Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বঙ্গবন্ধুর কাব্যময় ভাষণেই লুকিয়ে ছিল স্বাধীনতার আহ্বান

ড. এম এ মাননান | প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

স্কুলজীবন থেকেই ভাষণ শোনার বাতিক ছিল। আমাদের এলাকায় শীতকাল ছিল ভাষণ আর ওয়াজের মৌসুম। সব সময় অপেক্ষায় থাকতাম কবে শীতের মৌসুম আসবে, পৌষ-মাঘের ঠান্ডা হাওয়ায় চাদর মুড়ি দিয়ে গুটি গুটি করে নেতাদের ভাষণ আর হুজুরদের ওয়াজ শোনার জন্য ধানকাটা শুকনো খালি মাঠে যাব, আর মাঠের এক কোণায় বসে খেজুর গুড়ের মুড়ি-মোয়া খেতে খেতে সুললিত কণ্ঠের কথা শুনব। ওয়াজ দিয়েই আমার ভাষণ শোনার প্রথম অভিজ্ঞতা। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। বাড়ির অদূরে স্কুলের মাঠে এক হালকা শীতের বিকেলে সোনালী রোদ্দুরে গা এলিয়ে দিয়ে গ্রামের আরো কয়েকজনের সাথে প্রথম বার নোয়াখালী থেকে আগত একজন বিশালদেহী শুভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত ‘মাওলানা’ সাহেবের ওয়াজ শুনে মনে হয়েছিল, এত সুন্দর করে একজন মানুষ কীভাবে কথা বলতে পারে, মানুষকে হাসাতে পারে আবার কাঁদাতেও পারে এবং মাঝে মাঝে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে চারিদিক স্তব্ধ করে দিতে পারে। যদিও কোনো কথা বুঝতে পারিনি, তবুও মনে হতো, আমি কি কোনোদিন এমন মিহি সুরে হাজারো মানুষের সামনে হাসি-কান্নার জোয়ার তুলে কথার মালা গাঁথতে পারবো? এরপরেও আরো অনেক হুজুর আর রাজনীতির নেতাদের ভাষণ শুনেছি, তাদের কথার গাঁথুনিতে অবাক হয়েছি, কারো কারো কথার সাথে সাথে হাত-চেহারার অদ্ভূত সব ভঙ্গি দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছি এবং ভেবেছি কখনো কি আমি এমনটা পারবো, ওই বক্তার মতো? আটষট্টি সনে প্রথমবার ঢাকায় এসে কয়েক বার পল্টন ময়দানে শুনেছি মওলানা ভাসানীর অগ্নিঝরা ভাষণ। প্রতিটি বাক্যের মধ্যেই যেন আগুনের হল্কা। আরো অনেক নেতার বক্তব্য শুনেছি বিভিন্ন সময়ে। মনে হতো, এরা কতো কথা জানে, কতোভাবে কথা বলতে পারে আর কথার প্রগল্ভতা দিয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের চিত্ত হরণ করতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি চমক লেগেছে একটিমাত্র ভাষণে, যে ভাষণটি শুনেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে রেসকোর্স ময়দানে, সাতই মার্চে উনিশ শত একাত্তরে। রেসকোর্স ময়দানের পশ্চিম অংশে চারুকলা ইনস্টিটিউটের পূর্বপাশে ঘোড়া রাখার ঘর (জিমখানা) থেকে একটু পূর্বে বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করা জায়গাটির একেবারে পাশে বসে ভাষণটি শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল এটি কী ভাষণ, নাকি গদ্য-কবিতার ফল্গুধারা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভাষণটি শেষ। কিন্তু মনে হলো, শেষ হয়েও যেন হয়নি শেষ, রেশ রয়ে গেছে হৃদয়ের গহীনে। কী চমৎকার কবিত্বময় বক্তব্য। প্রতিটি শব্দই যেন এক একটি বাক্য। প্রতিটি বাক্যেই অর্থবহ ভাবের অনুরণন। চিন্তার খোরাক অনেক। রাজনীতির মানুষেরা কি এভাবেই নিজের ভাব প্রকাশ করে তাদের কাছে যারা তাদেরকে অনুসরণ করে? হাতে কিছুই নেই; ভরসা শুধু গলা। দরাজ গলায় আঙুল উঁচিয়ে তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে কমান্ডিং সুরে অনেকগুলো কথা বলে গেলেন অল্প কথা দিয়ে। এসব চিন্তা করতে করতে জিন্নাহ হলে ফিরে গেলাম। তখন সন্ধ্যা নামে নামে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ দখলদার পাকিস্তানি শাসকদের হৃদয়ে কাঁপন তুলে দিয়েছিল। আর পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে করেছিল উদ্বেলিত। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত দশ লক্ষাধিক অনুসারী বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি উর্ধ্বে তুলে মুহুর্মূহু ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত করে তুলছিল সারা রেসকোর্স ময়দান। পাকিস্তানি শাসকদের বিভিন্ন রকমের হুমকি-ধমকির মধ্যেই সব শ্রোতা-দর্শক ফিরে গেলো যার যার আবাসে সন্ধ্যা নামার আগেই। সাথে নিয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার প্রচ্ছন্ন ঘোষণা; একটি অসম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রত্যয়; বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল অনুভূতি; জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির আহবান; সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ; মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির ইঙ্গিত; অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি; শোষকদের রাহু থেকে পূর্ব বাংলাকে মুক্তির জন্য নবতর উদ্দিপনা; প্রয়োজনে শত্রুর মোকাবেলায় গেরিলা আক্রমণের কৌশল অবলম্বনের তাগিদ এবং সর্বোপরি, মানচিত্র বদলে দিয়ে নতুন পতাকা লাভের আকাঙ্খা আর স্বাধীনতা অর্জনে করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। সারা বিশ্বের বহু নেতার হাজারো নামকরা ভাষণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণটি শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের জাতীয় সম্পদই নয়, বিশ্ব মানবতার সম্পদ হিসেবেও আজ বিশ্বস্বীকৃত। এ স্বীকৃতি মিলেছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪৬ বছর পর ২০১৭ সালে যখন ইউনেস্কো এ ভাষণটিকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ’ (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ প্রোপার্টি) হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করে। ভাষণটির এরূপ অন্তর্ভুক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সক্রিয় উদ্যোগে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং ইউনেস্কো নির্বাহী বোর্ডে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য গৌরব হিসেবে অর্জিত হয়েছে।

নজিরবিহীন অনেক ঘটনাই অনেক দেশে ঘটে। কিন্তু একটিমাত্র ভাষণ যে একটি জাতির জন্ম দিতে পারে, বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঐক্যের বাঁধনে বেঁধে ফেলতে পারে, নিরস্ত্র জনগণকে নিমিষে সশস্ত্র করে তোলাসহ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে পারে, গদিনশীন শক্তিশালী সরকারের সব কর্মকান্ডকে স্থবির করে দিয়ে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপকে স্তব্ধ করে দিতে পারে এবং একই সাথে জাতি-রাষ্ট্র সৃষ্টি করে বিশ্বকে হতবাক করে দিতে পারে, তা বিশ্বে নজিরবিহীন না হয়ে আর কী হতে পারে? বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ শুধু বিশ্ব পরিমন্ডলে নজিরবিহীনই নয়, একটি দেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে অকল্পনীয়ও বটে। একটি ভাষণ কীভাবে কৌশলী ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ আনার সুযোগ না দিয়ে একটি দেশের মানচিত্র বদলে দিতে পারে, একটি আলাদা সার্বভৌম পতাকা উপহার দিতে পারে, তা বিশ্ববাসী কখনো ভাবতেও পারেনি। এমনকি জ্যাকব ফিল্ড নামক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, মাও সে তুং সহ ৪১ জন বিশ্বখ্যাত নেতা আর বীর সেনানীর বিখ্যাত ভাষণগুলো নিয়ে যে বই রচনা করেছেন তাতে দেখা যায়, তাদের ভাষণগুলোর কোনোটিই কোনো দেশ স্বাধীন করার জন্য দেয়া হয়নি। এই বইটিতেই অন্তর্ভুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণটিই একমাত্র স্বাধীনতার প্রচ্ছন্ন ঘোষণা সম্বলিত।

এটিকে আমরা কেনো ভাষণের অনুরণনে স্বাধীনতার ঘোষণা বলছি? বিষয়টি বোঝার জন্য একটু পেছনে ফিরে তাকাই। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৪ বছর পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) ছিল একটি নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত জনপদ। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অধ্যুষিত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে আলোচনা না করেই এটির নাম বদলে নতুন নাম দেয়া হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান’। বঙ্গবন্ধুর মতো অনেকেই এরূপ একদেশদর্শী সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। তখন থেকেই মূলত শুরু হয় বাঙালিদের জন্য একটি নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’ ভাবনা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এরূপ ভাবনার নেপথ্য নায়ক। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের পরিকল্পিত শোষণ আর নিপীড়ন সব বাঙালিকে তোলে ক্ষেপিয়ে। তার মধ্যে ঘৃতাহুতি দেয় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষাকে কৌশলে অবলুপ্ত করে দেয়ার অপচেষ্টা। বাঙালি খেপলে যা হয় তাই হলো। শুরু হলো বাংলা ভাষাকে আপন মর্যাদায় টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম-ভাষা আন্দোলন। রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকে বাঁচানো গেলো। তখন পাকিস্তানি শাসকরা গ্রহণ করে ভিন্ন কৌশল। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ধ্বস-নামানো জয় পাওয়ার পরও শাসকদের অনীহা আর চক্রান্তের কারণে সরকার গঠন করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে, সরকার গঠনের সুযোগই দেয়া হয়নি। এরই ফলশ্রুতিতে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অহিংস আন্দোলনে অংশ নেয় আপামর জনসাধারণ। পাকিস্তানি শাসকদের ঘটানো বহু নাটকীয় ঘটনার পর আসে সাতই মার্চ, যেদিন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে সব বাঙালিকে বুঝিয়ে দেন শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে চালিয়ে যেতে হবে আন্দোলন আর প্রস্তুতি নিতে হবে একটি অত্যাসন্ন যুদ্ধের জন্য, হাতের কাছে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ। এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি সমগ্র জাতিকে একত্রিত করলেন। তিনি সচেতনভাবে তখনকার বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে বাঙালির রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দশ লক্ষাধিক জনতার সামনে প্রথমেই দৃঢ়চিত্তে স্বাধীনতা অর্জনের আবহ ছড়িয়ে দিলেন: ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়’। অল্প কথায় এ দেশের মানুষের ২৪ বছরের করুণ রক্তাক্ত ইতিহাস, শাসকদের বেইমানি আর নির্বাচনোত্তর মকারির কথা তুলে ধরে ২৫ মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আহূত এসেম্বলিতে বসার শর্ত হিসেবে সামরিক আইন তুলে নেয়া, সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া, হত্যার তদন্ত করা আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি ব্যক্ত করেন। তারপর কথা এগিয়ে নিয়ে কোর্ট-কাছারি, অফিস, প্রতিষ্ঠান, খাজনা-ট্যাক্সসহ সব কিছু অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন, ঠিক যেন মুকুটহীন বাদশাহ। সবাই বিনা বাক্যে নির্দেশ মেনে নেন। একই সাথে ঘরের শত্রু বিভীষণদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন আর অসম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন যাতে শত্রুরা সুযোগ না নিতে পারে। সবাইকে যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকার হুকুম দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেষ কথাটি বলে আসল কথাটিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসলেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ মোহনীয় ভাষায় কাব্যিক গদ্যে মাত্র আঠার মিনিটে তিনি একটি মহাকাব্যই রচনা করেননি, স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করলেন সারা দেশবাসীকে, স্বপ্ন দেখালেন একটি স্বাধীন, মুক্ত বাংলাদেশের। তাঁর এই কাব্যময় ভাষণেই লুকিয়ে ছিল স্বাধীনতার বীজ।
লেখক: কলামিস্ট ও উপাচার্য, বাংলাদেশ উš§ুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বঙ্গবন্ধু

৮ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন