Inqilab Logo

বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ডাক্তার, নার্স ও মেডিক্যালকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান শহর এখন শংকামুক্ত। ক’দিন আগেও শহরটির পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হলো, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে, চীনে এই ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার প্রেক্ষিতে চীন সরকার দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করে। ভাইরাস যাতে সীমিত পরিসরে আটকে রাখা যায় এবং আক্রান্তদের বিচ্ছিন্ন রেখে চিকিৎসা করা যায়, তার ব্যবস্থা করে। চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতাল যেহেতু এই রোগ সংক্রমণের প্রধান কেন্দ্র হতে পারে এবং হয়েছেও, সুতরাং প্রথমে ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেলকর্মীদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতালকে নিরাপদ করা হয়। তৃতীয়ত, সন্দেহভাজনদের বিচ্ছিন্ন করা, রোগ শনাক্ত করা ও চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করা হয়। এসব ক্ষেত্রে ভয়ভীতি, শংকা, আতংক উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালন করেন ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেলকর্মীরা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আক্রান্ত হয়েছেন এমন কি মৃত্যুবরণও করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যদি প্রশ্ন করা হয়, উহানের বীর কারা, যারা প্রাণঘাতী করোনাকে হটিয়ে দিয়ে শহরকে নিরাপদ করেছেন? অবশ্যই এর উত্তর হবে: ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেলকর্মীরা। তারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। শুধু উহানেই নয়, চীনের অন্যান্য এলাকায়ও করোনো সম্পূর্ণ নিয়িন্ত্রণে এসেছে এবং বলাই বাহুল্য। এক্ষেত্রে ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেলকর্মীদের ভূমিকাই আসল ও প্রধান। চীনের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ জানিয়েছে, দেশটির মূল ভূখন্ডে করোনায় আক্রান্ত হয় ৮০ হাজার ৯২৮ জন। তার মধ্যে ৭০ হাজার ৪২০ জন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মারা গেছেন ৩ হাজার ২৪৫ জন। বাকীরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অনেকেরই জানা, করোনায় ইতালী সবচেয়ে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত। মৃত্যুর হারে ইতোমধ্যে শীর্ষে চলে গেছে ইতালী। এই দেশটিরই ভো শহর এখন করোনার ঝুঁকিমুক্ত। এই কৃতিত্ব ডাক্তার, নার্স, মেডিকেলকর্মী ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের। তারা গোটা শহরের লোকদের দু’সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে আটকে রাখেন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ চিকিৎসা প্রদান করেন। এতে দেখা যায়, সংক্রমণের সংখ্যা ৩ থেকে শূণ্য দশমিক ৪১ শতাংশ নেমে এসেছে।

চীনের উহান এবং ইতালীর ভো শহরের ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেলকর্মীদের দায়িত্বশীলতা, মানবিকতা, সাহসিকতা, ত্যাগ ও অবদান অনুসরণযোগ্য নজির সৃষ্টি করেছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশে তাদের সাফল্যগাঁথা কীর্তিত ও অনুসৃত হচ্ছে। কারো অজানা নেই, করোনা দ্রুত সংক্রমণশীল একটি ভাইরাস। সুস্থ দেহে ছোঁয়া লাগলেই এর সংক্রামণ হতে পারে এবং এটি প্রাণঘাতীও বটে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন, চিকিৎসা দেবেন, সেবা করবেন তাদের আক্রান্ত হওয়ার আশংকা অন্যান্যের চেয়ে বেশি। তাই তাদের উপযুক্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রধান পূর্বশর্ত। তাদের গাউন, মাস্ক ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করার পরই আমরা তাদের কাছে থেকে প্রত্যাশিত সেবা আশা করতে পারি। অত্যন্ত দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের দেশে ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ২০ ছাড়িয়ে গেছে। দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। অথচ এখনো আমাদের হাসপাতাগুলো প্রস্তুত করা হয়নি। ডাক্তার নার্স ও মেডিকেলকর্মীদের জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি। করোনার সঙ্গে লড়াইটা প্রকৃতপক্ষে ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেলকর্মীদের। প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ সহযোগী মাত্র। মূল যোদ্ধাদের অরক্ষিত ও অনিরাপদ রেখে যুদ্ধে বিজয় কোনোভাবেই আশা করা যায় না। তিন মাসের ও বেশি সময় হলো এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে। এর প্রকৃতি, লক্ষণ, বিস্তার ইত্যাদি থেকে শুরুতেই বুঝা গেছে, এটা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে, মহামারি আকার ধারণ করবে। চীনের নিকটতম প্রতিবেশি হিসাবে বাংলাদেশও এতে আক্রান্ত হতে পারে। অতএব, এর মোকাবিলায় সম্ভাব্য প্রস্তুুতি গ্রহণের বিকল্প ছিলনা। বিভিন্ন মহলে থেকে এ ব্যাপারে তাকিদও দেয়া হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। সরকারের তরফে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, হম্বিতম্বি করা হয়েছে, বাগবিস্তার করা হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। করোনার হানা শুরু হওয়ায় সবকিছুই এখন ফাঁস হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন করা ও শনাক্ত করা সবচেয়ে প্রাথমিক ও প্রধানতম কাজ হলেও এর কোনো আয়োজন বলতে গেলে নেই। যারা এই কাজটি প্রত্যক্ষভাবে করবেন, সেই ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেলকর্মীদের প্রস্তুত করা হয়নি। তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি, ট্রেনিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। করোনাকে এভাবে অবহেলা করা বা গুরুত্ব না দেয়ার নজির আর কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার এখাতে যে অর্থ বরাদ্দ করেছে, তা গেলো কোথায়?

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা তো পরের কথা, সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বর, ঠান্ডা লাগা কিংবা নিউমোনিয়ার চিকিৎসাও এখন কোনো হাসপাতালেই হচ্ছে না। করোনার ভয়ে ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেলকর্মীরা তাদের ধারে কাছেও আসছেন না, দূর থেকে বিদায় করে দিচ্ছেন। এরকম খবর কয়েকদিন ধরেই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, যার মধ্যে অবহেলা-উপেক্ষায় রোগীর মৃত্যুর খবরও আছে। এ অবস্থার ততদিন পরিবর্তন হবে না, যতদিনে ডাক্তার ও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, খোদ আইইডিসিআরেও কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অনেকেই কোনো সহায়তা পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠান প্রায় প্রতিদিন প্রেসব্রিফিং করে নানা উপদেশ-পরামর্শ খয়রাত করছে। এর কর্তৃপক্ষের মনে রাখা উচিৎ, প্রেসব্রিফিং বা লিফ সার্ভিস দিয়ে করোনা মোকাবিলা করা যাবে না, কিছু করে দেখাতে হবে। কীভাবে করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব, চীন তা দেখিয়ে দিয়েছে। চীনের ডাক্তার, নার্স ও মেডিকেলকর্মীরা দেখিয়ে দিয়েছেন। ইতালি বা অন্যান্য দেশেও এর দৃষ্টান্ত রয়েছে। অবশ্যই বিছিন্ন করার কাজটি ভালোভাবে করতে হবে। বিদেশ থেকে এসে যে লাখ লাখ লোক মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ওপর নজরদারি জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে কোয়ারেন্টাইনে আনতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে হাসপাতালকে নিরাপদ করতে হবে, ডাক্তার নার্স ও মেডিকেলকর্মীদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা মোকাবিলায়, সরকারই শুধু নয়, সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখছেন। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিকে আরো বিশেষভাবে নজর দেবেন। তার নির্দেশনা ও তদারকি করোনা মোকাবিলায় দ্রুত সাফল্য এনে দেবে বলে মানুষের একান্ত বিশ্বাস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিরাপত্তা


আরও
আরও পড়ুন