পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঢাকার জমিদার নবাব আবদুল গনী (১৮১৩-১৮৯৬) তার জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা আহসানউল্লাহ (১৮০৪-১৯০১) কে জমিদারী পরিচালনার দায়িত্ব দেন ১৮৮৬ সালে। আহসানউল্লাহ ১৮৭০ সালে জমি দান করলে ১৮৭১ সালে সেই জমিতে হাজী মুহাম্মদ মহসীন ফান্ডের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মাদ্রাসা। ঢাকার নবাব জমি দান না করলে ঢাকা মাদ্রাসা সেদিন প্রতিষ্ঠিত হতো না। নবাব আবদুল গনীর ইন্তেকালের পর নিয়ম মতে জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা আহসানউল্লাহ ১৮৮৬ সালে নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। পিতার মতো তিনিও জনহিতকর কাজে বিপুল অর্থ দান করেন। ১৯০১ সালে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করে নবাব আহসানউল্লাহ ঢাকা শহরে সর্বপ্রথম বিজলী বাতির ব্যবস্থা করেন। জনহিতৈষী ও শিক্ষানুরাগী নবাব আহসানউল্লাহ ১৯০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। এরপর নবাবের জ্যেষ্ঠ পুত্র ১৮৭১ সালে জন্মগ্রহণকারী খাজা সলিমুল্লাহ নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনিও তার পিতার মতই ছিলেন দানশীল ও শিক্ষানুরাগী। নবাব হবার পরই তিনি নিজের দান করা জমিতে নগদ এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা ব্যয় করে ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল। এটিই ছিল তৎকালীন পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের প্রথম কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাবে কর্তৃপক্ষ স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল নামকরণ করে। ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ সরকার স্কুলটিকে উন্নীত করে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে। ১৯৬২ সালে মুসলিম লীগ সরকারের শাসনামলে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করে নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি বা পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীন বাংলাদেশে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি বা বুয়েট। মুসলিম লীগ সরকার ১৯৬২ সালে প্রদেশের নামে না করলে হয়ত বুয়েট আজো আহসানউল্লাহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নামেই পরিচিত থাকতো।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন শাসক, ২৪ বছর বয়সী নবাব সিরাজউদ্দৌলাহকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলা দখল করে ব্রিটিশ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্ণধার লর্ড কøাইভ। এরপর বর্ণ হিন্দুদের সমর্থন ও সহযোগিতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংরেজবিরোধী বাংলার মুসলমানদের সর্বদিক থেকে বঞ্চিত ও শোষণ করে নিঃস্ব ও দরিদ্র জনগোষ্ঠিতে পরিণত করে। মুসলমানরা পলাশী যুদ্ধের একশত বছরের মধ্যে নব্য হিন্দু জমিদারদের ভূমিদাসে পরিণত হয়। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বৃহৎ বাংলাকে ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠন করেন ভাইসরয় লর্ড কার্জন। ঢাকা হয় নতুন প্রদেশের রাজধানী। নতুন প্রদেশ গঠিত হবার পর কলিকাতার পশ্চাদভূমি পূর্ববঙ্গ ও আসামের পশ্চাৎপদ, বঞ্চিত ও শোষিত মুসলমানদের উন্নতির রুদ্ধ দরজাটি উন্মুক্ত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয় বর্ণবাদী হিন্দু সমাজ। পূর্ব বঙ্গের কলিকাতা প্রবাসী জমিদার, ব্যবসায়ী, আইনজীবী তথা শিক্ষিত হিন্দু সমাজ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ রহিত করণের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। বঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।
ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন প্রদেশ গঠিত হবার পর নবাব সলিমুল্লাহর দায়িত্ব ও গুরুত্ব বেড়ে যায়। তিনি যথার্থভাবেই উপলব্ধি করেন যে, নতুন প্রদেশের নেতৃত্বে নিতে হলে পূর্ব বঙ্গের পশ্চাৎপদ মুসলমানদের শিক্ষিত হতেই হবে এবং বর্ণবাদী হিন্দুদের বিরোধিতাকে মোকাবেলা করে নতুন প্রদেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে কংগ্রেসের মতো একটি রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। এই উদ্দেশ্য সফল করতে প্রথমেই নবাব সলিমুল্লাহ শিক্ষা বিস্তারে মনোযোগী হন। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক তথা ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে উত্তর প্রদেশের আলীগড়ে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ১৮৮৬ সালে গঠন করেন ‘অল ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স।’ এর অনুকরণে নবাব সলিমুল্লাহ গঠন করেন, ‘ইস্ট বেঙ্গল এন্ড আসাম মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স।’ এর সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ ও সম্পাদক ছিলেন ধনবাড়ীর জমিদার নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। ১৯০৬ সালের ১৪ ও ১৫ এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে নবাব সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় এই সমিতির প্রথম অধিবেশন। সভাপতির ভাষণে নবাব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করেন এবং তিনি বিভিন্ন পেশার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাঠ্যসূচি প্রণয়নের পরামর্শ সহ শ্রেণিভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করার প্রস্তাব করেন। এই সম্মেলনে শিক্ষা বিষয়ক বিশটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তন্মধ্যে ঢাকা কলেেেজর মুসলিম শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাসের জন্য নবাব সলিমুল্লাহ এক লক্ষ ছিচল্লিশ হাজার টাকা এবং নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী পঁয়ত্রিশ হাজার একশত পঞ্চাশ টাকা দানের কথা ঘোষণা করেন। অপর এক প্রস্তাব মতে সভায় মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের জন্য নবাব সলিমুল্লাহকে চেয়ারম্যান ও শামসুল উলামা আবু নসর ওহীদকে সম্পাদক করে ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি উপ-কমিটি গঠন করেন।
নতুন প্রদেশের পশ্চাৎপদ মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুসলিম জনগোষ্ঠির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবিগুলো তুলে ধরার জন্য বাংলার মুসলমানদের নেতা নবাব সলিমুল্লাহ গঠন করেন মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন। এটাই ছিল বাঙালি মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রবর্তী অবস্থানে ছিল কলিকাতা কেন্দ্রিক জমিদার শ্রেণি। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী যখন বঙ্গভঙ্গ রহিতকরণ আন্দোলনে যুক্ত হলেন তখন তা হিন্দুদের সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। ফলে নতুন প্রদেশের পক্ষে সর্ব ভারতীয় মুসলমানদের সমর্থন পাওয়ার জন্য নবাব সলিমুল্লাহ তার চিন্তা-ভাবনা ও কর্ম তৎপরতাকে প্রদেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নবাবের পরিকল্পনার একটি অংশ পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশসহ ভারতে মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে সুসংগঠিত হওয়া আর অপর অংশটি হলো হিন্দুত্ববাদী কংগ্রেসকে মোকাবেলার জন্য সর্বভারতীয় একটি রাজনৈতিক দলের পতাকাতলে ভারতীয় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা। এই দুটি লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে নবাব সলিমুল্লাহ সমিতির সেক্রেটারি নবাব মুহসিন-উল-মূলককে ‘অল-ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের’ বিশতম বার্ষিক অধিবেশন ঢাকায় আহবান করার অনুরোধ করেন। বাংলায় এই কনফারেন্সের ১৩তম অধিবেশন হয়েছিল ১৮৯৯ সালে কলিকাতায় বিচারপতি স্যার সৈয়দ আমির আলীর সভাপতিত্বে।
নবাব মুহসিন-উল-মূলক সম্মতি জানালে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও তরুণ আইনজীবী এ. কে. ফজলুল হকের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকার শাহবাগের পারিবারিক বাগান বাড়ী ইশরাত মঞ্জিলে (বর্তমান মধুর ক্যান্টিন) ১৯০৬ সালের ২৭-২৮-২৯ ডিসেম্বর আয়োজন করেন অল ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের বিশতম অধিবেশন। এতে সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি শরফুদ্দিন। সর্বভারত থেকে প্রায় ১৫০০ বিশিষ্ট মুসলিম প্রতিনিধি ও ৫০০ মেহমান নিয়ে মোট ২০০০ছিল উপস্থিতি। এই মহাসম্মেলনে ব্যয় হয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। মেজবান হিসাবে নবাব সলিমুল্লাহ একাই এই ব্যয় বহন করেন। ১৯০৬ সালে ঢাকায় কোনো আবাসিক হোটেল ছিল না। ডিসেম্বরের কনকনে ঠাÐায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বিশিষ্ট, বনেদী ও সম্মানিত মেহমানদের থাকার আরামদায়ক ব্যবস্থা নবাব সলিমুল্লাহ সেদিন কীভাবে করেছেন, তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
সম্মেলনে এতো অধিক সংখ্যক বিশিষ্টজন উপস্থিত হওয়ায় নবাব সলিমুল্লাহ দ্বিতীয় পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হন। শিক্ষা সম্মেলন শেষে সলিমুল্লাহর অনুরোধে নেতৃবৃন্দ ৩০ ডিসেম্বর এক বিশেষ অধিবেশনে হাজির হন। নবাব ভিখার-উল-মূলক এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনে নবাব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনের প্রস্তাব করলে দিল্লির হাকিম আজমল খান তা সমর্থন করেন। ফলে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার জন্য মুসলিম জাতিসত্ত¡ার আদর্শ নিয়ে মুসলিম বিশ্বের প্রথম সাংগঠনিক রাজনৈতিক দল। ঢাকায় শিক্ষা সম্মেলন ও মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে প্রাদেশিক গÐি পেরিয়ে নবাব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের নেতার পদে নিজেকে উন্নীত করেন। ফলে বিরোধী শিবিরে তিনি পরিণত হন বিরোধিতার লক্ষ্যবস্তুতে।
বাংলার হিন্দু সমাজ ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতার কাছে নতি স্বীকার করে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবার হলে বঙ্গভঙ্গ রহিত করার ঘোষণা দেন। ফলে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারায়। অখÐ বাংলার রাজধানী হয় পূর্বের মতো কলিকাতা। আর বঙ্গভঙ্গ রহিতকরণের বিনিময়ে বাংলার হিন্দু বাবুরা ভারতের রাজধানী কলিকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরে সম্মতি দেয়।
বঙ্গভঙ্গ রহিত হবার পর পূর্ব বাংলার মুসলমানদের এবং নবাব সলিমুল্লাহর মনে সৃষ্ট ব্রিটিশদের প্রতি প্রকাশ্য ক্ষোভ এবং হিন্দুদের সম্পর্কে অবিশ্বাস প্রশমিত করতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন নবাব সলিমুল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে। ঐ দিনই একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল নিয়ে নবাব সলিমুল্লাহ ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাত করে মুসলমানদের বিভিন্ন দাবির সাথে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিটি পুনরায় উল্লেখ করেন। ক্ষুব্ধ নবাবকে শান্ত করতেই দুদিন পর ১৯১২ সালের ২ ফেব্রæয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এই ঘোষণার পরপরই বঙ্গভঙ্গ রহিত করার সদ্য সাফল্যে উজ্জীবিত হিন্দু নেতারা অনুরূপ আন্দোলন ও প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি ঘোষণাকে বাতিল করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। এই তৎপরতায় শামিল হন, কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জী। কলিকাতা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশালের হিন্দু নেতারা একাধিক প্রতিবাদ সভা করেন। কলিকাতার গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষ কয়েকজন হিন্দু নেতাসহ ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাত করে যে স্মারক লিপি প্রদান করেন তাতে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে আভ্যন্তরীনভাবে বঙ্গভঙ্গের সমতুল্য।’ এমন কয়েক ডজন স্মারকলিপি দেয়া হয়। এগুলোতে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে বাঙালি জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে, তাদের মধ্যে বিরোধের তীব্রতা বেড়ে যাবে।’ কোনো স্মারক লিপিতে বলা হয়, ‘পূর্ব বাংলার মুসলমানদের অধিকাংশই কৃষক, এই সকল চাষা-ভূষাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন নেই।’ অসাম্প্রদায়িক ও মানবহিতৈষী খেতাবে ভূষিত এই সকল বর্ণবাদী হিন্দু নেতাদের প্রবল বিরোধিতার পরও প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সাম্প্রদায়িক নামে অভিযুক্ত নবাব সলিমুল্লাহ নিজের প্রায় তিনশত বিঘা জমি দান করেন।
১৯০১ সালে নবাব হবার পর থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন জেলায় ছাত্রাবাস নির্মাণসহ জনহিতকর বিভিন্ন কাজে এবং দেশে বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অকাতরে অর্থ দান করে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে জমি দান করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নগদ অর্থ তিনি দান করতে পারেননি। এই অক্ষমতা ছিল দান করতে অভ্যস্ত নবাবের জন্য গভীর মর্মবেদনার। ১৯১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি শুক্রবার রাত ২.৩০ মিনিটে কলিকাতার ৫৩নং চৌরঙ্গী রোডস্থ নিজ বাসভবনে বাংলা তথা ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক পথ প্রদর্শক ঢাকার জমিদার নবাব সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার অকাল মৃত্যু আজো রহস্যাবৃত। কলিকাতা ও ঢাকায় একাধিক জানাজা শেষে ঢাকার বেগমবাজারস্থ নবাবদের কবরস্থানে ১৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়।
হিন্দু নেতা ও সমাজপতিদের বিরোধিতার পরও নবাব সলিমুল্লাহর ব্রেন চাইল্ড নামে খ্যাত শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এবং অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জমিদারীর অংশ বিক্রি করে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর দান করা আটত্রিশ হাজার টাকায় ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত করে পূর্ব পাকিস্তান ও ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশ করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। অথচ যার উদ্যোগে ও দান করা জমির উপর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত সেই নবাব সলিমুল্লাহর জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী আজ বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পালিত হয় না। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানেও সম্ভবত নবাব সলিমুল্লাহ উপেক্ষিতই থাকবেন।
লেখক: স্থায়ী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।