Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

সহিংসতায় নিখোঁজদের খোঁজে দিল্লির স্বজনরা

১৩২০০ ফোনকলেও সাড়া দেয়নি পুলিশ নিহতের অধিকাংশই মুসলিম

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০২০, ১২:০০ এএম

উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পাঁচ দিন পার হলেও অনেক পরিবার তাদের নিখোঁজ সদস্যের খোঁজ করছেন। বেশিরভাগই হাসপাতালে খুঁজে দেখেছেন। আশঙ্কা করছিলেন তাদের প্রিয়জনকে হয়ত জরুরি বিভাগ বা মর্গে দেখতে পাবেন। কিন্তু তা হয়নি।

মুস্তাফাবাদে নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন গাজিয়াবাদের এক কলেজ শিক্ষার্থী। যিনি পরীক্ষা দিতে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরেননি। মানসি গুপ্তার স্বজনরা তার ছবি হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে সন্ধান চেয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।

২০ বছরের ওই শিক্ষার্থীর চাচা বিপিন গোয়াল জানান, পরিস্থিতি এখনও উত্তেজনাপূর্ণ। তিনি বলেন, সোমবার আমার ভাতিজি শ্যামলাল কলেজে পরীক্ষা দিতে আসে। সে খোড়াতে থাকে, কিন্তু তার বোন থাকে শিব বিহারে। সোমবার সে মুস্তাফাবাদে নানাকে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানে সে পৌঁছায়নি। শুরুতে মনে করেছিলাম হয়ত সে নানাকে দেখতে যায়নি। কিন্তু এরপর থেকে তার খোঁজ পাচ্ছি না।

নিখোঁজের পরিবারের সদস্যরা জানান, দ্রুতই তারা পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। কিন্তু তারাও খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। গোয়াল বলেন, গোকুলপুরি পুলিশ স্টেশনে আমরা যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কারফিউয়ের জন্য যেতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত আমরা গাজিয়াবাদে যাই। স্বজনরা জানান, ওইদিন থেকে বারবার মানসির ফোনে কল করা হচ্ছে কিন্তু তা বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
মুস্তাফাবাদের ২৫ ফোটা রোডের বিক্রেতা হামজা গিয়াসুদ্দিন আনসারি (২৫) বুধবার থেকে নিখোঁজ। তার এক আত্মীয় আনসারি আরিফ বলেন, আমার শ্যালক ও আমি সন্ধ্যায় নামাজ পড়তে যাই। পরে এক বন্ধুর দোকানে গিয়ে বসি। কিছু কাজের জন্য আমি বাসায় চলে আসি। কিন্তু আনসারি আর আসেনি। আমরা গোকুলপুরি থানায় গিয়েছিলাম, তারা আমাদের কথা শুনতেই চায়নি। আল-হিন্দ হাসপাতালের জরুরি সেবায় ফোন করেছি কিন্তু কোনও সাড়া পাইনি। অন্য হাসপাতালগুলোও খোঁজে দেখেছি, সেগুলোতেও পাওয়া যায়নি।

আনসারির পরিবারের আরেক সদস্য পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তারা আনসারির ছবি ও বিস্তারিত তথ্য দিয়ে একটি পোস্টার বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনও খবর পাওয়া যায়নি।

২৮ নিহতের পরিচয় প্রকাশ : অধিকাংশই মুসলিম
দিল্লিতে সহিংসতায় নিহত ৪৩ জনের মধ্যে ২৮ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। জিটিবি হাসপাতাল ও বার্তা সংস্থা পিটিআই’র তথ্যের বরাতে এ তালিকা প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যার। শুক্রবার পর্যন্ত ৪২ জন নিহতের পাশাপাশি দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। সহিংসতায় নিহতদের পরিচয় : ১। মোবারক হোসেন, বাবরপুর এলাকার বাসিন্দা। বয়স ২৮ বছর। বিজয় পার্ক এলাকায় বুকে গুলিবিদ্ধ। আদি নিবাস বিহারের দর্বাঙ্গা এলাকায়। দিল্লিতে দিনমজুরের কাজ করতেন। ২। শহীদ খান আলভি, ২২ বছর বয়সী অটোরিকশাচালক। ভজনপুর দরগাহ এলাকায় পেটে গুলিবিদ্ধ। ৩। মুদাসছির খান, অটোরিকশা চালক ও কারদামপুরি এলাকার বাসিন্দা। পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু। ৪। নাজিম খান, ৩৫ বছরের ভাঙারি ব্যাপারি। গুলিবিদ্ধ। ৫। মোহাম্মদ ফুরকান, জাফরাবাদের ভনপুরা এলাকায় খাবার কিনতে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হন ৩০ বছরের এই ব্যক্তি। ৬। মেহতাব, ব্রিজপুরি এলাকার ২২ বছরের এই বাসিন্দাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। ৭। রতন লাল, দিল্লি পুলিশের একজন হেড কনস্টেবল। গোকুলপুরি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন ৪২ বছরের এই ব্যক্তি। ৮। রাহুল সোলাঙ্কি, শিব বিহারের কাছে বাবু নগর এলাকার বাসিন্দা। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। দুধ কিনতে বের হয়ে ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ৯। অঙ্কিত শর্মা, ২৬ বছরের এই ব্যক্তি নিরাপত্তা সহকারী হিসেবে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোতে কর্মরত ছিলেন। তিনি খাজুরি খাস এলাকার বাসিন্দা। চাঁদবাগের একটি নর্দমায় তার লাশ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ১০। বিনোদ কুমার, ৪৫ বছরের এই ব্যক্তিকে বাড়ি ফেরার পথে ব্রাহমপুরিতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ১১। বির ভান সিং, ৪৮ বছরের এই ব্যক্তি খাবার আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। ১২। আশফাক হোসেন, মুস্তাফাবাদে ৩৪ বছরের ইলেক্ট্রিশিয়ানের শরীরে পাঁচটি গুলি লেগেছে। আল হিন্দ হাসপাতালে তার লাশ রাখা আছে। ১৩। দীপক, ৩৪ বছরের মান্দোলির বাসিন্দা। পেটে ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। ১৪। ইশাক খান, ২৪ বছর বয়সী এই ব্যক্তি কবির নগর এলাকায় বাস করতেন। মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। ১৫। শান মোহাম্মদ, বয়স ৩৪ বছর। লোনি এলাকার এই বাসিন্দাও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। ১৬। প্রভেশ, মৌজপুর এলাকার ৪৮ বছরের এই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। ১৭। জাকির, মুস্তাফাবাদের ২৪ বছরের এই যুবকের শরীরে একাধিক ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। ১৮। দিলবার, জিটিভি হাসপাতাল তার বয়স ও আহত হওয়ার স্থান উল্লেখ করেনি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে। ১৯। রাহুল ঠাকুর, হাসপাতালের তথ্য অনুসারে ব্রিজপুরি এলাকার ২৩ বছরের এই যুবকের মৃত্যু হয়েছে ‘হামলায়’। ২০। আমান, ধারণা করা হচ্ছে নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী। বয়স মাত্র ১৭ বছর। ২১। মারুফ, বয়স ৩২ বছর। ২২। সালমান, বয়স ও স্থান অজ্ঞাত। ২৩। ফায়জান, বয়স ২৪ বছর।২৪। অলোক তিওয়ারি, বয়স ৩৪ বছর। ২৫। ইরফান, বয়স ২৫ বছর। ২৬। বাব্বু, বয়স ৩২ বছর। ২৭। আকবরি, ৮৫ বছরের বৃদ্ধ খাজুরি খাস এলাকার গামরি গ্রামের বাসিন্দা। ২৮। আইয়ুব সাব্বির, ৬০ বছর বয়সী ভাঙারি ব্যাপারি।

নালা থেকে উদ্ধার হচ্ছে লাশ
দিল্লি পুলিশ বলছে, এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের মধ্যে নিহত ১৩ জনের শরীরে গুলি লেগেছিল, ২২ জনের শরীরে জখমের চিহ্ন রয়েছে। দিল্লি পুলিশের মুখপাত্র মানদিপ সিং জানিয়েছেন, ফরেনসিক টিমকে ডাকা হয়েছে এবং ঘটনাস্থলগুলো পুনরায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। নিহতের ঘটনায় ২৫টি মামলা হয়েছে অস্ত্র আইনে। তদন্ত শুরু হয়েছে। আমরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ এবং অন্যান্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করছি।

১৩ হাজার ২শ’ ফোনকলেও সাড়া দেয়নি দিল্লি পুলিশ
অশান্ত দিল্লিতে গত রোববার থেকে চারদিন ধরে সহিংসতা চলাকালে দিল্লি পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়ে ১৩,২০০ ফোন এসেছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তারা এতে সাড়া দেয়নি। এ খবর জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভি। জানা যায়, দিল্লিতে গত চারদিন সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালে শহরের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে এসেছে বিপুল সংখ্যাক ফোন। গত রোববার ৭০০টি, সোমবার ৩,৫০০ এবং মঙ্গলবার এসেছিলো সর্বোচ্চ ৭,৫০০ ফোন। এরপর বুধবার তা কমে যায়, ওইদিন এসেছিল ১,৫০০ ফোন। ফোনের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায় কবে থেকে হিংসা শুরু হয়ে তা চরম আকার নিয়ে আবার কমে যায়।

এনডিটিভি অন্তত দু’টি দাঙ্গা আক্রান্ত এলাকার থানার কল রেজিস্ট্রার খতিয়ে দেখেছে। যমুনা বিহার অঞ্চল, যেখানে হিংসার থাবা পড়েছিল প্রবলভাবে, সেকানকার ভজনপুরা থানায় এক পুলিশ কর্মকর্তা এনডিটিভিকে বলেন, তারা ২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৩,০০০-৩,৫০০ ফোন পেয়েছেন। পরে সংবাদমাধ্যমটি পুলিশের রেজিস্ট্রার খাতার আট পাতা পর্যবেক্ষণ করে দেখেন। ওই আট পাতায় ন’টি শ্রেণিতে খুঁটিয়ে লেখা, কখন ফোন এসেছে এবং সেই ফোনের প্রতিক্রিয়ায় কী পদক্ষেপ করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে পদক্ষেপের ঘরটি ফাঁকা। অর্থাৎ এসব ফোনকলে সাড়া দেয়নি দিল্লি পুলিশ। যমুনা বিহারের এক বিজেপি কাউন্সিলর প্রমোদ গুপ্তা জানিয়েছেন, তিনিও থানায় একাধিকবার ফোন করেছিলেন। কিন্তু থানা ফোন ধরেনি। তিনি বলেন, ‘পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যদি পারত, তাহলে এসব ঘটতে পারত না।’ শিব বিহারের কাছাকাছি অবস্থিত রাজধানী পাবলিক স্কুলে ৬০ ঘণ্টা ধরে তান্ডব চালায় দাঙ্গাবাজরা। ওই স্কুলের মালিক ফয়জল শেখ জানান, সোমবার দুপুর ২টা নাগাদ সব ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মীরা চলে গেলে ৪-৫টা নাগাদ ওরা হামলা চালিয়েছিল। আমরা পুলিশকে যখনই ফোন করেছি থানা জানিয়েছে, ‘আমরা আসছি।’ কিন্তু ওরা আর আসেনি। শিব বিহার কারাওয়াল নগর থানার অন্তর্গত। সেখানকার ফোনের হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে সোমবার ৩টা ৪৫ মিনিটে থানায় দু’বার ফোন করে স্কুলে হামলা চালানোর কথা জানানো হয়। কিন্তু পদক্ষেপ গ্রহণের জায়গায় এখনও লেখা ‘পেন্ডিং’। সূত্র : বিবিসি বাংলা, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এনডিটিভি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সহিংসতা

৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ