পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মহামারী আকারে সারাবিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে বিশ্বঅর্থনীতি, বিমান ও স্থল যোগাযোগ, পর্যটন, বাণিজ্যসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষ কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে স্বেচ্ছাবন্দি জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। চীনের প্রতিবেশি দেশগুলোকে ছাড়িয়ে ইউরোপের ইতালি, এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক জায়ান্ট দক্ষিণ কোরিয়া,জাপান ও ইরানের মত দেশ এখন করোনা আতঙ্কে ত্রাহি অবস্থায় পতিত হয়েছে। সারাবিশ্বে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইভেন্ট এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ অথবা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। বিগত দশকের শুরুতে ইউরোপ আমেরিকার অর্থনীতিতে যে অর্থনৈতিক মন্দা বা রিসেশন দেখা দিয়েছিল করোনা সিন্ড্রোমের প্রভাবে এবার আরো জোরালোভাবে আঘাত হানতে যাচ্ছে বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। প্রায় দেড়শ কোটি মানুষের দেশ চীনের হুবেই প্রদেশের ওহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে প্রথমেই বিশ্বের সবচেয়ে ত্যাজি অর্থনীতির দেশ চীনকেই প্রথম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। কোনো রাখঢাক বা কালক্ষেপনের আশ্রয় না নিয়ে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় চীন সরকারের ত্বরিৎ উদ্যোগগুলো যথেষ্ট কার্যকর হিসেবে প্রমানিত হয়েছে। এই মুহুর্তে ইউরোপের কেন্দ্রভ’মি ইতালিতে যখন করোনা ভাইরাসে প্রতিদিন শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে তখন চীনে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ১০ জনের কমে দাঁড়িয়েছে। এখন চীনের নিকটতম প্রতিবেশি, শতকোটি মানুষের দেশ ভারতসহ উপমহাদেশে করোনা আতঙ্ক প্রবল আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের পর বাংলাদেশেও হাজার হাজার মানুষ এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৫ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। তবে করোনা নিয়ে কিছুটা তাচ্ছিল্য, অবহেলা ও লুকোচুরির অভিযোগও উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এর ফলে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের চলমান পদক্ষেপগুলো কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েই যাচ্ছে। তবে উষ্ণ আবহাওয়া বা ২০ ডিগ্রীর বেশি তাপমাত্রায় করোনা ভাইরাসের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলার যে তথ্য বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন তাতে বাংলাদেশিদের আতঙ্কিত হওয়া থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকতে আত্মবিশ্বাসি করে তুলেছে। অর্থাৎ আগামি দিনগুলোতে দিনের তাপমাত্রা বৃদ্বির সাথে সাথে করোনার প্রার্দুভাব দূরিভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গিয়েছিল, করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের অর্থনৈতিক টানপোড়েন থেকে সুযোগ নিতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর করোনাভাইরাসের ধকল থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করা চীনা নেতারা করোনা ভাইরাস নিয়ে একটি নতুন কনস্পিরেসি থিওরির অবতারনা করেছেন। এতদিন ধরে চীনা নেতারা করোনা ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত ও ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে শত শত কোটি ডলারের বাজেট নিয়ে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। এখন তারা করোনা ভাইরাস নিয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আঙুল তুলতে শুরু করেছেন। মার্কিন সেনা বাহিনী চীনের ওহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে দাবি করেছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ও ডাকসাইটে ডিপ্লোম্যাট ঝাও লিজিয়ান। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একজন উদীয়মান তারকা হিসেবে গণ্য ঝাও লিজিয়ান। চীনের করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সময়টাতে কমিউনিস্ট পার্টির বেশকিছু নেতাকে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে বহিষ্কার বা অব্যাহতি দেয়া হয়। সে সময় ঝাও লিজিয়ানকে পদন্নোতি দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ওহানে করোনা ছড়িয়ে দিতে মার্কিন সেনা সদস্যদের অভিযুক্ত করতে গিয়ে একাধিক টুইট বার্তায় তিনি মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। ঝাও তার টুইট বার্তায় উল্লেখ করেন, মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল(সিডিসি)র পরিচালক রেডফিল্ড ন্বীকার করেছেন কিছু সংখ্যক মার্কিনী আপাতভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জার মত রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর তাদের শরীরে নোভেল করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এরপর দ্বিতীয় টুইটে ঝাও প্রশ্ন রাখেন, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা আক্রান্ত প্রথম রোগীটি কখন, কোথায় শনাক্ত হয়েছিল, আক্রান্তের সংখ্যা কত, তারা কোন কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব বিষয় খোলাসা করার দাবী করেছেন তিনি। চীনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই এই প্রচারণা চালু হয়েছে যে, মার্কিনীদের মাধ্যমেই চীনের ওহানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। এই দাবির শক্ত ভিত্তি হচ্ছে, গত বছরের অক্টোবরে চীনের ওহানে ৭ম আন্তর্জাতিক মিলিটারি ওয়ার্ল্ড গেম অনুষ্ঠিত হয়। মে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মার্কিন সেনাবাহিনী থেকে প্রায় ৩০০ প্রতিযোগী অংশ নেয়। এই প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার একমাস পর ওহানে প্রথম করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়। চীনা রোগতত্ত¡ বিশেষজ্ঞ ও এপিডেমিওলজিস্ট ঝং নানশেন গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে দাবি করেন, করোনাভাইরাসের উদ্ভব সম্ভবত চীন থেকে হয়নি। ওহান করোনাভাইরাসে বেকায়দায় পড়া চীনের উপর ট্রাম্প প্রশাসনের অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের মতলব যখন ফাঁস হয়ে গেছে, তখন ওহানে মার্কিনীদের করোনা ভাইরাস ছড়ানোর প্রচারনা বেশ শক্তিশালী বে্লইম গেমে পরিণত হতে চলেছে।
নোভেল করোনাভাইরাস একের পর এক চীনা শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়া, লাখ লাখ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ, হাজার হাজার মৃত্যুর ঘটনায় চীনা অর্থনীতিতে ধস নামার উপক্রম হয়েছিল। চীনের মূল শক্তি তার অর্থনীতি ধসে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আনচ্যালেঞ্জিং পরাশক্তি হয়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু ভাইরাস যখন চীনে স্তিমিত হয়ে পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, এমনকি চীনের নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে স্কুল-কলেজ, বন্দর ও সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে, তখন চীনের ম্যানুফেকচারিং খাতের জন্য দ্বিগুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বয়ে নিয়ে আসছে। করোনাভাইরাস আউটব্রেক ইস্যুতে চীনের অর্থনৈতিক ক্ষতির অঙ্ক কত তা এখনো আমরা জানি না। এটুকু সবাই জানে করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব ঠেকাতে জানুয়ারীতে চীন ৯ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘোষণা করেছিল। তবে আতঙ্ক কাটিয়ে চীনের পুরোমাত্রায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসার আগেই করোনা ভাইরাসের বিপর্যয় থেকে অকল্পনীয় মুনাফার সুযোগ হাতছাড়া করেনি। গত ৫ দশকে চীনের বিশাল অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে তার মুক্ত বাজার অর্থব্যবস্থায় পদার্পণ ও পশ্চিমা কপোর্রেট বিনিয়োগের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। একইভাবে চীনা বিনিয়োগকারি ও রফতানীকারকরা মার্কিন বাজার ও অর্থনীতিতে শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। নতুন শতাব্দীর শুরুর দিকে ২০০৩ সালে চীনে করোনা সার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে চীনা অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘুড়ে দাঁড়ানো চীনা অর্থনীতিকে আর একবারের জন্যও থমকে দাঁড়াতে হয়নি। এবার তা থমকে দাঁড়ানোই শুধু নয়, মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে আগের চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে ঘুঁড়ে দাঁড়ানোর পথে পা বাড়াতে শুরু করেছে। প্রথমত: ওহান করোনাভাইরাস নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারনার কারণে ধস নামা চীনা পুঁজিবার থেকে পশ্চিমাদের পুঁজি প্রত্যাহারের হিড়িককে কোনো রকম সময়ক্ষেপণ ছাড়া কাজে লাগিয়েছে চীন সরকার। দর পতনের ধারাবাহিকতায়, হাজার হাজার বিলিয়ন ডলারের পুঁজি হারিয়ে হতাশ পশ্চিমা কর্পোরেট বিনিয়োগকারিরা তাদের শেয়ার ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই স্থানীয় বিনিয়োগকারিদেরকে এসব শেয়ার কিনে নিতে উৎসাহিত করে চীন সরকার। পতনশীল মূল্যে শেয়ার কিনে নেয়ার পরই চীনে করোনাভাইরাসের দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়লে চীনের ম্যানুফেকচারিং খাত ও অর্থনীতি আবারো বিপুল সম্ভাবনাময় হয়ে দেখা দেয়ার পর পশ্চিমা বিনিয়োগকারিরা বুঝতে পারেন, তারা কত বড় বোকামি ও ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছেন। বড় বড় চীনা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে হাজার হাজার কোটি ডলারের পশ্চিমা বিনিয়োগ ছিল, এ সময়ে তারা বিপুল পরিমান পুঁজি হারিয়ে কম মূল্যে চীনাদের কাছে শেয়ার হস্তান্তরের পর এসব কোম্পানীতে চীনাদের একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের পুঁজি হারানোর পরিমান কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে জানা যায়।
দুর্যোগ ও দরপতনের সময়কে পুঁজিবাজারের সুযোগসন্ধানীরা কাজে লাগিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের সময়ে চীনা বিনিয়োগকারিরা বাজিমাৎ করে দেখিয়ে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে চীন সরকারের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা, রাতারাতি নতুন নতুন হাসপাতাল নির্মান, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য যুদ্ধাবস্থার মত মিলিট্যান্ট শৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থান এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থগিত রেখে রোগ ঠেকানোর সিদ্ধান্তের সুফল দৃশ্যমান হতে বেশি সময় লাগেনি। করোনা ভাইরাস শেষ পর্যন্ত চীনের জন্য শাপে বর হল কিনা তাই এখন দেখার বিষয়। বিশ্বের অন্য প্রান্তে বিশেষ করে শীতপ্রধান ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ভূরাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব কতদূর গড়ায় তাও দেখার বিষয়। তবে এখন আর কেউ দর্শক নয়, প্রায় সকলেই করোনায় আক্রান্ত অথবা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় বিপর্যস্ত। আমরা যদিও ধরে নিচ্ছি, বাংলাদেশের আবহাওয়া করোনাভাইরাসের জন্য সহনীয় নয়, অতএব এখানে করোনার মহামারি হয়তো আঘাত হানতে পারবে না। এ মুহূর্তে প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস নিয়ে এতটা কনফিডেন্ট বা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এটি একেবারেই নতুন প্রজাতির ভাইরাস হওয়ায় এ সম্পর্কে পুরোটা জানা সম্ভব হয়নি। এ কারণে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক বা নিরামযোগ্য ওষুধও তৈরি করা এখনো সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে করোনা নিয়ে চীন-মার্কিন ব্লেইম গেম ও কনস্পিরেসি থিওরির অবতারনা দেখা গেছে। করোনা ভাইরাসের কারণে গ্লােবাল ইকোনমির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির একটি গতি বদলের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশেও মৃদু রাজনৈতিক ব্লেইমগেম সত্তে¡ও সরকার এবং প্রধান বিরোধি দল বিএনপি’র এক প্রকার সমান্তরাল ঐক্য দেখা গেছে। করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রশ্নে সরকার ও বিরোধিদল রাজধানীতে লিফলেট বিতরণ করতে দেখা যাচ্ছে। স্কুল-কলেজ বন্ধের দাবি ইতিমধ্যে সরকার মেনে নিয়েছে। পাশাপাশি উপমহাদেশের আঞ্চলিক সম্পর্ক ও রাজনীতিতেও করোনাভাইরাস যেন থেরাপি হিসেবে কাজ করেছে। আমরা জানি ভারতের অনিচ্ছায় আঞ্চলিক সংস্থা সার্ক অনেকটা অকার্যকর সংস্থা হিসেবে কোনোমতে টিকে আছে। এর কোনো বাস্তব কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন বিলোপ, এনআরসি, নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে যখন ভারত-পাকিস্তানের পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ, সেই সাথে মাঝে-মধ্যেই উচ্চারিত হচ্ছে যুদ্ধের হুমকি, এমনই এক জটিল সময়ে করোনা ভাইরাস যেন সব ব্যবধান ঘুঁচিয়ে দিতে শুরু করেছে। গত রবিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আহবানে সাড়া দিয়ে সার্কভুক্ত ৮ দেশের সরকার প্রধান ও প্রতিনিধিরা লাইভ ভিডিও কনফারেন্সে মিলিত হয়ে করোনা মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ, সমন্বিত ও পারস্পরিক সহযোগিতামূলক ভূমিকার পক্ষে ঐকমত্য পোষণ করতে দেখা যায়। বিগত এক দশক বা তার বেশি সময়ের মধ্যে ভারত-পাকিস্তানসহ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কোনো বিষয়ে একসাথে বসে এমন মতৈক্যে পৌঁছাতে দেখা যায়নি। করোনাভাইরাস সার্কের বৈরী প্রতিবেশিদের এককাতারে সামিল করেছে। এটা অবশ্যই করোনা ভাইরাসের একটি ইতিবাচক প্রভাব।
দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকা, ইতিমধ্যে বিদেশ ফেরত হাজার হাজার মানুষ কোনো রকম পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ ছাড়াই সারাদেশে ছড়িয়ে আশঙ্কায় এদের মধ্যে একটি অংশ যদি ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাদের মাধ্যমে এর মধ্যে কত সংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। বলা হচ্ছে, প্রায় আড়াই হাজার মানুষ হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছে। এদের কোয়ারেন্টাইন কতটা নিরাপদ ও কার্যকর তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পুঁজিবাদি বিশ্ব যদি এভাবে কোয়ারেন্টাইনে যেতে শুরু করে কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে হয়তো চলমান বিশ্ববাস্তবতায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। করোনাভাইরাসের কারণে পারস্পরিক মেলবন্ধন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক যোগাযোগ সীমিত হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ণের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে কিনা এই প্রশ্নও এখন উঠে এসেছে। কোথাও যুদ্ধ নেই, ভূমিকম্প-সুনামি বা ঘূর্ণীঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকলেও বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক এভিয়েশনের হাজার হাজার ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। ব্যস্ততম বিমান বন্দরগুলো যেন অচল হয়ে পড়তে শুরু করেছে। শপিংমল, স্টেডিয়াম, সিনেমা হল, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফাঁকা হয়ে গেলে শহরের একেকটা বাড়ি যেন কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পরিণত হচ্ছে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি অনুসারে, সম্ভাব্য রোগীদের দুই সপ্তাহের কোয়ারেন্টাইন ও শশ্রুসা করলে পুরো জনপদকে নিরাপদ করে তোলা সম্ভব। ওহান শহরের মহামারি মোকাবিলায় চীনের গৃহিত পদক্ষেপগুলো থেকে সব দেশের শিক্ষণীয় রয়েছে। করোনা নিয়ে অবহেলা লুকোচুরি এবং অহেতুক আতঙ্ক আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষত হাসপাতাল পরিষেবা, স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তারসহ কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থায় সর্বাত্মক নজরদারিসহ মানুষের সুস্থ্যভাবে বেঁেচ থাকার প্রয়োজনীয় সামগ্রিক যোগান নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। চীনের সাথে, ইরানের সাথে, ইতালি ও কোরিয়ার সাথে তাদের প্রতিবেশি দেশগুলো সব সীমান্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি ভারতও বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ও সীমান্ত যোগাযোগ স্থগিত করে দিয়েছে। করোনাভাইরাস আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক যোগাযোগে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। সব বিভেদ বৈরিতা ভুলে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতারা ভার্চুয়াল মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরস্পর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে সম্মত হয়েছেন। করোনাভাইরাসের সময়ে মুজিববর্ষের সন্ধিক্ষণে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেও পরিবর্তনের নতুন দুয়ার উন্মোচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। শুধু সম্ভাব্য করোনাভাইরাস রোগীদেরই নয়, লুটপাট, দখলবাজ, চাঁদাবাজ, জুয়াড়ি, অর্থ পাচারকারি ও দুর্নীতিবাজদেরও আইনের কোয়ারেন্টাইনে পঠিয়ে দেয়া প্রয়োজন। করোনাভাইরাস আমাদের চলার পথকে সাময়িক রুদ্ধ করে দিলেও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, লুটপাট, শোষণ ছাড়াও এ সময়ে আমাদের অবচেতনে জমে থাকা অহঙ্কার, ক্ষমতার দর্প বিদূরিত হবে এবং অবদমিত গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবমুক্ত হবে, এটাই আমাদের প্রত্যয় ও প্রত্যাশা।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।