প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
অন্ধকার থাকতেই ঘুম ভেঙে গেল কামরান সাহেবের। অন্যদিনও ভাঙে। একই সময়ে, একই নিয়মে ফজরের আযানের ধ্বনিতে।
তিন তলার চিলে কোঠায় থাকেন বিখ্যাত সাংবাদিক কামরান হোসেন। পুরোন ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। নীচের দুই তলায় থাকে ছোট দুই ভাই স্ব-পরিবারে।
ছাত্র জীবনের অভ্যেস ওর খুব ভোরে ওঠা। একেবারে আযানের সাথে সাথে। তারপর নামাজ পড়ে সামনের বড় ছাদে যোগ ব্যায়াম করেন অনেকক্ষণ ধরে।
পঞ্চাশের কামরান সাহেবের সুঠাম, সজীব আর প্রাণবন্ত সৌন্দর্যের কথা অনেকেই আলোচনা করে।
অনেক মেয়ের চোখের ঘুম কেড়ে নেয়া কামরান আজ ঘুমাতে পারছিলেন না একেবারেই।
অনেক রাতে যাও আসলো তাও অল্পক্ষণের জন্যে।
আযানের আগেই ঘুম ভেঙে গেল আবার।
টেবিল ল্যাম্পটা তখনো জ্বলছে। ঘুম আসবার জন্যে একটা বই নিয়েছিলেন হাতে। চোখ লেগে আসায় বাতিটা আর নেভানো হয়নি।
বাইরের দিকে তাকালেন কামরান।
ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে।
বাতি নিভিয়ে পাশ ফিরলেন। একটু পর আবার জ্বালালেন বাতিটা।
বুকের ভেতরটায় কি যেন এক অস্থিরতা। গত কালকের ঘটনাটা কিছুতেই যেন ভুলতে পারছেন না তিনি। এরকম হওয়ার তো কোন কারণ নেই। উচিৎও নয়।
জীবনের প্রথম যৌবনের সন্ধিক্ষণ থেকে আজ পর্যন্ত বহু ঘাত-প্রতিঘাত, আর বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে বর্তমানে একটা স্থায়ী মঞ্চে এসে অবস্থান করছেন তিনি।
পুরোন ঢাকার এক চিলে কোঠায় তৈরি করেছেন আপন নিবাস।
মাঝারি আকারের ঘরটিতে রয়েছে বুক সেলফ ভর্তি বই আর পত্র-পত্রিকা। রয়েছে টিভি, ফ্রিজ, আর ক্যাসেট প্লেয়ার।
চমৎকার লোভনীয় একটা ঘর নিঃসন্দেহে।
পা বাড়ালেই চমৎকার একটা ছাদ। ঝুলন্ত বাগানের মতো একেবারে। নীচে থেকে উঠে এসেছে বিভিন্ন রং-এর বাগুন ভেলিয়ার ঝাড়।
এখানে দাঁড়িয়ে কামরান একটু একটু করে আঁধার কাটিয়ে ভোর হওয়া দেখেন। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বাদ বদলানো হাওয়ার স্পর্শ নেন।
প্রেস ক্লাবে এক লেখকের পুস্তক প্রকাশনা উৎসব শেষে বাইরে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছিলেন কামরান। অনুষ্ঠানের বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন তিনি। চমৎকার আর মূল্যবান বক্তব্যের জন্যে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সুখ্যাতি ছড়িয়েছে ওঁর। আজকেও সাহিত্য ও জীবন নিয়ে এতো সুন্দর বলেছেন তিনি যে সবাই খুব বিমোহিত হয়ে গিয়েছিল।
ওর চমৎকার সুঠাম সৌন্দর্য, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি নিঃসন্দেহে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মতো।
এমনি সময় পাশে এসে দাঁড়ালো এক তরুণী। বয়স ২৫ কি ২৬ হবে। কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ।
লম্বা বেনী।
বলল-
ঃ আপনি কি যাচ্ছেন?
কামরান একটু অবাক হয়ে বললেন-
ঃ আমাকে কিছু বলছেন?
মেয়েটি চোখে চোখ রেখে বলল-
ঃ জ্বী। এতো নাম শুনেছি আপনার ।
ঃ নাম ! হাসলেন কামরান-
ঃ সুনাম না দুর্নাম?
কিন্তু হাসলো না মেয়েটি।
বলল-
ঃ কার্ডে আপনার নাম দেখে আর একবার দেখতে এলাম।
ঃ দেখতে এলেন? আমাকে? রিয়েলী?
কামরান যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।
মেয়েটি বলল-
ঃ আমার নাম রুমানা। একটা কলেজে পড়াচ্ছি।
কামরান বললেন-
ঃ বেশ ভালো কথা। কিন্তু আমি তো এসব জানতে চাইনি।
ঃ চাননি। কিন্তু আমি জানালাম।
কামরান যেন একটু ভাবলেন।
তারপর বললেন-
ঃ ও আচ্ছা। কিন্তু আপনাকে এর আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। রুমানা বলল-
ঃ দেখেছেন। লক্ষ্য করেনি। প্রয়োজন হয়নি তাই। আমি আপনার সব অনুষ্ঠানেই যাই।
কামরান এবার গভীরভাবে দেখলেন রুমানাকে।
তারপর বললেন-
ঃ বা ! আপনি তো ভারী চমৎকার করে কথা বলতে পারেন।
রুমানা এর কোন উত্তর দিল না।
ছোট একটা ডাইরী মেলে ধরলো কামরানের সামনে।
ঃ বলল-
ঃ একটা অটোগ্রাফ দেবেন?
এবার যেন একটু অপ্রস্তুত হলেন কামরান-রুমানার চোখের দৃষ্টি আর কণ্ঠস্বরে।
বললেন-
ঃ অটোগ্রাফ ?
রুমানা বলল-
ঃ আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। আজ আপনার সাথে কথা বললাম। অটোগ্রাফটিও থাকবে আমার কাছে। প্লীজ-
কামরান তাকালেন রুমানার মুখের দিকে। তারপর একসময় ডাইরীটা হাতে নিয়ে লিখলেন- ‘শুভেচ্ছা রইলো-কামরান হোসেন।’
রুমানা বলল-
ঃ ধন্যবাদ। বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না।
ঃ না, না, মনে করবার কি আছে-
কামরানের কতা শেষ হবার আগেই রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল রুমানা। তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন কামরান।
এক বিস্মিত অনুভূতি যেন কিছুক্ষণের জন্যে আচ্ছন্ন করে রাখলো ওকে। কি স্পষ্ট আর দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েটির !
কি চমৎকার আত্ম পরিচিতির ধরন! কতো প্রাঞ্জল !
কামরান হোসেনের মতো অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ আর ঝানু সাংবাদিককে যেন ভাবিয়ে দিলে গেল।
জীবনের চলার পথে কতো মানুষ এসেছে গেছে। চুলে পাক ধরেছে। আজ এই অবেলায় কেন চিত্তের এই অস্থিরতা! যদিও কামরানের সমাধিস্থ বুকের ভেতরটা একেবারেই স্থবির বহু বছর থেকে। এখন আর কোন দক্ষিণা হাওয়া খুলে দেয় না আচমকা ভোরের দুয়ার। সংযত পরিমিত আর মার্জিত জীবন-যাপন ও কর্ম জগতের সুখ্যাতি কামরান হোসেনের জন্যে তৈরি করেছেন এক বিশেষ সম্মানিত আসন। সাংবাদিকতা জগতে যা সত্যি বিরল। দেশ বিদেশের রেডিও টিভিতেও আছে যার একটি আলাদা পরিচিতি।
বাড়ি ফিরে রুমানা নামের মেয়েটির কথা বারবার মনে পড়তে লাগলো কামরানের । বয়সে তাঁর অর্ধেক হবে মেয়েটি। উজ্জ্বল শ্যামলা, চমৎকার চোখ মুখের গড়ন। ব্যক্তিত্বময় চেহারা। রুচিশীল মার্জিত আচরণ। কথা বলার সেই ভঙ্গি-
‘এতো নাম শুনেছি আপনার-’
ঃ আশ্চর্য ! পাগল নাকি মেয়েটি!
নিজেকেই বার বার প্রশ্ন করলেন তিনি।
ছাদে পায়চারী করতে করতে নিজের মনকে বার বার শাসন করতে চেষ্টা করলেন কামরান। ছিঃ ছিঃ ! যে পাঠ চুকিয়ে দিয়ে মনের দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে বহু বছর আগে, সেখানে কেন আজ এই অনাহুত করাঘাত?
কেন জগদ্দল পাথরের দেয়াল কাঁপতে যাচ্ছে অজান্তে।
না, না এ হয় না।
এ হওয়া উচিত নয়।
কামরান সংসারে বাবা-মার তিক্ততা দেখেছে শৈশব থেকে। প্রায় খুঁটি-নাটি জিনিস নিয়ে লেগে যেতেন দু’জনে। কখনো কখনো একে অপরকে গালাগালি করতেন অকথ্য ভাষায়।
এক-একদিন স্কুল থেকে এসে এইসব দেখতেন কামরান।
ছোট তাই বোনগুলো এখানে সেখানে বসে কাঁদতো।
স্কুলের ব্যাগটা দাওয়ায় ফেলে রেখে বাইরে চলে যেতেন তিনি। খুব খারাপ লাগতো এইসব। বাড়িতে দূর সম্পর্কের এক চাচা থাকতো। খুব ফর্সা ছিলেন দেখতে। কাপড় পড়তেন খুব আটসাঁট করে। কথায় কথায় হাসতেন প্রচুর।
মানুষের গায়ে হাত দিয়ে কথা বলার অভ্যেস ছিল তার।
চাকরির খোঁজে ওদের বাড়িতে এসে সেই যে থেকেছেন-আর নড়বার নামও নেই।
বাবা ইশারা ইঙ্গিতে অনেকবার বলেছেন।
তবুও-
মায়ের সাথে চাচার সম্পর্কটা একেবারেই ভালো লাগতো না কামরানের।
বাবা যখন বাড়িতে থাকতেন না, কামরান বহুদিন দেখেছে, মাকে চাচার ঘর থেকে বের হতে।
এসবে অসহ্য হয়ে-না খেয়ে, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতেন কামরান। কিন্তু মাকে কিছু বলার সাহস হতো না।
কতোদিন ভেবেছে বাবাকে বলে দেবে চাচার কথা।
চাচা যেন অন্য কোথাও চলে যায়। কিন্তু বলার সুযোগ আর আসেনি ওর।
তার আগেই ওদের পাঁচ ভাই বোনকে রেখে ওই চাচার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন মা।
দু’বছরের চোট বোনটা খুব কেঁদেছিল সেদিন-
মায়ের ওপর অসম্ভব রাগ হলেও ছোট বোন মুন্নীর কথা ভেবে মায়ের ফিরে আসাটা খুব চাচ্ছিলেন কামরান।
সংসারের বড় সন্তান হয়ে ওই বয়সেই অনেক কিছু বুঝতে শিখেছিলেন তিনি। এক একদিন রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন কামরান।
কেন মা এমন করলেন?
চাচাকে নিয়েই না হয় এ বাড়িতে থাকতেন।
বই এ পড়েছে-‘মায়ের তুলনা নেই এ জগতে’।
কিন্তু এ কেমন মা ওর?
বই এ কি তাহলে মিথ্যে কথা লেখা আছে?
স্কুলের ছেলেরা নানা কথা বলে।
ক্লাস শেষ হলে মাথা নীচু করে বাড়ি ফিরে আসতে হয় তাকে।
মা চলে যাওয়ার পর থেকে বাবাকে কখনো হাসতে দেখেননি কামরান।
উদয়াস্ত্র পরিশ্রম করেছেন পাঁচটি ছেলেমেয়েকে মানুষ করবার জন্যে। (বাকি অংশ শুক্রবার সাহিত্যে)
বাড়ির বুড়ি দাইমার কাছেই থাকতো মুন্নী আর বুলা।
সব ভাই বোনদের খুব যতœ করতো সেই দাইমা।
ওই দাইমাকে একেক সময় মা ডাকতে ইচ্ছে করতো কামরানের।
সেই প্রথম সুন্দরী মেয়েদের ওপর থেকে মন বিষিয়ে উঠেছিল তাঁর।
এরপর বাবা আর বিয়ে করেন নি। বন্ধু বান্ধবরা অনেক বুঝাতেন।
বলতেন-এতোগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সামলানোর জন্যে ঘরে একটা বউ আনা দরকার।
বাবা বলতেন-
ঃ নিজের সন্তানদেন ফেলে রেখে চলে গেছে একজন। আর পরের সন্তানদের সামলাবার জন্যে আরেকজন আসবে কোন দায়ে ঠেকে? খুব শিক্ষা হয়েছে আমার।
শিক্ষা হয়ে গেছে কামরানেরও। কিন্তু সেটা আরো পরে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে একটা স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে যাবার চেষ্টায় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন কামরান।
এরই মধ্যে ওর জীবনে এলো নীলা। অল্প ক’দিনের মধ্যেই জয় করে নিল কামরানের মতো ছেলেকে। নতুন করে আশার আলো দেখলো কামরান।
রাতটুকুন ছাড়া সবসময় সবকাজের সঙ্গী এখন শুধু নীলা।
ভালোবাসার কাঙ্গাল কামরানও নিজেকে ধন্য মনে করলো নীলার মতো মেয়ের ভালোবাসা পেয়ে।
একদিন সুযোগ বুঝে নীলা বলেই বসলো যে-
কামরানকে ছেড়ে তার পক্ষে এখানে একা থাকা কোন রকমেই সম্ভব নয়।
কাজেই-
তারও যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কামরানও একেবারে মরিয়া হয়ে উঠলো নীলাকে সাথে নিয়ে আমেরিকা যাবার জন্যে।
বহু খাটা খাটনি আর আনুষ্ঠানিকতার পর দু’জনার যাওয়ার প্রস্তুতি পর্ব সারা হলো।
ছোট ভাই দুটি মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে।
বিয়ে হয়ে গেছে বোন দুটির। দু’টো বাড়ির একটি ভাড়া দিয়ে, অন্যটিতে সবাই থাকে।
কামরান এখন অনেকটা দায় মুক্ত। নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় এসেছে ওর।
বাবা সবই জানতেই।
ওদের যাবার আগে কলমা পড়িয়ে বিয়ে দিলেন ঘরোয়াভাবে।
ঘনিষ্ঠ দু’একজন ছাড়া বাইরের কেউ জানতো না।
নীলার কোন গার্জেন ছিল না। বাড়িতে সৎ মা।
বাবা কিছু কিছু হাত খরচ দেন বটে; কিন্তু তাতে কিছুই হয় না।
বিকেলের দিকে পারটাইম কিছু কাজ ও টিউশশনি করে চলতো ওর।
ঢাকায় হলে থাকতো। কাজেই ও নিজেই নিজেই গার্জেন ছিল।
কামরানের জীবনের যত গ্লানি, হতাশা আর দুঃখকে অল্প কদিনের মধ্যে ভুলিয়ে দিল নীলা, ভালোবাসার প্লাবনে।
এবং একদিন দু’জনেই চলে গেল আমেরিকা, প্রায় দুই বছরের জন্যে।
প্রায় বছর খানেক পরের কথা। একদিন কামরান বাইরে থেকে এসে দেখে-ব্যাগ গোছাচ্ছে নীলা।
জিজ্ঞেস করতেই বলল-
ঃ আমার এক বান্ধবীর সাথে দেখা হঠাৎ একটা স্টোরে, খুব ধরেছে- ওর বাড়িতে দু’দিন থাকতে। আমাদেরও তো দেশে ফেরার সময় হয়ে এলো। তাই ভাবছিলাম-
এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন কামরান।
বললেন-
ঃ বেশ তো থাকো। কিন্তু ডার্লিং দু’দিনের বেশী নয়। তোমাকে ছাড়া আমার অবস্থা-বুঝতেই পারছো-
ঃ অফ কোর্স-
হাসলো নীলা।
পরদিন সকালে বের হবার আগে কামরান বললেন-
ঃ চল তোমায় আগে তোমার বান্ধবী বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর একটু এ্যাম্বিসিতে যাব।
নীলা কামরানের গলা জড়িয়ে ধরলো আহলাদে।
বলল-
ঃ নো থ্যাঙ্কস। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না ডার্লিং। আমার বান্ধবী নিজে এসে নিয়ে যাবে আরো ঘন্টা খানেক পরে। ততক্ষণে আমি তোমার দু’দিনের রান্নাটা রেডি করে ফ্রীজে রাখি। বাকি কাজও গুছিয়ে রেখে যাচ্ছি সব। আমার এ্যাবসেন্সে যেন তোমার কোন কষ্ট না হয়।
নীলাকে কাছে টেনে আদর করলেন কামরান।
বললেন-
ঃ ‘ও’ কে’ । সত্যি নীলা তুমি আমার জীবনে আছো বলেই-
কামরানের মুখে হাত চাপা দিল নীলা।
বলল-
ঃ আর একটিও কথা নয়। তোমার কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। এসব আবেগের কতা বলার জন্যে সারাটা জীবন তো পড়েই রয়েছে।
হেসে বেরিয়ে গেলেন কামরান। নীলা ওকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল।
এরপর দুদিন অতিবাহিত হয়ে তৃতীয় দিন ভোরে টেলিফোন বেজে উঠলো।
কামরান ঘুম চোখেই রিসিভার তুলে নিল।
হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো নীলার কণ্ঠ।
ঃ গুডমর্নিং ডার্লিং। স্যরি এতো ভোরে তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম। কামরান বালিশটা টেনে নিল বুকের কাছে।
ঘুম জড়ানো চোখে বলল-
ঃ গুডমর্নিং নীলা- কই কখন আসছো তুমি ? ভীষণ মিস করছি তোমাকে।
ওদিক থেকে নীলার কণ্ঠ হেসে উঠলো জল তরঙ্গের মতো।
বলল-
ঃ স্যরি ডার্লিং। আমি আসছি না।
কামরান বললেন-
ঃ ইয়ার্কী রাখো। প্লীজ লক্ষ্মীটি- বড় তাড়াতাড়ি।
নীলা আবার হাসলো।
বলল-
ঃ বিশ্বাস হচ্ছে না? আলমারীটা খুলে দেখ। আমি আমার সব কিছু নিয়ে চলে এসেছি। আর কখনই আমি তোমার কাছে ফিরে যাব না। কোন বান্ধবী নয়- বন্ধু এখানে চমৎকার বয়ফ্রেন্ড পেয়েছি আমি জীবনকে উপভোগ করবার জন্যে। অনেক বড় চাকরি করে।
কামরান বলল-
ঃ নীলা তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? আমাদের ভালোবাসা, বিয়ে এতো দিনের দাম্পত্য জীবন-
নীলা বলল-
ঃ সব মিথ্যে। তুমি দেশে ফিরে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে নিও প্লীজ। বাই
ওপাশ থেকে রিসিভার রেখে দিল নীলা।
কামরান যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।
ও স্বপ্ন দেখছে নাতো?
হাতে মুখে বার কয়েক চিমটি কেটে দেখলেন-
না। জেগেই আছে সে।
কিন্তু এ কি করে সম্ভব?
নীলার মতো মেয়ে...?
উঠে আলমারীটা খুললেন কামরান। এবং স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভেতরটা একেবারে ফাঁকা। নীলার কোন চিহ্ন নেই কোথাও । সব শূন্য।
আবার বিছানায় এসে বসে পড়লেন কামরান। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। কামরান ভেবে পান না কেন নীলা এমন করলো।
কি দরকার ছিল এই প্রতারণার?
কিসের অভাব ছিল ওর?
প্রাচুর্যের?
এতোদিনের প্রেম, ভালোবাসা, দাম্পত্য জীবন-সব মিথ্যে হয়ে গেল
আরেকজনের অর্থের কাছে?
কি করে এই প্রলোভনে পড়ে গেল নীলা?
কি করে ছেড়ে যেতে পারালো সে কামরানকে।
একটু পরেই আবার ফোন বেজে উঠলো।
রিসিভার তুলেই নীলার কণ্ঠ শুনলেন কামরান।
ঃ এতোক্ষণে তোমার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হয়ে গেছে যে আমি সত্যি তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছি।
শোন, তোমার টাকা পয়সা আমি কিছুই আনিনি। কারণ ওটা আনলে তোমার দেশে ফিরে যেতে কষ্ট হবে।
তুমি এতো ভালো যে, তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাইনে। শোন, আমাকে ফিরে পাবার কোন রকম চেষ্টা চালাবে না। তাহলে বিপদে পড়বে। আমি চাই, তোমার কাজ শেষ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।
লাইনটা কেটে গেল ওপাশ থেকে। রিসিভার হাতে বসে রইলেন কামরান। একটি কথাও বলতে পারলেন না।
হঠাৎ করে ওর অসতী মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
নীলা আর মায়ের মুখটা যেন মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে।
মাথাটা আবার ঝিমঝিম করতে লাগলো।
মনে হলো চারদিকে কারা যেন অসংখ্য কাঁসর বাজাচ্ছে।
আর সেই অসহ্য ঝনঝনানি শুনতে শুনতে ক্রমশ কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছেন কামরান।
সে যেন হারিয়ে যাচ্ছে এতেদিনের পরিচিত লোকালয় থেকে।
তলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের অতল গভীরে...।
এই দুর্ঘটনার অল্প কিছুদিন পরেই দেশে ফিরে এলেন কামরান একেবারে অন্য মানুষ হয়ে । কথা বলেন কম।
লোকজনের সাথে মেলামশো করেন একেবারেই হিসেব করে।
কাজ ছাড়া যেন আর কোন কিছুরই প্রবেশ নিষেধ ওঁর জীবনে।
এতো বড় বাড়ির চিলে কোঠাটাই বেছে নিলেন নিজের জন্যে। সেখানে তৈরি করে নিলেন আপন ভুবন।
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর-
বাবা মারা গেছেন।
সব ভাইরা সংসারী হয়েছে। সবার শ্রদ্ধা ভালোবাসা আর নিজের কর্মব্যস্থতা নিয়ে কেটে যাচ্ছিল জীবন।
দেশের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট হিসেবে প্রচুর সুখ্যাতি সর্বত্র। এক নামে চেনে সবাই।
বুদ্ধিজীবী মহলে এমন শিক্ষিত, জ্ঞানী, মার্জিত, রুচিবান আর সুদর্শন ব্যক্তিত্ব খুব কমই চোখে পড়ে।
পরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরের কেউ জানো না তার জীবনের গভীর দুর্ঘটনার কথা। বেশীর ভাগ মানুষ জানে কনফার্ম ব্যাচেলার হিসেবে। জানে না তার অতীতের ইতিহাস।
দেশে আসার পর এতোটা বছর পথ চলতে বহু মেয়ের সাথেই পরিচয় হয়েছে কামরানের ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে কেউ কেউ। কিন্তু অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে কামরান।
বার বার মা আর নীলার মুখটা মেন পড়েছে শুধু। একেক সময় মনে হয়েছে সব মেয়েরাই বোধহয় কম বেশী একরকম হয়।
অসতী-দ্বি চারিনী-নষ্টা আর ছলনাময়ী।
কখনো কখনো সুখী দম্পতিকে দেখে কামরানের বুকটা খুশীতে ভরে যেতো প্রথমে এবং পরক্ষণেই আবার মনে হতো ভেঙে যাবে না তো ও ঘর?
বন্ধু-বান্ধব ও ভাইবোনের ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে এখন। কারো কারো বিয়েও হয়েছে। মাঝে মাঝে ওরাই পাকড়াও করে কামরানকে বিয়ের জন্যে। ওদের আবদারে হেসে জোড় হাত করেন কামরান।
বলেন-
ঃ আমার এতো ছেলে মেয়ে। ওদের দেখা শোনা করা এখন আমার সবচে বড় কাজ। বিয়ের ঝামেলায় আর যেতে চাই না।
সবাই বোঝে এ হচ্ছে কামরানের এড়িয়ে যাওয়ার কায়দা।
সেই কামরান হোসেন দেখতে দেখতে প্রায় পঞ্চাশের কোঠায় এসে পৌঁছেছেন ক’দিন আগে। পরিবারের ছেলে মেয়েরা খুব ধুমধামের সাথে ছাদে কামরানের জন্ম দিনও পালন করেছে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে।
ছেলেমেয়েদের এই নির্মল ভালোবাসার গভীরতায় আবেগে আপ্লুত হয়ে যান কামরান। আর তখনই ওঁর বুকের ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে এক অব্যক্ত ব্যথায়।
কি যেন একটা থাকার কথা ছিল...
কোথায় যেন একটা ক্ষত রয়ে গেল। কিছুতেই যেন আর হিসেবে মেলাতে পারেন না কামরান।
এরই মধ্যে এলো সেই হঠাৎ হাওয়ার ঝটকা-
হঠাৎ আলোর ঝলকানি।
এতোদিনের বন্ধ দুয়ারে আঘাত হানলো আবার।
অন্ধকার আকাশে আলো ফুটি ফুটি করছে একটু একটু করে। ভোরের ভেজা ঠান্ডা হাওয়ায় চোখের পাতা আর অবিন্যস্ত চুলগুলো কেমন ভেজা ভেজা।
অভিমানী।
কামরানের মনে হলো শেষ রাতের জোছনা চুইয়ে শিশির স্নাত হয়েছে হয়তো-বা কতোক্ষণ?
অনেকক্ষণ একাকী আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কোথাও কেউ নেই, চারদিকের মহাশূন্যতা ছাড়া।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।