পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঢাকায় প্রতিদিন যানজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিশেষ করে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিপণিবিতান প্রভৃতি জায়গায় যাতায়াত করা এক দুঃসহ যন্ত্রণা। যানজটের কারণে কেবল রাজধানীতে প্রতিদিন বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আয় নষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে যানজটের কারণে দিনে আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহন প্রতিদিন যানজটের কারণে প্রায় সাড়ে ৭ ঘণ্টা আটকে থাকে। তাতে শ্রমঘণ্টা অপচয়জনিত জাতীয় উৎপাদনশীলতার ক্ষতি হচ্ছে। তাহলে এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
রাজধানীর যানজট কমাতে যেসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, কোনটাই কাজে লাগছে না। বরং, আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে যানজট কমানোর ছোট উদ্যোগে জট অল্প বাড়ে, মস্ত উদ্যোগে দ্বিগুণ বাড়ে। যানজট সমস্যা মোকাবিলায় এর আগেও অনেক উদ্যোগের বাস্তবায়ন করেছে কর্তৃপক্ষ। দিনের বেলা শহরে ট্রাক ও আন্তঃনগর বাসের প্রবেশ বন্ধ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় রেলওয়ে স্টেশনটা রাজধানী শহরের মধ্যে হওয়ায় রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে অনেক ব্যস্ত রাস্তা একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে বন্ধ থাকে, ফলে ট্রেন চলাচলের সময় বদলানো হয়েছে। বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলা বন্ধ করা হয়েছে। পথচারী পারাপারের জন্য রাস্তায় যে জেব্রা ক্রসিং ছিল সেগুলা বাতিল করে ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস তৈরি করা হয়েছে। ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি চালু করা হয়েছে। সর্বশেষ সিসি ক্যামেরাও বসানো হয়েছে। তাহলে কেন যানজট কমছে না?
রাস্তায় আইন মানছি না আমরা। যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করানো, ফুটপাত দখল, কম গতি, বেশি গতির পরিবহন সমানতালে চলা আর পরিবহন আধিক্যের কারণে সড়কে যানজট বেশি লাগে। এর মধ্যে প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নামছে প্রায় ২০০ বিভিন্ন ধরনের নতুন পরিবহন। ২০৩০ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা হবে ৩০ কোটি। এ প্রেক্ষাপটে যানজট নিরসনে উদ্যোগ নেয়ার সময় এখনই। রাজধানী ঢাকাকে সবার জন্য বসবাসের উপযোগী করতে হলে যথাযথ সুদ‚রপ্রসারী ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। যানবাহন এবং যানজট যে শহরের সচলতা শুধু কমিয়ে দিচ্ছে তাই নয়, আর্থিক ক্ষেত্রেও আঘাত হানছে। এখন যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা শহর, সে পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে এ শহর অচল হয়ে পড়বে।
আমাদের যতটুকু সড়কপথ আছে তাতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানাবিধ পদক্ষেপ নিলে যানজট ৮০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশ্বের বড় বড় শহর এমনকি হজের সময় মক্কা, মদিনা কিংবা অলিম্পিক গেমসহ নানা বড় আসরের সময় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সে সময় কত সহজেই না যানজট নিয়ন্ত্রণ করছে সংশিষ্ট দেশগুলো। চীনে যখন অলিম্পিকের মতো বড় আসর হলো তখন কর্তৃপক্ষ একদিন পর পর জোড়-বেজোড় নাম্বারের প্রাইভেট গাড়িগুলো চলাচল করার অনুমতি দিয়ে নতুন কৌশল বের করেছিল। এক দিন জোড় সংখ্যার গাড়িগুলো রাস্তায় চলার অনুমতি পেয়েছে তো পরদিন দিয়েছে বেজোড় সংখ্যার গাড়িগুলো। বিশেষ মুহ‚র্তগুলোতে বাইরের শহরের গাড়িগুলো শহরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়নি। সে ক্ষেত্রে আগে থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে পত্রিকায় ঘোষণা দেয়া হয়, ফলে দুর্ভোগ হয় না, হয় না যানজটও। জোড়-বেজোড় নাম্বারের গাড়িগুলো আমাদের রাজধানীতেও একদিন পরপর চলাচল করতে দেয়া যেতে পারে। ঢাকা মহানগীরর যানজট, পার্কিং সমস্যা, পরিবেশদূষণ ও জনদুর্ভোগের পরিপ্রেক্ষিতে আশু করণীয় হলো পার্কিং চাহিদা নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, বিনামূল্যে পার্কিং বন্ধ করা এবং অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য জরিমানার ব্যবস্থা করা, সর্বত্র জায়গা ও সময়ের মূল্যানুসারে পার্কিং ফি নেয়া, পার্কিং থেকে প্রাপ্ত অর্থ পাবলিক পরিবহনের মানোন্নয়নে ব্যয় করা। নগরের ব্যস্ততম এলাকায় প্রাইভেট কার চলাচলের ক্ষেত্রে কনজেশন চার্জ গ্রহণ করা, প্রাইভেট কারের লাইসেন্স সীমিত করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে প্রাইভেট গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক পরিবহনের ব্যবস্থা করা, প্রাইভেট গাড়িনির্ভর অবকাঠামো (ফ্লাইওভার, পার্কিংয়ের স্থান তৈরি) নির্মাণ না করা। পাবলিক পরিবহন ও পথচারীদের সুবিধা বৃদ্ধি করা। জায়গা ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা ও প্রাইভেট কারের পার্কিং সমস্যা সমাধানে পার্কিংয়ের জন্য সময় ও স্থান অনুসারে অর্থ গ্রহণই যুক্তিযুক্ত।
ফিলিপাইনে একসময় তীব্র যানজট ছিলো। সেখানে স্বাভাবিক চলাচল ছিলো কষ্টসাধ্য। যতদূর জানি সেখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থা এখন বেশ নিয়ন্ত্রিত। কীভাবে? ভালো একটি আইন তৈরি হয়েছে ফিলিপাইনে। ফিলিপাইনের আইন অনুসারে সেখানে কোনো গাড়ির লাইসেন্স নাম্বার প্লেটের অক্ষরটা যদি ১ অথবা ২ দিয়ে শেষ হয়, তবে সেই গাড়িটি রাস্তায় সোমবারে থাকার অনুমতি পাবে না। আবার যদি সেটা ৩ বা ৪ দিয়ে শেষ হয় তাহলে মঙ্গলবার গাড়িটাকে থাকতে হবে ঘরেই। ৫ ও ৬ যাঁদের গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের শেষ অক্ষর, তাঁরা তাঁদের গাড়ি নিয়ে বেরোবেন না বুধবার। বৃহস্পতিবারে রাস্তায় থাকবে না সেসব গাড়ি, যেগুলোর লাইসেন্স প্লেটের শেষে রয়েছে ৭ ও ৮। আর ৯ ও ০ যাঁদের গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের শেষ নম্বর, তাঁরা বাড়িতেই থাকেন শুক্রবারে। ফিলিপাইনের এই আইনটা যে নতুন পরিকল্পনাটা দিল, তা কি কাজ দেবে এই বাংলাদেশে?
রাজধানী ঢাকায় যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, অতিরিক্ত প্রাইভেট কারের উপস্থিতি। রাস্তার যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাইভেটকার। কোন কোন পরিবারের ৩/৪টি প্রাইভেট কার রয়েছে। কোন কোন সময় দেখা যায়, কার ড্রাইভারও একজন যাত্রী। রোড লাইসেন্স দেওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ এই সব বিবেচনায় আনে বলে মনে হয় না। একটি রিপোর্টে দেখা যায় যে, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪.২ শতাংশ জায়গা দখলে রাখে প্রাইভেট কার। প্রশ্ন জাগে, প্রাইভেট কারের সংখ্যাধিক্যের কারণ কী? একটি পরিসংখ্যান মতে গত দশ বছরে শুধু রাজধানীতে যানবাহন রেড়েছে দুই লাখ বার হাজার একশত তিনটি। ট্রাফিক অব্যবস্থাপনাও যানজটের কারণ। ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যালের তোয়াক্কা না করে একই পয়েন্টে আধাঘণ্টা পর্যন্ত একদিকের যান বাহন আটকে রাখে। অনেক সময় অটো সিগন্যাল বাতিতে যানবাহন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। সবুজ বাতির বদলে ট্রাফিক পুলিশের হাত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা পুলিশ সার্জেন্টের ক্ষমতার অপব্যবহার নয় কি?
ট্র্যাফিক বিভাগের হিসাব মতে, সেই সড়কের কম করে হলেও ৩০ ভাগ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং নানা ধরনের দখলদারদের হােেত। এছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই পায়ে হেঁটে চলেন নগরবাসী। ফলে যানজটের সঙ্গে আছে জনজট। আরেকটি মজার হিসাবও আছে। ঢাকায় ১৫ ভাগ যাত্রী দখল করে আছেন মোট সড়কের ৭০ ভাগ। কীভাবে? স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট এসটিপি-র হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় কমবেশি ১৫ ভাগ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন। এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা। বাকি ৮৫ ভাগ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পান। এটা দেখবে কে?
যানজট রাজধানীর নগর জীবনকেই শুধু বিপর্যস্ত করে তুলছে, তা নয়, ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য হিসেবেও পরিচিতি এনে দিয়েছে। যানজট সমস্যার সমাধানে আরো বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। এ নির্মাণ কাজের জন্য ব্যস্ত সড়কের একাংশ ব্যবহৃত হওয়ায় ধারে কাছের সব সড়কে যানজট অনিবার্য হয়ে উঠছে। নির্মাণ কাজের শম্বুকগতি মানুষের ভোগান্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করছে। যানজটে এমনই অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে যে, আধাঘণ্টা দূরত্বের সড়ক অতিক্রম করতে গড়ে ৭-৮ গুণ পর্যন্ত সময় লাগছে। বলা হয়, রিকশার পাশাপাশি প্রাইভেট কারের আধিক্য অচলাবস্থার সৃষ্টি করছে। তবে অভিজ্ঞজনদের মন্তব্য, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা যানজটের জন্য প্রধানত দায়ী। ঢাকার রাজপথের এক বড় অংশ অবৈধ দখলদারদের দখলে চলে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবৈধ দখলদারিত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক টাউট, পাড়া-মহলার মস্তান এবং পুলিশের সম্পর্ক থাকায় রাজধানীর সড়কগুলো দখলমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীর সড়ক ও ফুটপাত থেকে অবৈধ দোকানপাট উঠিয়ে দেয়া সম্ভব হলে যানজট এমনিতেই সহনীয় হয়ে উঠবে। এর পাশাপাশি কঠোরভাবে ট্রাফিক আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হলে যানজটের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হবে।
যানজটের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রেরিয়ে আসা সময়ের দাবি। সরকারকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে যাতে জনগণ এই দুর্ভোগ থেকে রেহাই পায়। এই সমস্যার সমাধান কল্পে কয়েকটি প্রস্তাব যা বাস্তবায়ন হলে যানজটের সমস্যা থেকে ঢাকাবাসী মুক্তি পেতে পারেন। (১) বিশ্বের যেসব শহরে আগে যানজট ছিলো এখন নিয়ন্ত্রিত তাদের পদক্ষেপ ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো। (২) সরকার যানজট সমস্যা নিরসনে দেশী ও বিদেশী সদস্যের সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করতে পারে। এই কমিশন যানজটের প্রকৃত কারণ নির্ণয়সহ সমাধানের পরামর্শ দিতে ও প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দেবে। (৩) রাজধানী ঢাকার প্রাইভেটকারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ীর সংখ্যাধিক্য যানজটের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য হয়। (৫) অবৈধ দখলদারদের নিকট থেকে ফুটপাথ ও অন্যান্য রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে। (৫) রেল ক্রসিংগুলোতে ওভারব্রিজ তৈরি করলে যানজট অনেকাংশে নিরসিত হবে। (৬) গাড়ির চালককে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। যত্রতত্র গাড়ী পার্ক করা ও গাড়ি ঘোরানো থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করতে হবে। (৭) রাজধানীতে সৎ, পরিশ্রমি এবং সাহসী ট্রাফিক পুলিশ অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। (৮) সরকার যানজট নিরসনের বিষয়ে অধিক মনোযোগী হবে।
পরিশেষে বলব, অবৈধ গাড়ি পার্কিং, ফুটপাত দখল করে রাস্তা সঙ্কীর্ণ করা থেকে জনগণকে বিরত রাখতে হবে। নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। জনগণের স্বার্থে যানজট নিরসনে অচিরেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, এটাই প্রত্যাশিত।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।