্ত। এমন একটা অচলাবস্থার দিনে, একটা হতবিহ্বল মুহূর্তে পৃথিবীর সবকটা রং রূপ এক হয়ে গেছে। এ পৃথিবী বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে দিনকে দিন। দেশের পর দেশ লকড ডাউন হয়ে আছে। আর কয়শ বছর আগে এমন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একজন মানুষ আরেকজনের দিকে তাকাত?! সেই কয়শ বছর আগে পুরো বিশ্বে একসাথে মহামারি লেগে গিয়েছিল? এবার ঘরের পরে ঘর পুড়ছে অদৃশ্য আগুনে। নিজের দেহই করছে নিজের সাথে বিদ্রোহ। কিন্তু এটা সবে মাত্র শুরু। ইতিহাসের শিক্ষা থেকে কয়েকটা বুলি আওড়ালে বলা যায়- এ মহামারী বিশ্বব্যাপী মহাদুর্ভিক্ষ নিয়ে আসছে। আর কয় দিন পরে দেখা যাবে দিনমজুর কাজ পাচ্ছে না। রিকশাওয়ালার যাত্রী নেই, মাটিয়ালকে ডাকছে না সর্দার, দোকানী বেচাবিক্রির জন্য পণ্য পাচ্ছে না, হাসপাতাল ডাক্তার শূন্য, নগর থেকে নগরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ। পিতা পুত্রের দেহ ছোঁবে না, পুত্র পিতার, মা মেয়ের, মেয়ে মায়ের, স্বামী স্ত্রীর। এ এক আশ্চর্য দৃশ্যের অবতারণা৷ এ এক অন্য পৃথিবী। এর রূপ চেনা যায় না।
২. গৃহবন্দী হয়ে আছি। দেখা করার জন্য কয়েকজন বন্ধু এলো। আমি তাদেরকে বসতে দিলাম না। প্রত্যেককে ছ›ফুট দূরে দূরে দাঁড় করালাম। এরপর কৈফিয়ত তলব করলাম, তোদের মাস্ক কই?
একেকজনের একেক ওজর আপত্তি। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে বললাম, সবাই একত্রে বাইকে করে কেন? এ গণ জমায়েতের কী কারণ? আমি কি নতুন দুলা? সবার মুখ হাঁ হয়ে আছে।
পরক্ষণে একটু স্বাভাবিক হলাম। বুঝিয়ে বলতে হয়নি। সবাই বুঝদার লোক। কথা দিলাম কথা নিলাম সপ্তাহখানেক পরে সবাই বেঁচেবর্তে থাকলে আড্ডা হবে মাস্তি হবে। এখনকার মত বিদায়। পরে আস্তে করে কেটে পড়েছে সবাই।
৩. চিন্তা করি দিন মজুর, রিকশা-ভ্যান চালক, ঠেলাগাড়ি চালক, কুলি-মুটেদের কথা। ফুটপাতের দোকানি, চাগরম চাগরম মামাদের মত অসহায় লোকদের কথা। ছিন্নমূল অসহায় লোকদের কী অবস্থা? তাদের হাঁড়িতে কি ভাত ফুটছে? উনুনে কি আগুনের লেলিহান শিখা কাঁপছে, না দরিদ্রের চুলায় বিলাই ঘুমাচ্ছে, আর ভুখা-নাঙা পেটে আগুনের লেলিহান শিখা বিদ্রোহের মত ছড়িয়ে যাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে, অসহায়দের করুণ ক্ষরণের কথা মনের ভেতর পাক খেয়ে উজিয়ে উঠতেই বাসা ছেড়ে বের হলাম৷ উজান বাতাসটা ঠেলে সর্বোচ্চ আমি পুকুর পাড় পর্যন্ত যেতাম হয়ত। কিন্তু পাতলা পদবিক্ষেপ আরেকটু ধীর করে দাঁড়াতে হল। মুশির মা এলেন। বিচ্ছেদ বিচ্ছিন্নতার ফাঁড়ার গলায় পা দিয়ে বাড়ির বার তিনি। পেট গিয়ে পিঠে ঠেকেছে। ‹খালা কেমন আছেন› বাক্যটার সবকটা শব্দ সময়মত খুঁজে পেলাম না। বৃদ্ধ কৃশকায় মুশির বাপ। কৃশকায় হোক বৃদ্ধ হোক তাকে জীবিকার সন্ধান করতে হয়৷ আজ কদিন দোকান খুলছেন না। ঘরের বার হওয়ার কায়দা নাই। এর আগের দিন দেখা করলেন (অবশ্যই দূরত্বে থেকে) মনসুরার মা। এ মহিলা রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি করতেন। আজ ক›দিন সে দিকে মুখ দেওয়ার জো নাই। তারও নুন আনতে পানতা ফুরিয়েছে। খালি মুখে ঘরে উঠানে কিলবিল করছে তিনটা মানবছানা। তিনি অভাব অনুযোগের কথা তেমন একটা উচ্চারণ করেননি। শুধু জিগ্যেস করলেন, এরুম আর কয়দিন চলব বাবা?!
কণ্ঠটা করুণ ভীষণ। আমি চমকে উঠলাম।
তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আরবজাহানের৷ এ মহিলাকেও খালা ডাকি। গলা দিয়ে যথারীতি চিঁহি চিঁহি শব্দে দুটা কর্মঠ আলাদা আলাদা সংসারি ছেলেকে অভিসম্পাত দিতে দিতে অভিযোগ করলেন, আজ ছ'মাস। এক পোয়া চাল না এক ছটাক ডাল না। দুটা পোলার একটাও খবর লয় না মার ঘরে রান্না হইছেনি?
৪. আমরা আশায় বুক বেঁধে থাকা জাতি। আমরা টানেলের শেষবিন্দু থেকেও আলোর দেখা কোন না কোন উপায়ে পেয়েই যাই। জানি যে করোনাকে ‹জয়› করাটা এখনও সুদূরপরাহত ব্যাপার। কিন্তু আমাদেরকে অন্য বিষয়াদিও ভাবতে হচ্ছে এরইমধ্যে। ইতিহাস বলে, লকড্ ডাউনে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে দিন এনে দিন খাওয়া লোকেরা। এ ক্ষেত্রে তাদের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। না পারে বলতে না পারে সইতে। পেটে সয় না পিঠেও সয় না, তবুও চুপচাপ উপবাসব্রত চালিয়ে যাওয়াই তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। তবে জানতাম, মানুষের এ চরমতম দুর্যোগ দুর্ভোগের সময়ে সাধ্যের মধ্যে সামর্থ্যবানরা এগিয়ে আসবেনই। অন্তত একদিক দিয়ে তো আশার আলো দেখতে শুরু করেছি ইতোমধ্যেই৷ শহরে বন্দরে পাড়ায় মহল্লায় জনহিতৈষীরা, সমাজসেবী সংগঠনগুলো, জনপ্রতিনিধিরা ও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য সহযোগিতা শুরু করে দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। এটা মানবিকতা প্রকাশের সুন্দরতম দিক, চূড়ান্ততম পর্যায়। এভাবে সাহায্য চলতে থাকলে অন্তত দুর্ভিক্ষটা শুরু হতে পারবে না সহজে। মুখ থুবড়ে পড়বে না মানবতা। সাময়িক দুর্যোগ দুর্ভোগকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে আরো কিছু দিন। তবে এ সাহায্যসামগ্রী বিলি বন্টনের কায়দা কানুন দেখে অতীব দুঃখের এবং দুশ্চিন্তার একটা বিষয় গোচরে চলে এসেছে আজকে। সাহায্যসামগ্রী হাতে হাতে পৌঁছাতে গিয়ে একটু বেখাপ্পা কাজও হচ্ছে কিনা আবার! খেয়াল করলাম, একটা ভালোর জন্য আরেকটা মন্দকে টেনে আনা হচ্ছে হাতে ধরে।
যেটা উচিত হচ্ছে না মোটেও সেটা হল, অনেকে সাহায্যের সামগ্রী বিলি করতে গিয়ে লোকজনকে ডেকে জড়ো করছেন। দলাদলি ডলাডলি মিছিল মিটিং শুরু করে দিয়েছেন প্রায়। এরকম ঠেলাঠেলি ভিড়াভিড়িতে মানুষ কি করোনারই মরন দশা উপস্থিত হওয়ার জোগাড়।
কথা হচ্ছে, না, এটা করা যাবে না, মোটেই ঠিক হচ্ছে না ব্যাপারটা। তাই মানবিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারীদেরকে বিনীতভাবে বলছি, ত্রাণসামগ্রী কষ্ট করে হলেও যার যার বাসায় পৌঁছে দিন। তালিকা তৈরি করে বাসায় বাসায় যথাযথ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থেকে কাজটি সংক্ষেপে সারুন।
লোক জমায়েত করবেন না। এটা কোয়ারেন্টিনের উদ্দেশ্যকে ভেঙে ফেলছে, ভাইরাস ছড়ানোর চেইন তৈরি করছে স্থূলভাবে, সুস্থকে অসুস্থ করে তুলছে দিবালোকের ন্যায়।
আর খেয়াল রাখতে হবে যাদেরকে সাহায্য করছেন তারা ভিক্ষুক না, চামার-ছোটলোকও না। লকড্ ডাউনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তারা সাময়িক বেকারত্বের খাঁড়ায় পড়েছেন শুধু। অতএব ত্রাণসামগ্রী বিতরনের সময় আচরণে এবং হুটহাট ছবি সমেত ফেবু পোস্টের ব্যাপারে বেড়ায়া মনোভাব দেখালে চলবে না একেবারেই। খুব খেয়াল।
৫. কোন ধরনের উস্কানিমূলক বা হতাশাজনক কথায় প্রভাবিত না হয়ে সাবধানে থাকুন। কঠিন পরিস্থিতি শুরু হওয়ার সপ্তাহে আছি আমরা। এখনই এটা তার ভয়ালরূপ নিয়ে হাজির হওয়ার সময়ে পড়েছে। ইতালি স্পেন আমেরিকায় মৃত্যুর মিছিলটা এ ঝিমিয়ে পড়া সময়টাকে গুরুত্ব না দেয়ার খেসারত মূলত। সর্বত্র সতর্কতা নিশ্চিত করা না গেলে দানে দানে তিন দান হিসাবে আমাদের মত গরীব দেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে যাবে। উন্নত দেশে এখন হাসপাতালে সিট নাই। ডাক্তারেরা নিজেরাই শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন এবং আক্রান্ত। আমরা তো হাসপাতালও দেখব না থাক সেবা আর সিট। আইসিইউ তো আকাশকুসুম ব্যাপার। তাছাড়া আমাদের টেস্টকীটের অভাব। আপনি আক্রান্ত হলেই যে রোগ শনাক্ত করতে পারবেন তার কি গ্যারান্টি আছে? দৌড়ে পালাবে হাসপাতাল সমতে ডাক্তার নার্সরা।
৭. ছোট কিন্তু সুন্দর একটা পরামর্শ দিই।
হাম কোয়ারেন্টিনে তো অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, যা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারছি। সকালটা দুপুর হয় না, দুপুরটা যেন হয় না বিকাল। সন্ধ্যা হলে পরে রাতের দশটা বাজতে মনে হয় ঘড়ির কাঁটায় ঠাটা পড়ে আছে। ঠ্যালাব্যাটা ঠেলেও সে টিকটক কাঁটাটিকে আর উপরের দিকে সরাতে পারছে না। এটা সবচে খারাপে গিয়ে ঠেকেছে আড্ডাবাজ ও সরেস আলোচকদের। যারা একবসায় দশটা চা গিলেন, আলোচনার টেবিলে হাঁড়ি থেকে নাড়িনক্ষত্রের খবর বের করে ফেলেন পেট টিপে, আয়োজন করে গল্পগুজব না করলে পেটের ভাত হজম হয় না, তাদের তো প্রায় আধমরা অবস্থা।
আবার এরই বিপরীতে আছে অন্য ব্যস্তসম্প্রদায়ও, যারা কাজের জন্য, অর্থ বিত্তের মোহে দিন-রাত পরিশ্রম ও সময় স্বল্পতার কারণে পুরোনো বন্ধু-বান্ধবের খবর নিতে পারেন না মোটেও।
এবার এই বিচিত্র ধরনীর সব ধরনের বিপদগ্রস্ত সম্প্রদায়কে, এহেন দুর্ভোগের ও দুর্বিষহ লকডাউনের থেকে উদ্ধারের নিমিত্তে আয়োজন করে এই রেসিপিটা দিচ্ছি-
এখনকার এই অলস অবসরে বসে বসে অনলাইনে-নেটে প্রিয়জনকে অডিও/ভিডিও কল করে সময় কাটাতে পারেন।›
নানান খুনসুটি থেকে শুরু করে একবন্ধু আরেকবন্ধুকে টক-ঝাল-মিষ্টি কথার প্যাঁচে কপোকাত করে আধমরা করে ফেলতে পারেন, পেটের ভাত টিপে আঁত লুজ করে দিতে পারেন হাসাতে হাসাতে।
আর বইয়ের কথা কত বলব! বই পড়ুন। অবসরে এই তো সুযোগ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন