পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর ধর্ম প্রচারের প্রথম দিকে ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে মহামহিম আল্লাহ আপন আরশ-কুরসি ভ্রমণে নিয়ে যান। ইতিহাসের সে ঘটনাই মিরাজ। এটি সংঘটিত হয়েছিল নিশিরাতে। তাই সে পূণ্য স্মৃতিবিজড়িত রাতটি শবে মিরাজ নামে প্রসিদ্ধ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর গুরুত্ব তো আছেই, মানব ইতিহাসেও এর তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনটি মানবজাতির জন্য অনুপ্রেরণা, গবেষণা ও উপলব্ধির দিন। দুনিয়ার সব নবী-রাসূলকে আল্লাহতা’লা এমন কিছু অলৌকিক শক্তি ও বিশেষত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে তাঁরা প্রচার কাজে সাহস সঞ্চার করেন এবং বিরুদ্ধবাদীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। হজরত মুহাম্মদ (স.)-কে যে ক’টি বিশেষত্ব ও অলৌকিক শক্তি দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছিল, তন্মধ্যে মিরাজ একটি। উল্লেখ্য, মক্কী জীবন বিরুদ্ধবাদীদের হাতে হজরত (সা.) যখন দারুণভাবে বিপর্যস্ত, মুরব্বি ও পরম আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে যখন পরপারে পাড়ি জমাচ্ছিলেন, তখন তাঁর মনপ্রাণ চিন্তাগ্রস্ত ও বিষাদময় হয়ে উঠেছিল। এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহতা’লা তাঁর শেষ নবীকে মিরাজে আহবান করেন। এই রজনীতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবিতাবস্থায় আল্লাহর দিদার নসিব হয়। সেখানে তিনি বেহেশত-দোজখসহ বিশ্ব সৃষ্টির আরো অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রহস্য ও বরকতের শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসেন দুনিয়ায়।
রজব মাসের ২৭ তারিখে এক কৃষ্ণপক্ষের রাতে হজরত (সা.) এশার নামাজ সম্পন্ন করে হজরত উম্মে হানির ঘরে নিদ্রায় মগ্ন। মক্কা নগরীর সবাই এমনকি পশু-পাখিও ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে তখন। এমনই এক শান্ত-শীতল মধুময় সময়ে হজরত জিব্রাইল (আ.) হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিয়রে হাজির হয়ে শুভবার্তা জানালেন, ‘হে আল্লাহর প্রিয় হাবিব (সা.) আপনি জাগ্রত হোন এবং উঠে পড়–ন, আল্লাহপাকের তরফ থেকে আপনার জন্য দ্রুতগামী বাহন বিদ্যুতের চেয়ে অধিক শক্তিমান বোরাক নিয়ে এসেছি। আপনাকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য সব ফেরেশতা ও পূর্ববর্তী নবীগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।’ হজরত জিব্রাইল (আ.) এর এমন সুমধুর ডাক শুনে মহানবী (সা.) উঠে পড়েন এবং হাউজে কাউসারের পানি দিয়ে অজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী, বোরাকে আরোহণ করেন। হাজার হাজার ফেরেশতার পরিবেষ্টনে ‘বোরাক’ ছুটে চলে আকাশের নীল পথ বেয়ে। ক্ষণকাল পরে বোরাক এসে নামল ফিলিস্তিনের ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ মসজিদ প্রাঙ্গণে। এখানে এসে হজরত (সা.) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের উপস্থিতিতে দুই রাকাত নামাজের ইমামতি করেন। তারপর আল্লাহর হাবিব (সা.) বোরাকে আরোহণ করে নভোমন্ডল অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছে তিনি বিভিন্ন অপরূপ দৃশ্য দেখে বিমোহিত হন। প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। আদম (আ.) তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। এ সময় গোটা নভোমন্ডল থেকে ধ্বনি উঠে, ‘মারহাবা’, ‘মারহাবা’। এই স্তর পার হয়ে তিনি দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছান। এখানে পরিচয় হলো হজরত ইয়াহইয়া ও হজরত ঈশা (আ.) এর সাথে। তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসূফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মূসা (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো। সপ্তম আসমানে পৌঁছে তিনি একটি আজিমুশ্শান মহল দেখলেন। এখানে অসংখ্য ফেরেশ্তা আসা-যাওয়া করছিলেন। এখানে তার এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের সাথে সাক্ষাৎ হলো, যাঁর সাথে তাঁর সাদৃশ্য ছিল। পরিচয় জানতে পারলেন, ইনি হজরত ইব্রাহিম (আ.)। এরপর আরো উপরে আরোহণ করতে শুরু করলেন। উঠতে উঠতে তিনি ‘সিদউরাতুল মুনতাহা’ পৌঁছে গেলেন। এই সিদরাতুল মুনতাহা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের উপস্থিতির দরবার ও সৃষ্টিজগতের মধ্যে সীমারেখা হিসেবে গণ্য। নিচ দিয়ে অতিক্রমকারীরা এখানে এসে থেমে যায়, আর উপর থেকে আহকাম ও আরকান সরাসরি এখানে আসে। এই জায়গার কাছাকাছি তাঁকে জান্নাত দেখানো হয়। তিনি দেখলেন, আল্লাহতা’লা তাঁর খাস বান্দাদের জন্য সেইসব জিনিস তৈরি করে রেখেছেন, যা না কোনো চোখ দেখেছে, আর না-কোনো কান শুনেছে, আর না-কেউ এর ধারণা পর্যন্ত করতে পারে।
সিদ্উরাতুল মুনতাহা এসে জিব্রাইল (আ.) থেমে গেলেন। আর রাসূল (সা.) সামনে অগ্রসর হলেন। একটি উঁচু প্রশস্ত ছাদে পৌঁছলেন। বারেগাহে ইলাহি বা আল্লাহর দরবার সামনে ছিল। যেখানে তিনি পরস্পর কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করলেন। যে সব কথা ইরশাদ হলো তার দু-একটি ছিল নিম্নরূপ: ১) প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ র্ফজ করা হলো, ২) সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত শিক্ষা দেওয়া হলো, ৩) র্শিক ছাড়া অন্য যে কোনো গুনাহ মাফ করে দেওয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ করা হলো, ৪) ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি নেক কাজের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তার জন্য একটি নেকি লেখা হয়। আর যখন সে বাস্তবে আমল করে, তখন দশটি নেকি লেখা হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি পাপ কাজ করার ইচ্ছা করে তার বিরুদ্ধে কিছু লেখা হয় না। আর যখন সে তা বাস্তবে করে, তখন তার জন্য একটি মাত্র পাপ লেখা হয়। সফর থেকে ফিরে আসার পথে সেই সিঁড়িটি বেয়ে হজরত (সা.) নেমে বায়তুল মুকাদ্দাস এলেন। তারপর বোরাকে আরোহণ করে মক্কা শরিফে ফিরে এলেন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।