পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সারা বিশ্বে এখন চলছে করোনাভাইরাস আতঙ্ক। কারণ এ রোগ প্রথম চীনে দেখা দিলেও অল্প দিনের মধ্যেই এটা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এমন কি ‘উন্নত বিশ্ব’ বলে পরিচিত ইউরোপ-আমেরিকায়ও এ রোগ দেখা দেয়ায় বলতে গেলে এখন করোনা আতঙ্ক থেকে মুক্ত নয় বিশ্বের কোনো দেশই।
বাংলাদেশ প্রথম দিকে বেশ কিছু দিন করোনা থেকে মুক্ত থাকলেও দেশে তিন জন করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রচারের পর বাংলাদেশেও এখন জনগণের মধ্যে করোনা-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আশ্বাস দেয়া হচ্ছে যে, বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে, সুতরাং জনগণ যেন অযথা কারোনা আতঙ্কে না ভোগে, তবুও জনগণের মন থেকে করোনা আতঙ্ক কিছুতেই দূর করা যাচ্ছে না।
সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত কতিপয় পদক্ষেপও জনগণের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত বিশাল কর্মসূচি কাটছাঁট করে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আনা। এই কাটছাঁটের ফলে অবশ্য জনগণ একটি বিশেষ কারণে খুশীও হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন।
এই নরেন্দ্র মোদি এক সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে গুজরাটের মুসলিম-বিরোধী গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তিনি ‘গুজরাটের কশাই’ নামে কুখ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তাও শুধু একবার নয়। দুই দুই বার। প্রথম বারের প্রধানমন্ত্রিত্ব শেষে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হন, তখন তাঁর দল বিজেপির নেতা-কর্মীরা এই বলে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে জনগণের সমর্থন কামনা করেন যে, ভারতের মুসলমানদের দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে তাঁকে (নরেন্দ্র মোদিকে) পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা প্রয়োজন। হিন্দু-প্রধান ভারতের জনগণ বিজেপির নেতা-কর্মীদের এ প্রত্যাশা পূরণে কার্পণ্য করেনি। তারা বিপুল ভোটে নরেন্দ্র মোদিকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে।
দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে নরেন্দ্র মোদি প্রথম সুযোগেই যে কাজটি করেন তা হলো ভারতের একমাত্র মুসলিম-প্রধান রাজ্য কাশ্মীরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দুর্বল করে দেয়া। শুধু তাই নয়, কাশ্মীরের কংগ্রেস সমর্থক মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহর পরিবারের ন্যাশনাল কনফারেন্স দলের সদস্যদের নেতাদের বন্দি করে তাদের উপর নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কাশ্মীরের জনগণের (যাদের অধিকাংশই মুসলমান) জীবনকে অভিশপ্ত করে তোলা।
সংবাদপত্র পাঠকদের মনে থাকার কথা, সে সময় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সচক্ষে সরেজমিনে কাশ্মীরের অবস্থা দেখার লক্ষ্যে কাশ্মীরে যাবার চেষ্টা করলে তাকে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকেই ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়।
এখানে কাশ্মীরের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোকপাত না করলে নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে না। অতীতে আমরা এ ব্যাপারে একাধিক বার আলোচনা করেছি। একবার আমাদের সংশ্লিষ্ট নিবন্ধের শিরোনাম ছিল: ‘কাশ্মীরের শেখ যে ভুল করেছিলেন, বাংলার শেখ সে ভুল করেননি।’
আলোচনায় বলা হয়েছিল: উপমহাদেশের ‘শেখ’ উপাধিধারী দুই বিখ্যাত নেতার একজন ছিলেন (বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিবুর রহমান। অপর জন ছিলেন (শেরে কাশ্মীর) শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। উভয়েরই জীবনের প্রধান স্বপ্ন ছিল তাদের স্ব-স্ব জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জন করা। তাদের একজন শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের এই প্রধান লক্ষ্য অর্জনে সঠিক পথ অবলম্বন করে বৃটিশ শাসনামলে মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে পাকিস্তান এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সফল হন। অন্যজন (শেখ আবদুল্লাহ) ভুল পথ অবলম্বন করে তাঁর পারিবারিক বন্ধু পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর প্রভাবে কংগ্রেস সমর্থক ন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগদান করায় হিন্দু-অধ্যুষিত স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেই কাশ্মীরের স্বাধীনতার স্বপক্ষে কথা বলার অপরাধে কারাবরণ করতে এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতার স্বপ্ন অপূরিত রেখেই ইহজগৎ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন।
এখানে বাস্তব ঐতিহাসিক তথ্য জানানোর উদ্দেশ্যে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজন। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রি পন্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর পারিবারিক বন্ধু শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের ভারতে যোগদানকে অনুপ্রাণিত করতে মুসলিম প্রধান কাশ্মীরের রাষ্ট্রীয় প্রধানকে মুখ্যমন্ত্রীর (চিফ মিনিস্টার) পরিবর্তে প্রাইম মিনিস্টার (প্রধানমন্ত্রী) পদ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে কাশ্মীরের পার্থক্য বোঝাতে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা দান করেছিলেন, যদিও এই বিশেষ মর্যাদার কোনো সাংবিধানিক গুরুত্ব বা মূল্য ছিল না।
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরের এই বিশেষ মর্যাদা বাতিল করেন। শুধু তাই নয়, ভারতের একমাত্র মুসলিম-প্রধান রাজ্যকে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে পরিণত করে কাশ্মীরে সরাসরি বিজেপি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
আগেই বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে গুজরাটে মুসলিম বিরোধী গণহত্যায় নেতৃত্বদানের কারণে এককালে তিনি ‘গুজরাটের কশাই’ নামে কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সেই গুজরাটের কশাই পরবর্তীকালে হিন্দু-প্রধান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তাও শুধু একবারের জন্য নয়। দুই দুই বারের জন্য। দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি শুধু ভারতের একমাত্র মুসলিম প্রধান রাজ্য কাশ্মীরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে মুসলিম-প্রধান একমাত্র রাজ্যটিকে দুর্বল করেই দেননি, তার পুরাতন অভ্যাস মোতাবেক এই দিন দিল্লিতেও মুসলিম বিরোধী গণহত্যা চালিয়ে মুসলিম-প্রধান বাংলাদেশের জনগণের কাছে অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ সরকার এসব সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। যদিও বাংলাদেশের জনগণ নরেন্দ্র মোদির মতো একজন মুসলিম গণহত্যার নেতৃত্বদানকারীর বাংলাদেশ সফরের তীব্র বিরোধিতা করে আসছিলেন সরকার এই যুক্তিতে যে, তিনি (নরেন্দ্র মোদি) সেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী, যে ভারত একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দান করেছিল।
এর মধ্যে বাংলাদেশে তিন করোনা রোগী সনাক্ত হওয়ায় বিদেশি অতিথিবৃন্দ বাংলাদেশ সফরের প্রোগ্রাম বাতিল করে দেওয়া হয়। এরফলে বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধু জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান ব্যাপকভাবে কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়। এর ফলে ভারত সরকারের পক্ষে তাদের প্রধানমন্ত্রি নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রোগ্রামও স্থগিত না করে উপায় থাকে না।
যদিও বাংলাদেশে তিন জন করোনাভাইরাস রোগী সনাক্ত হওয়া একটি দুঃখজনক ঘটনা তবুও মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের জনগণ এই উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদির মতো একজন মুসলিম-বিরোধী গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী সাম্প্রদায়িক নেতার সফর বাতিল হওয়ায় আনন্দিতই হয়েছে।
তবে এ প্রসঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে যে, নরেন্দ্র মোদির মতো একজন মুসলিম-বিরোধী গণহত্যাকারীর বাংলাদেশ সফর বাতিল হওয়াতে আমরা যত খুশিই হই, আমাদের এখন প্রধান ও পবিত্র দায়িত্ব হবে করোনাভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে জনগণকে মুক্ত ও নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং এ ব্যাপারে সামান্যতম ত্রু টি বা ভুল না করা।
আমরা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ সম্পর্কে যেসব পরামর্শ প্রকাশিত হয়েছে তা যদি কঠোরভাবে মেনে চলি, তবেই হয়তো আমরা করোনাভাইরাসের বিপদ থেকে দেশ ও জনগণকে রক্ষা করতে পারব। এসব পরামর্শের মধ্যে রয়েছে:
(এক) হাত ধোয়া অর্থাৎ নিয়মিত এবং ভালো করে বার বার হাত ধোয়া অন্তত ২০ সেকেন্ড যাবৎ। কারণ, সাবান-পানি দিয়ে বার বার হাত ধুলে এই ভাইরাসটি হাত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
(দুই) হাঁচি-কাশিতে সতর্কতা। অর্থাৎ হাঁচি ও কাশির সময় টিস্যু ব্যবহার করা। টিসু না থাকলে বাহুর উপরের অংশ দ্বারা নাক-মুখ আড়াল করতে হবে।
(তিন) চোখ মুখ যখন তখন না ছুঁয়া। হাত না ধুয়ে চোখ, মুখ, নাকে হাত না দেয়া।
(চার) সংস্পর্শ এড়ানো: অসুস্থ ব্যক্তিদের কাছে না যাওয়া এবং একান্ত প্রয়োজন ছাড়া জনসমাগমস্থল এড়িয়ে চলা।
(পাঁচ) প্রয়োজনে ঘরে থাকা: অসুস্থ হলে ঘরে থাকা এবং বাইরে না যাওয়া। অত্যাবশ্যক হলে বাইরে যেতে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা।
(ছয়) খাবারের ক্ষেত্রে সাবধানতা: কাঁচা মাছ-মাংস ধরার পর ভালো করে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা এবং ভালো করে সেদ্ধ করে রান্না খাবার খাওয়া।
(সাত) ভ্রমণে সতকর্তা: জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত থাকা।
(আট) স্বাস্থ্য কর্মীর সাহায্য নেয়া: কখনো কোনো কারণে অসুস্থ বোধ করলে জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকর্মীর সাহায্য নেয়া অথবা আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করা। আইইডিসিআরের হটলাইন নম্বর: ০১৯২১৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, এবং ০১৯৩৭০০০০১১।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।