Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনাভাইরাস এবং বিষমুক্ত বাতাস ও স¦চ্ছ আকাশ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনাভাইরাসের চলমান মহামারী ভৌগোলিক সীমারেখা ও ধনী-গরিবের ব্যবধান ঘুঁচিয়ে দিয়ে পুরো বিশ্বকে একই সমতলে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একচেটিয়া অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুবিধার্থে ধনী দেশগুলোর পক্ষ থেকে এতদিন প্রযুক্তি ও পুঁজির বিশ্বায়নের কথা বলা হলেও আদতে বিভাজনের বিষবৃক্ষ রোপণ করে নিজেদের ইচ্ছেমত তা বড় করে নিয়ন্ত্রণ করার কপটাচারকে তারা কখনোই ঢেকে রাখতে পারেনি। শতকরা একভাগ মানুষের হাতে বিশ্বের সব সম্পদের ৮০ ভাগ রাখার সেই নীল নকশা ভাঙ্গার কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়নি। সফল হওয়া অনেক দূরের ব্যাপার। ধরিত্রির জঠরে লাখ লাখ বছরে সঞ্চিত জীবাশ্ম জ্বালানি, সম্পদরাজি এবং হাজার হাজার বছরের ধারাবাহিক ঔৎকর্ষে এগিয়ে চলা মানব সভ্যতা গুটিকতেক ঠগ-লুণ্ঠনবাজের হাতে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে চলেছে। ওরা নিজেরা যেমন পুঁজির দাসত্ব বরণ করেছে, একইভাবে পুরো বিশ্বের সব মানুষকে পুঁজি ও সম্পদ লুণ্ঠনের প্রতিযোগিতায় শামিল করতে মুক্তবাজার অর্থনীতির টোপ হাজির করেছিল। যদিও এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা প্রথম রাউন্ডেই এশিয়ার উন্নয়নশীলদের কাছে মার খেয়ে একচেটিয়া বাজারের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ের পর ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি নয়া বিশ্বব্যবস্থার যে রোডম্যাপ অনুসরণ করছে বাণিজ্য, জ্বালানি ও যুদ্ধপ্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ ও অপপ্রয়োগই তার মূল কৌশল। পুঁজিবাদের বিশ্বায়নের পথ ধরে উদ্ভাবনী সক্ষমতা, উৎপাদন ও বাণিজ্য কৌশল এবং সামরিক প্রযুক্তিরও বিশ্বায়ন ঘটে গেছে। সা¤্রাজ্যবাদী অহমিকায় নিরাপত্তাহীনতা ঢাকতে তারা ফসিল জ্বালানির উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং জ্বালানির অপরিণামদর্শী ব্যবহার এবং দেশে দেশে রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছে।

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে গণচীনের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়ার মধ্যদিয়ে গত শতকের শেষার্ধে নতুন বিশ্ববাস্তবতার সূচনা হয়। পশ্চিমাদের নির্ধারিত অর্থনৈতিক মানদন্ডে চীন এখনো উন্নয়নশীল অর্থনীতির কাতারে অবস্থান করলেও পশ্চিমা মানদন্ডে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় নেমে বিশ্বব্যবস্থার উপর প্রভাব সুদৃঢ় করতে সম্ভাব্য সবকিছুই করছে। জ্বালানিসহ গতানুগতিক অর্থনৈতিক উপযোগগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব অর্জনে চীন পশ্চিমাদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এভাবেই আজকের শিল্পোন্নত চীন বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, পরিবেশগত জীবপ্রকৃতির শৃঙ্খলা বিনষ্টের অন্যতম অংশীদারিত্বে শামিল হয়েছে। গত তিন দশক ধরে বিশ্বের পরিবেশবাদীরা এই নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করলেও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বিশ্বশক্তিগুলোর বেপরোয়া আচরণে অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটে চলেছে। গত বছর হঠাৎ করে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের আকাশ-বাতাস বিবর্ণ ও দূষিত হওয়ার খবর বেশ উদ্বেগের জন্ম দেয়। দিনের বেলা সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। বাতাসে ধূলি ও বিষাক্ত গ্যাসের দুঃসহ উপস্থিতিতে মানুষের শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। বেইজিং-দিল্লির মতো শহরে গাড়ি চালনার উপর সাময়িক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কর্তৃপক্ষ। অক্সিজেন মাস্কের উৎপাদন ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি চীনের বড় বড় শহরে অক্সিজেন বার খুলে নতুন ব্যবসার বিস্তার ঘটায়। একেকটি মেগাসিটির কোটি কোটি মানুষকে গ্যাস চেম্বারে ঠেলে দেয়া এবং সার্স ও করোনাভাইরাসের উপসর্গ হঠাৎ করে এমনি এমনি দেখা দেয়নি। এর জন্য দশকের পর দশক ধরে রাষ্ট্রনেতাদের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত এবং অমানবিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার দায় সবচেয়ে বেশি।

গত ডিসেম্বরে চীনে করোনাভাইরাসের মহামারী শুরু হলে এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা এই ভাইরাস সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ভাইরাসকে চীনা ভাইরাস বলে উপহাস ও দোষারোপের পাশাপাশি চীনের লকডাউনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের কথাও ব্যক্ত করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরও তিনি একে ভাওতা বলে উড়িয়ে দেন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তর্জাতিক ইনিশিয়েটিভকেও তিনি ভাওতা বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোশেস করেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। গত সোমবার পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দেড়লক্ষাধিক এবং মৃতের সংখ্যা ছিল তিন হাজারের বেশি। মার্কিন সংক্রামক রোগতত্ত¡ বিশেষজ্ঞ এন্থনি ফোসি করোনাভাইরাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক কোটি লোকের সংক্রমণ এবং এবং অন্তত দুই লাখ লোকের মৃত্যুর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। চীনে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দুই অংকে পৌঁছানোর আগেই চীনা সরকার উহানসহ চীনের বড় বড় শহরকে লকডাউন ও শাটডাউন করে দেয়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্রæত কোভিড-১৯ ভারাইস ছড়িয়ে পড়ার মধ্যেও এর ভয়াবহতা বুঝতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অনেক প্রলম্বিত লকডাউনের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। এমনিতেই দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই লকডাউনের মধ্য দিয়ে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়তে চলেছে। শাটডাউনে বেকার হওয়া মার্কিনীরা ব্যাপকহারে বেকারভাতার জন্য আবেদন করছে। গত দশকে অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে বেকারভাতার জন্য আবেদনকারীর সংখ্যা বিশ লাখের কম হলেও গত একমাসে সে সংখ্যা তেত্রিশ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মার্কিন কংগ্রেস এরই মধ্যে দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেইলআউট বিল পাস করেছে, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

চীনে নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং হান্তা নামের নতুন প্রজাতির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওদিকে চীনের পর পরই ইতালির করোনাভাইরাস মহামারীতে প্রতিদিন শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটছে। একই অবস্থা স্পেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। পাশাপাশি গ্রেট বৃটেনেও করোনা মহামারীতে লক্ষ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বৃটিশ রাণী, প্রিন্স চার্লস, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে রয়েছেন। এর আগেই জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা ম্যার্কেলসহ ইউরোপের অনেক নেতা করোনাভাইরাসের আশঙ্কায় কোয়ারেন্টাইনে অবস্থান করেছেন। এমনকি রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন মস্কোতে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বকে নিশ্চল ও স্থবির করে দিয়েছে। বিগত দুইটি মহাযুদ্ধসহ বিশ্ব ইতিহাসে আর কখনোই পুরো পৃথিবীর মানুষ এমন লকডাউনের মুখে পড়েনি। মানুষের বল্গাহীন ভোগবাদিতা এবং বায়ু, পানি ও পরিবেশের অপরিণামদর্শী দূষণে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার জীবপ্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বাস্তবতায় করোনাভাইরাস যেন দূষণের বিরুদ্ধে একটি প্রাকৃতিক পদক্ষেপ হয়ে দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাসে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনা যেমন বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে, একই সময়ে বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে গত কয়েক সপ্তাহের শাটডাউন, লকডাউনে বায়ুদূষণ অভাবনীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বায়ুদূষণ, বিশ্বের উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমিয়ে আনতে গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বনেতাদের মধ্যে এক ধরনের বেøইমগেম ও দায়সারা মনোভাব দেখা যাচ্ছে। যে সব শিল্পোন্নত দেশের কারণে বিশ্বে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তারা একদিকে দায় এড়িয়ে ক্লাইমেট মিটিগেশন তহবিলে চাঁদা দিতে প্রকারান্তরে অস্বীকার করেছে, অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি ও ইন্ডাসট্রিয়াল পলিউশন কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়নি। এমনকি নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিও তাদের তেমন কোনো মনোযোগ নেই। উপরন্ত মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে ওয়ার থিয়েটারের রক্তাক্ত বর্বরতা অব্যাহত রাখা হচ্ছে। গত দুই দশক ধরে চলমান ওয়ার অন টেররিজমে মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত বিশ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং কোটি কোটি মানুষ বাস্তহীন হয়ে পড়েছে। আরো কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে গিয়ে অমানবিক জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে বিশ্বের বায়ুমন্ডলের যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তার সামগ্রিক অর্থনৈতিক ক্ষতি নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভব। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এ হিসেবে বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি মাসে প্রায় ৬ লাখ মানুষ মৃত্যু বরণ করছে। করোনাভাইরাসে গত তিন মাসে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৬ লাখ। অর্থাৎ বায়ুদূষণের কারণে প্রতিমাসে যত মানুষ মৃত্যুবরণ করে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক কম। তবে বৃটিশ রাজপরিবার, ডোনাল্ড ট্রাম্প, বরিস জনসন বা জার্মানির এঙ্গেলা ম্যার্কেলের মতো নেতাদের বায়ুদূষণের উপসর্গ স্পর্শ করতে না পারলেও এবার করোনাভাইরাসের ভীতি ও উপসর্গ তাদেরকেও পরাস্ত করেছে। জায়নবাদী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রায় সব উদ্যোগ ও মতামত উপেক্ষা করে মধ্যপ্রাচ্যে দখলদারিত্ব, হত্যাকান্ড অব্যাহত রেখেছেন, সেই তাকেও করোনাভাইরাস কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছে।

করোনাভাইরাসে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুতে তাবৎ দুনিয়ার মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেও করোনার প্রার্দুভাব বিশ্বের জন্য বড় ধরনের শিক্ষা ও স্বস্তির উপলক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এই উপলব্ধিতে উপনীত হতে বাধ্য করেছে যে, বিশ্বের মানুষকে ধ্বংস করতে তাদের হাতে অঢেল সমরাস্ত্রের মজুদ থাকলেও একটি অজ্ঞাত ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় তাদের হাতে যথেষ্ট উপকরণ ও সামর্থ্য নেই। যে দেশ বিশ্বের সব প্রান্তে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে লাখ লাখ সৈন্যের হাতে শত শত বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে বিশ্বকে তটস্থ করে তুলছে, সে দেশের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জরুরি প্রয়োজনের সময় মাস্ক, হ্যান্ডগেøাভস, সেনিটাইজার ও পিপিই না পাওয়ার প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে। উদ্ধত ট্রাম্প প্রথমে করোনাভাইরাসকে ভাওতা বললেও এখন দীর্ঘ মেয়াদী লকডাউনের নির্দেশ দিচ্ছেন। লক্ষাধিক আমেরিকানের মৃত্যুর আশঙ্কা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে চিকিৎসা সরঞ্জাম সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন। তবে এই বৈশ্বিক দুর্যোগের সময়েও তিনি তার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অমানবিক অ্যাকশন অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত মার্কিন সাংবাদিক-গবেষক এলান ম্যাকলেয়ডের লেখা একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘উইথ অ্যা কোয়ার্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড পপুলেশন আন্ডার ইউএস স্যাঙ্কশনস, কান্ট্রিজ আপিল টু ইউএন ইন্টারভেনশন।’ চীন, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া এবং সিরিয়ার মতো দেশ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শিকার। মার্কিন ও পশ্চিমা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা না থাকলে করোনাভাইরাস সংক্রমণে ইরানে এত মৃত্যুর ঘটনা হয়তো ঘটত না। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বা বর্বর অবরোধের কারণে ইউরোপের দেশগুলো থেকে জরুরি ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সংগ্রহ করতে পারছে না ইরান। করোনাভাইরাস নিঃসন্দেহে বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক দুর্যোগ। এ সময়ে উপদ্রুত দেশসমূহের উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা স্থগিত রাখার যৌক্তিক মানবিক দাবিকেও গ্রাহ্য করছে না ট্রাম্পের বশংবদ পশ্চিমা নেতারা। এহেন বাস্তবতায় চীন-রাশিয়াসহ ৮টি দেশের নেতারা পশ্চিমা দেশগুলোর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। করোনাভাইরাসের বিশ্ববাস্তবতায় জি-২০ খ্যাত বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর নেতারা গত ২৭ মার্চ অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সামিটে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন দেশগুলোর উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মোরাটোরিয়াম দাবি করলেও এমন একটা মানবিক দাবিতে বিশ্বনেতারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি।

করোনাভাইরাসের কারণে শাটডাউন, লকডাউন, বেইলআউট প্রোগ্রামসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশ্বনেতারা। সন্দেহ নেই, এটি অনেক বড় অঙ্ক। অর্থের এই হিসেবের মূল উৎস নিঃসন্দেহে মানুষ। মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অন্ত্র বাণিজ্য, ওয়ার অন টেররিজমের অন্তহীন যুদ্ধ, দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ ও রক্তাক্ত ওয়ার থিয়েটারে হাজার হাজার টন বোমা ফেলে যে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে এবং অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে সৃষ্ট বায়ু ও পরিবেশ দূষণে বছরে ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু এবং কোটি কোটি মানুষের অসুস্থতার মূল্য এবং শত শত কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ বিশ্বের মূল্য নিশ্চয়ই ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অনেক অনেক বেশি। তবে কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর গত কয়েক সপ্তাহের শাটডাউন, লকডাউনের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানা, কোটি কোটি মোটরযান, এরোপ্লেনের হাজার হাজার ফ্লাইট বাতিল হওয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি একটি অপ্রত্যাশিত ইতিবাচক বার্তা বিশ্বের সামনে ফুটে উঠেছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (এসা) এবং আমেরিকান ন্যাশনাল অরোনটিড এন্ড স্পেস এডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)’র সেটেলাইট ছবির বিশ্লেষণে জানা যায়, কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর শিল্পোন্নত বিশ্বের অপরিচ্ছন্ন, দূষিত আকাশ অনেকটাই পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসে শত শত কোটি মানুষ ঘরবন্দি হওয়ার আগে কেউ কখনো এভাবে সবকিছু বন্ধ করে বাতাসের দূষণ নিয়ন্ত্রণের কথা কেউ ভাবেনি। কিছুদিন আগেও বাতাসের বিষাক্ত কার্বনসহ নানাবিধ ধুলিকণা ও সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মির ক্ষতি কমিয়ে আনতে বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার কোটি বৃক্ষ রোপণের কথা বলা হয়েছে।

কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে দেশে দেশে ঘোষিত কারফিউ এবং মানুষের চলাচল ও উৎপাদন ব্যবস্থা সীমিত হওয়ার কারণে মাত্র এক-দেড়মাসেই ইউরোপ-আমেরিকার আকাশ-বাতাস শত বছরের আগের অবস্থায় চলে গেছে। বছরের পর বছর ধরে ঘটা করে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে কাবর্ন নিঃসরনের মাত্রা কয়েক শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা যেখানে দুই দশকেও অর্জিত হয়নি, সেখানে করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সব প্রতিযোগিতা ভুলে গিয়ে মৃত্যুর ভয়ে ঘরে লুকানো মানুষ দেখল এই ভাইরাস পৃথিবীর আকাশ, বাতাস ও পরিবেশের দূষণ নিরাময়ে ভলান্টিয়ারের কাজ করছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা হলেও এই পৃথিবী শুধু মানুষের নয়, সমগ্র মাখলুকাতের। মানুষের অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে পৃথিবী তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। বাতাস, পানি, মাটি, আকাশ, জীবনচক্র ও খাদ্য শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। প্রকৃতি এখন মানুষের উপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। সম্ভবত এ কারণে কোভিড-১৯ এর প্রথম আঘাতটি এসেছে বিশ্বের শিল্পোন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর উপর। তবে এই ভাঙ্গা-গড়ার খেলা কোথায় গিয়ে থামবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এখনই সম্ভব নয়। বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা চিন্তা করে চীনের মতো পুরোদেশ শাটডাউন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে যারা ব্যর্থ হয়েছে তাদেরকেই বেশি মাশুল গুনতে হচ্ছে। কোনো কোনো উন্নয়নশীল দেশের নেতা এখনো অসংখ্য মানুষের জীবনের চেয়ে তথাকথিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা সচল রাখার কথাই ভাবছেন। শাটডাউন করে কোভিড-১৯ ভাইরাস মোকাবিলার প্রশ্নে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসেনারো এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন।
[email protected]

 

 

 

 



 

Show all comments
  • jack ali ১ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৪৭ এএম says : 0
    Life in this world is like a dew drop, when morning sun shine it's just wither away.. Our life in this world is so brief if we fail to breath, we die. What is our basic need in order to live in this brief life?? Shelter/food/education/medical care/life security/pollution free environment/brother hood with mutual respect ... But what are we doing '' we become the slave of consumerism as such we have destroyed the whole world.. now those who have nuclear bombs, they cannot fight this microscopic virus call corona virus... How help less we are.. still there is time to wake up from the slumber and unite under one umbrella of humanity and cut all sort of consumerism and stop producing military hardware so that there will be no poor people in the world as a result we will be able to live in peace with human dignity.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন