পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এবার ইরানি জেনারেলের রক্তে মার্কিনিদের হাত লাল হলো। গত শুক্রবার ভোরে ইরানিয়ান রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস্ বাহিনীর প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যা করার ২৪ ঘণ্টা পর ইরাকের রাজধানী বাগদাদে আমেরিকা ফের সশস্ত্র বিমান হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় ৬ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এই ৬ ব্যক্তি হলেন ইরান সমর্থিত সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠি পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটের (পিএমইউ) একটি গ্রুপ। হামলায় যে ৬ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে একজন শীর্ষ কমান্ডার রয়েছেন। আলজাজিরা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে চিকিৎসকও রয়েছেন। এর আগে শুক্রবার ভোরে কাসেম সোলাইমানির গাড়িবহরকে সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করে হামলা চালানো হয়। ধারণা করা হয় যে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আল খামেনির পরে নিহত কাসেম সোলাইমানির স্থান ছিলো। জেনারেল কাসেম একাই নিহত হয়নি, তার সাথে নিহত হয়েছেন আরও ৩ জন। এদের মধ্যে রয়েছেন হাশেম আল শাবি। মিডল ইস্ট নিউজ এজেন্সির খবরে বলা হয় যে, আল খামেনির পর ইরানে সোলাইমানির ক্ষমতাই ছিলো সবচেয়ে বেশি। গত ২৯ ডিসেম্বর আমেরিকা পিএমইউ এর ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ২৫ জনকে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে গত সোমবার পিএমইউ এর সদস্যরা মিছিল নিয়ে বাগদাদের গ্রিনজোনে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায়। এর পর আমেরিকা বাগদাদে আরও ৭৫০ জন সৈন্য মোতায়েন করে। অতঃপর সোলাইমানি ও পিএমইউ এর উপপ্রধানসহ আমেরিকা ৮ জনকে হত্যা করে। সোলাইমানি হত্যার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আল খামেনি ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের হুমকি দেন। তাঁর এই হুমকির ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাগদাদে ইরান সমর্থিত পিএমইউ এর ওপর হামলা চালানো হলো।
সর্বশেষ অবস্থায় দেখা যাচ্ছে যে, ইরানের প্রতিক্রিয়া আল খামেনির হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গত শনিবার ইরান সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। ঐ দিন ইরানের উত্তরে একাধিক জঙ্গী বিমানকে যুদ্ধের মহড়া নিতে দেখা যায়। ইরান যেভাবে জঙ্গী বিমান উড়াতে শুরু করেছে তার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের দাবানল জ¦লে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মার্কিন বর্বরতার বিরুদ্ধে ইরানে যে প্রতিশোধের প্রস্তুতি এবং রণদামামা শোনা যাচ্ছে, তার ফলে বিশে^র যে কোনো স্থানে মার্কিন স্থাপনায় হামলা হতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন নাগরিককে হত্যা করা হতে পারে বলে দেশি ও বিদেশি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা। হোয়াইট হাউজ এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে যে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ নির্দেশেই এই সব হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে। তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, জেনারেল সোলাইমানি বাগদাদে কর্মরত সিনিয়র মার্কিন কূটনীতিক এবং অফিসারদের হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তার এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধেই প্রিএম্পটিভ স্ট্রাইক হিসাবে কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। যদিও কাসেম সোলাইমানির ঐ তথাকথিত হত্যা পরিকল্পনার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নাই, অথবা এ সম্পর্কে পূর্বাহ্নে কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি।
॥দুই॥
ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের কুদস শাখার প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হলো কেনো এবং তাকে হত্যা করার জন্য এই সময়টাকেই বেছে নেওয়া হলো কেনো সেটা নিয়ে রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে তুমুল গবেষণা চলছে। তাৎক্ষণিকভাবে যে উত্তর আসছে, সেটা হলো এবছরে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে জয়লাভ করতে চান। চলতি বছরের নভেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩ বছর আগেই জয়লাভ করার পর থেকেই প্রচন্ড বিতর্কিত হয়েছেন। তাঁর জনপ্রিয়তায়ও ধ্বস নেমেছে। এছাড়া তাকে ইমপিচ বা অভিসংশন করা হচ্ছে। শীঘ্রই তার অভিসংশনের শুনানি হবে। এমনিতেই তাঁর জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি নির্বাচন হয় তাহলে ভরাডুবি অপরিহার্য। তার ডুবন্ত তরীকে তিনি আবার পানির ওপর আনার উপায় খুঁজছেন। এ ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তাঁর পূর্বসূরী বারাক ওবামার নিকট থেকে। বারাক ওবামা আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করেছিলেন এবং দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মার্কিন গোয়েন্দারা খবর পায় যে, লাদেন পাকিস্তানের অ্যাবোটোবাদের একটি বাড়িতে অবস্থান করছেন। অনেকেই সন্দেহ করেন যে, পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের কেউ ওসামার গোপন জায়গার খবর ফাঁস করে দেন। সেই খবরের ভিত্তিতে ‘নেভী সীল’ নামক মার্কিন কমান্ডো বাহিনী মধ্যরাতে অ্যাবোটোবাদে অভিযান চালায়। এক বা একাধিক হেলিকপ্টার নিয়ে লাদেনের আস্তানার ছাদে অবস্থান নিয়ে তারা লাদেনকে হত্যা করে এবং তার লাশ হেলিকপ্টারে বহন করে আরব সাগরের অথৈ জলরাশিতে নিক্ষেপ করে। ওসামা বিন লাদেনকে এভাবে হত্যা করায় মুসলিম জাহানে চাপা অসন্তোষ বিরাজ করলেও আমেরিকার জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। যেসব কারণে ওবামা দ্বিতীয় মেয়াদে জয়লাভ করেন, বিন লাদেন হত্যা তার অন্যতম।
॥তিন॥
বিন লাদেনের হত্যাকান্ডের ঘটনা সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকান্ডে উৎসাহ যুগিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এখানেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুল করেছেন। কারণ বিন লাদেন এবং জেনারেল সোলাইমানির তুলনা বা উদাহরণ এক নয়। বিন লাদেনের পেছনে সবল বা দুর্বল কোনো রাষ্ট্রশক্তি ছিলো না। মার্কিনিদের বিরুদ্ধে লাদেনের যুদ্ধকে কোনো কোনো গোষ্ঠি সমর্থন জানালেও সেটা ছিল নিরব। প্রকাশ্যে পৃথিবীর কেউ তাকে সমর্থন জানায়নি। অবশ্য তার সঙ্গত কারণও ছিলো। কারণ, তার পদ্ধতি ছিলো সন্ত্রাসী। তাই আমেরিকা তার বিশালতম রাষ্ট্রশক্তি নিয়ে লাদেন ও আল কায়েদার বিরুদ্ধে যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তার নাম দেয়, ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধও আবার আমেরিকা একা করেনি। ন্যাটো বাহিনীকে তার সাথে নিয়ে আল কায়েদার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
কিন্তু সোলইমানির ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, তার পেছনে আছে ইরানের মতো একটি শক্তি। ইরান এত বোকা নয় যে, আমেরিকার সাথে তারা সরাসরি যুদ্ধে যাবে। আমেরিকা এই ভূপৃষ্ঠে বিশে^র এক নম্বর পরাশক্তি। সুতরাং আমেরিকার সাথে ইরানের সন্মুখ সমরের কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তিসহ অনেক রাষ্ট্রই আমেরিকার এই হত্যাকান্ডের নিন্দা করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই হত্যাকান্ড নিঃসন্দেহে একটি সন্ত্রাস। যে সে সন্ত্রাস নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ইরান যে বদলা নেবে তার পেছনে প্রকাশ্যে সমর্থন না জানালেও তুরস্ক, মালয়েশিয়ার মতো শক্তির পরোক্ষ সমর্থন পাবে ইরান। আমেরিকা ইরানকে ধ্বংস করুক, সেটি গণচীন কখনও চাইতে পারে না। মালেয়িশয়ায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কয়েকটি ইসলামি রাষ্ট্রের শীর্ষ সম্মেলনে পাকিস্তান যেতে পারেনি, তার অর্থ এই নয় যে পাকিস্তান তাদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান দারুণ অর্থ সঙ্কটে পর্যুদস্ত। সেই অর্থ সঙ্কটে সউদী আরব ২০ বিলিয়ন সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে। সেই সাহায্য পাকিস্তান অস্বীকার করতে পারে না। সউদী আরবের প্রসারিত বন্ধুত্বের হাত গ্রহণ করতে গিয়ে পাকিস্তান ইরান, তুরস্ক এবং মালয়েশিয়ার মতো পরীক্ষিত বন্ধুদের পরিত্যাগ করবে না। তাই জেনারেল সোলাইমানি-সহ ৮ জনের ঠান্ডা মাথায় হত্যাকান্ড পাকিস্তানও হয়তো সমর্থন করবে না।
॥চার॥
আমেরিকার তুলনায় সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব না থাকলেও ইরানের হাতে রয়েছে একটি বড় অস্ত্র। আর সেটি হলো পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরের মধ্যবর্তী হুরমুজ প্রণালী। এই প্রণালী দিয়ে বিশে^র সমগ্র গ্যাস সম্পদের এক তৃতীয়াংশ এবং তেল সম্পদের এক চতুর্থাংশ পরিবাহিত হয়। এই প্রণালীটির নিয়ন্ত্রণ মোটামুটি ইরানের হাতে। এখানে যদি ইরান কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তা হলে বিশ^ বাজারে তেল এবং গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। ওপরের এই সামগ্রিক আলোচনার পর বলা যায় যে, জেনারেল সোলাইমানির হত্যার একটা বদলা হয়তো হবেই। তবে সেটা কোন পথে সেটি দেখা বা জানার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।