Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনাভাইরাসে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে উত্তরণের উপায়

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

করোনা ভাইরাসে বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটা থমকে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে সবধরনের স্বাভাবিক কার্যক্রম। আক্রান্ত দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। স্তব্ধ হয়ে গেছে সকল আনন্দ, ক্ষমতার দাপট, শক্তিধর রাষ্ট্রনায়কদের হুঙ্কার। নীরব হয়ে গেছে একেকটি শহর, রাজপথ। ঘোষণা করা হচ্ছে জরুরী অবস্থা। লকডাউন করা হয়েছে বিভিন্ন শহর ও অঞ্চল। নীরব হয়ে পড়েছে রাতদিন সরগরম থাকা বিশ্বের অনেক শহর, নগর, পর্যটন কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট বাজার ও শপিংমল। চীনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ হুবাইর রাজধানী উহান থেকে করোনা ভাইরাস নভেম্বর-২০১৯ এ মানুষের মাঝে সংক্রমিত হয়। সারস ভাইরাস ৩৮৪ বার পরিবর্তিত হয়ে করোনা নভেল রোগ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগকে কোভিড-১৯ নামকরণ করে গত ১১ ফেব্রুয়ারি এবং কোভিড-১৯ কে মহামারী হিসাবে আখ্যায়িত করে ১১ মার্চ। এ অন্যান্য ভাইরাস থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। ভাইরাসটি অতি দ্রুত মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। এটি ভয়ানক ছোঁয়াচে। একদেশ থেকে অন্যদেশে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো প্রবাসী নাগরিকদের দেশে প্রত্যাবর্তন, বিভিন্ন ভ্রমণ, পর্যটন কেন্দ্রে আগমন, ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে স্থানান্তর। এর উপসর্গ জ¦র, কাশি, হাঁচি, মাংসপেশির ব্যথা, গলাব্যাথা, যা ২-১৪ দিনের মধ্যে ফুসফুসে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ পর্যন্ত বিশে^র ১৯৪টি দেশ ও অঞ্চলে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা বেড়ে দিড়িয়েছে, ১৯ হাজারের বেশি। আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। ক্রমান্বয়ে আরও দেশ ও অঞ্চলে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে এবং মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলছে। চীনের পর করোনার ভয়াবহতা দেখা গিয়েছে ইতালিতে। বাংলাদেশেও দিন দিন করোনা ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ৩০ মার্চ পর্যন্ত ৫ জন মারা গেছে। ৪৯ জনের আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে।

করোনার এ ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এবং পরিস্থিতি প্রতিদিন পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার যে সুর উঠেছে তার প্রভাব আমাদেরও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটাবে। এ ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন খাত ও ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোসহ বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশগুলোর উৎপাদন খাত এখন পুরোপুরি ধরাশায়ী। ভেঙ্গে পড়েছে পুঁজি, মুদ্রা ও পণ্য বাজার। এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিভিন্নভাবে অনুভূত হবে। বিশেষ করে চীনের উপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্ভরশীলতা রয়েছে। চীন বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানি কারক দেশ। বিশ্ববাণিজ্যে চীনের অংশ প্রায় ১৩ শতাংশ। দেশটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক ও বটে। মোট বৈশ্বিক-আমদানির ১১ শতাংশ হয় চীনের মাধ্যমে। চীনের উপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরতা অনেক। চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ১৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়েছে চীনের সাথে। বাংলাদেশের আমদানির বৃহত্তম ক্ষেত্র চীন। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত তার কাঁচা মালের জন্য চীনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। চামড়া জাত পণ্য ও ঔষধ উৎপাদনের জন্যও চীন থেকে বাংলাদেশ কাঁচামাল আমদানি করে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি তা অধিকাংশেই চীনা বিনিয়োগের করণেই বেড়েছে। বাংলাদেশে বর্তমান চলমান অধিকাংশ প্রকল্প চীনা বিনিয়োগে চলছে। চীনা নির্মান প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত। কোভিড-১৯ এর কারণে এগুলোর কার্যক্রম মন্থর হয়ে পড়েছে। অনেক চীনা শ্রমিক দেশে আটকা পড়েছে। ফলে প্রকল্পগুলো সময়মত শেষ নাও হতে পারে, তাছাড়া ব্যয় বৃদ্ধি হতে পারে। ফলে ঋণের বোঝা আরও বাড়তে পারে। করোনা ভাইরাসের বিস্তারের প্রভাবে ইতিমধ্যে পণ্য আমদানি কমে গেছে। রপ্তানিতেও ধাক্কা লাগছে। কাঁচামাল সংকটে পড়েছে শিল্প কারখানা। সংকুচিত হচ্ছে উৎপদন। বর্তমানে চীনের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোতে করোনার ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করছে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে এর প্রভাব পড়েছে। পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের সুরক্ষাও এখন বড় চিন্তার বিষয়। ক্রেতারা তাদের অর্ডারের আলোকে আমাদের কারখানাগুলোতে তৈরি পোশাক পন্য শিপমেন্ট করতে না করছে। বস্ত্র ও পোশাক খাতে একটি ভীতি কাজ করছে। কারণ একেকটা কারখানায় ১০ থেকে ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে। তাদের যদি একজনও আক্রান্ত হয়, তার প্রভাব পুরো শিল্প খাতে পড়বে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে পোশাকের চাহিদা অনেক কমে যাচ্ছে। মানুষ ঘর থেকে বের হতে না পারলে পোশক কিনবে কীভাবে? পোশাক খাতের বিশেষ করে ওভেন খাতের কাঁচামালের ৬০ শতাংশ আসে চীন থেকে। অন্যদিকে নিট খাতে আসে প্রায় ২০ শতাংশ কাঁচামাল। এছাড়া অন্য অনেক শিল্পে কাঁচামালের প্রধান উৎস চীন। করোনা ভাইরাসের কারণে আমাদের পোশাক খাত, প্লাষ্টিকখাত, চামড়া, ইলেকট্রনিক, মেডিকেল সামগ্রী, কম্পিউটার, যোগাযোগসহ সব খাতে স্বাভাবিক সরবারহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। আমাদের পর্যটন শিল্পে ধস নামতে শুরু করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত। আমদানী-রপ্তানী ক্ষেত্রে তার পরিমান ৩৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশগুলো বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের অন্যতম উৎস। সুতরাং সেসব দেশগুলোতে করোনা ভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশের উপরেও পড়বে। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের হার বাংলাদেশে কম হলেও এর প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের শীর্ষ আমদানি রপ্তানি ও রেমিটেন্সের বাজারগুলো। আগে থেকেই পুঁজি বাজার বিপর্যস্ত থাকলেও করোনা আসাতে তা আরও নির্জীব হয়ে পড়েছে। দেশের ব্যাংকিংখাত এমনিতেই খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত। এখন করোনার ধাক্কায় অনেক শিল্পখাতই নতুন করে খেলাপির ঝুকিতে পড়বে। ক্রমগতভাবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেশে দেশে বেড়েই চলেছে। তার ফলে স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক ঝুকি এড়ানো সম্ভব নয়। তাই নীতিগতভাবে ক্ষতিরমাত্রা ও পরিমাণ কমানোর জন্য দ্রæত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে তেমনি ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও জনগণকে সচেতন হতে হাবে।
এই মুহূর্তে যে বিষয়টি দেখা উচিৎ তা হল:

১. আমাদের জনশক্তিকে রক্ষা করা। পর্যাপ্ত ডাক্তারি পরীক্ষার সুবিধা, ঔষধ, হাসপাতালের বিছানা, কোয়ারেন্টাইন এর ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার জন্য জনসচেতনতামূলক প্রচার সকল মিডিয়াতে প্রচারের ব্যবস্থ্যা করা। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্ধ দেয়া। বিশে^র অন্যান্য দেশ কিভাবে তাদের অর্থনীতিকে বাঁচানের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে তা থেকে শিক্ষা নেয়া।
২. আমাদের যেসব আমদানি পণ্য প্রয়োজন বিশেষ করে চীন থেকে আমরা যেসব কাঁচামাল আমদানি করি তার বিকল্প উৎসের সন্ধান করা। বিশেষ করে ঔষধ ও চিকিৎসা খাতে অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল আমদানির জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বন্ধ রাখতে হবে।

৩. খেলাপি ঋণ ও ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব সহায়তার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও নীতি সহায়তা দিতে হবে। সরকার ঘোষিত বাজেট কাঠামো পুনর্গঠন করে কিছু খাতের রাজস্ব কমানোর প্রয়োজন হতে পারে।

৪. করোনাআক্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য সরকার কর্মসংস্থান সহায়তা স্কিম শুরু করতে পারে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের রক্ষার জন্য স্বল্পসময়ের জন্য একটি বিশেষ আর্থিক স্কিম চালু করতে পারে।

৫. সরকারের উচিৎ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাজারে সরবারহ নিশ্চিত করা ও মূল্যের কারসাজি বন্ধ করা। সরকারের উচিৎ হবে আপদকালীন জরুরি ও বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা। পোশাক কারখানা যাতে বন্ধ না হয় সেদিকে সজাগ নজর রাখা উচিত। শ্রমিকদের সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া উচিৎ।

৬. করোনাভাইরাসের এ দুর্যোগপূর্ণ সময়ে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। ফলে অর্থনীতির গতি স্তিমিত হয়ে যাবে। তাই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য অর্থনীতিতে বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে হবে। সরকারকে স্বল্প আয়ের লোক ও দরিদ্রদের সুরক্ষা করতে হবে।
৭. করোনার কারণে কোন শিল্পকারখানা ও পোশাক কারখানা বন্ধ হলেও শ্রমিকদের বেতন বন্ধ করা ঠিক হবে না। করোনা ভাইরাস এর প্রার্দুভাব বন্ধ হলে প্রয়োজনে বন্ধের দিনেও কারখানার শ্রমিকেরা কাজ করবে। এমুহূর্তে সময় আগে প্রয়োজন স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানো। জীবনের মূল্য সবকিছুর চেয়ে বেশি। তাই আসুন, আমরা নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি। সাবান ও পানি দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুই। কাঁশি বা হাঁচি দেয়ার সময় মুখ ও নাক ঢেকে রাখি। ঠান্ডা ও ফ্লুতে আক্রান্ত কারো সাথে ঘনিষ্টতা এড়িয়ে চলি। জ¦র, কাশি বা শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা হলে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হই। লোক সমাগম এড়িয়ে চলি। পরস্পর থেকে ১ মিটার দূরে অবস্থান করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক



 

Show all comments
  • jack ali ৩১ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৮ পিএম says : 0
    Our Government must follow his advise.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন