Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠনের ইঙ্গিত বেসামরিক সরকারের

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

মিয়ানমারের বেসামরিক নেতা অং সান সু চি দেশের সামরিক বাহিনীর দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে বুঝিয়েছেন যে, বিগত তিন বছর ধরে রাখাইন রাজ্য থেকে যে মুসলিমরা দেশান্তরী হয়েছে, সে জন্য মূলত সামরিক বাহিনীই দায়ী।

হেগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে - যেখানে তিনি গণহত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে সরকারের আইনি টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন - সেখানে দেয়া বক্তব্যে সু চি পরিস্থিতির পুনর্গঠনের জন্য দরকারী পরিবর্তনের বিষয়গুলো এবং কোন পরিবর্তনগুলো সামনে আসছে সেগুলোর কথাও উল্লেখ করেন, যেগুলো না থাকার কারণে দেশের অস্থির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বেড়ে গেছে। কিন্তু স্টেট কাউন্সিলর তার শুরুর বক্তব্যে যে প্রধান পয়েন্টগুলো উল্লেখ করেন, সেগুলোকে পুরোপুরি মানুষ গ্রহণ করেনি - দেশের ভেতরে নয় এবং আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় তো নয়ই।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যগুলো নিঃসন্দেহে সশস্ত্র বাহিনী বা তাতমাদাওয়ের সিনিয়র সদস্যদেরকে হতাশ করেছে। রাখাইনে ‘শুদ্ধি অভিযানের’ সময় আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ চলে আসছে।

আইসিজেতে অং সান সু চির বক্তব্য নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক সরকারের মধ্যকার খারাপ সম্পর্ককে আরও খারাপের দিকে নেবে।

রাখাইনের মুসলিমরা - রোহিঙ্গা, যে নামে তারা নিজেদের উল্লেখ করে থাকে, তারা অভিযোগ করেছে যে, তারা বিগত তিন বছর ধরে তাতমাদাওয়ের হাতে হয়রানি, নির্যাতন, উচ্ছেদ, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে। বিগত তিন বছরে সহিংসতা থেকে বাঁচতে প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছে যে, সামরিক বাহিনী ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে’ জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকার এবং সামরিক বাহিনী সবসময় এই সব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। সরকার এবং সামরিক বাহিনী সবসময় বলে এসেছে যে, এইসব ‘শুদ্ধি অভিযান’ সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে তাদের নিয়মিত সামরিক পদক্ষেপের অংশ মাত্র।

২০১৬ সালের অক্টোবরে এবং আবার ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা আরাকান স্যালভেশান আর্মি (আরসা) ভোরের দিকে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা করে এবং নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশের অনেক সদস্য এতে নিহত হয়। তাতমাদাওয়ের মতে, সেনাবাহিনী এর পরিপ্রেক্ষিতে ষাঁড়াশি অভিযান চালায় এবং আরসাকে নির্ম‚লের চেষ্টা করে।

গত সপ্তাহে বিশ্বের নজর ছিল ক্ষুদ্রকায় অং সান সু চির উপর, যখন তিনি আইসিজেতে তার দেশের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের জন্য ১৫ জন বিচারপতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ৫৭ সদস্যের অর্গানাইজেশান অব ইসলামিক কোঅপারেশানের (ওআইসি) পক্ষে এই অভিযোগ উত্থাপন করে পশ্চিমা আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। আদালতে দায়ের করা আবেদনে তারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘হত্যা, মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন, শারীরিকভাবে ধ্বংস করার উপযোগী পরিস্থিতি আরোপ, জন্ম ঠেকাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, এবং জোরপূর্বক স্থানান্তরের অভিযোগ আনেন, যেগুলোর সাথে গণহত্যার উদ্দেশ্য জড়িয়ে আছে, কারণ রোহিঙ্গাদের আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্যই ওই অভিযান চালানো হয়েছিল’।

আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং বহু মানবাধিকার সংগঠন দ্রæততার সাথে সু চির নিন্দা করেন কারণ সামরিক অভিযানের সময় যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তার অংশ ছিলেন তিনি। কিন্তু আদালতে তিনি যে কথা বলেছেন, সেটা তার নিন্দুকদের মনোযোগে পড়েনি। তার বক্তব্য ছিল পরিস্কার, যদিও সংযতভাবে বলেছেন তিনি। বেশ কিছু মুহ‚র্তে তিনি অনুশোচনারও ইঙ্গিত দেখিয়েছেন।

বক্তব্যের একেবারে শুরুতেই তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, “কিন্তু একটা বিষয় আমাদের সবাইকেই সমানভাবে নাড়া দিয়েছে: বহু নিরপরাধ মানুষের দুর্ভোগ, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের সশস্ত্র সঙ্ঘাতের সময় যাদের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বিশেষ করে তারা যাদেরকে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে এবং এখন তারা কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করছে”।

অং সান সু চির পুরো বক্তৃতাতেই আসলে এক ধরনের অনুশোচনা ছিল। আসলে সেনাবাহিনী তাদের অভিযানের সময় যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, সেটাকে তিনি মোটেই খাটো করার চেষ্টা করেননি।

তিনি বলেছেন: “এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন করে অত্যধিক শক্তি প্রয়োগ করেছে, অথবা তারা আরসা যোদ্ধা বা বেসামরিক মানুষদের মধ্যে কোন পার্থক্য করেনি। সঙ্ঘাতের পর গ্রাম ছাড়ার পর বেসামরিক মানুষ কর্তৃক সম্পদ লুটপাট ও ধ্বংস করার হাত থেকে বাঁচাতেও তারা কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছে”।

অবশ্যই তিনি এটা অস্বীকার করে গেছেন যে এখানে গণহত্যা চালানো হয়েছে। আর সরকারের বহু সমালোচক এবং রোহিঙ্গারা নিজেও দাবি জানাচ্ছেন যাতে অং সান সু চি ক্ষমা চান - এবং সামরিক বাহিনীর অভিযানে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে, সেটি তিনি স্বীকার করেন।

এর পরও, অং সান সু চির বক্তব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাখাইন সঙ্কটে সেনাবাহিনীর ভ‚মিকাকে তুলে ধরা। রাখাইনে কি ঘটেছিলো সে ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের নতুন ভাষ্যের সাথে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাস্তব ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনার সময় কমান্ডার আর সেনারা ‘তাদের নিয়ম নীতি অনুসরণ করেননি।

যদি তাই হয়, তাহলে সরকার কেন এই দায়মুক্তির পরিবেশের ইতি টানার জন্য কিছু করেনি? যারা এই সব কাজের জন্য দায়ি, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল সরকারের। আসলে, অং সান সু চি বলেছেন যে, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

তিনি আদালতকে বলেন, “২০০৮ সালের সংবিধানের অধীনে, মিয়ানমারে একটা সামরিক বিচার ব্যবস্থা রয়েছে”। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “রাখাইনে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের দায়ি অভিযুক্ত সেনা বা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই তদন্ত করা হবে এবং এই সিস্টেমের অধীনে বিচার করা হবে”।

গত মাসে সরকার ঘোষণা দিয়েছিল যে, দুই বছর আগে আরসার সাথে এক যুদ্ধের পর গু দার পাইন গ্রামের কাছে গ্রামবাসীদের গণহারে হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার দায়ে সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যদের কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হয়। স্টেট কাউন্সিলরের মতে আরও কোর্ট মার্শাল করা হবে। স্বাধীন তদন্ত কমিশন যদি আরও তথ্য প্রমাণ নিয়ে আসে, তাহলে এটা করা হবে। সরকার নিজেই এই তদন্ত কমিশন গঠন করেছে, যেখানে দুজন আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি রয়েছেন - একজন হলো চার সদস্যের কমিটির প্রধান ফিলিপিনো ক‚টনীতিক এবং অন্যজন জাতিসংঘে কর্মরত জাপানের সাবেক কর্মকর্তা।

অং সান সু চি আদালতে বলেন, এই মামলাগুলো মিয়ানমারে চলমান অপরাধ বিচার প্রক্রিয়ার অংশ এবং ‘এগুলোকে অবশ্যই চলতে দিতে হবে’। কিন্তু এর সাথে যে বিপদ ও হতাশার দিকগুলো রয়েছে, সে ব্যাপারে তিনি সচেতন রয়েছেন। এইসব ব্যাপারে সামরিক বাহিনী খুবই রক্ষণশীল।

মিয়ানমারের সামরিক বিচার ব্যবস্থার যে সা¤প্রতিক ইতিহাস, সেটা দেখলে পরিবর্তনের ব্যাপারে কেউ খুব একটা আশাবাদী হবে না। মংডু টাউনশিপের ইন দিন গ্রামে ১০ জন রোহিঙ্গাকে নির্বিচারে হত্যার অভিযোগে ২০১৮ সালের মার্চে একটি সামরিক আদালত চারজন কর্মকর্তা ও তিন সেনাকে ১০ বছরের কারাদন্ডের সাজা দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনী প্রধান তাদের ক্ষমা ঘোষণা করলে নয় মাস পর তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়।

তিনি আদালতে জোরালোভাবে বলেন, ‘মিয়ানমারের অনেকেই এই ক্ষমার বিষয়টি নিয়ে অখুশি। কিন্তু মিয়ানমারের নেত্রী এটা জানেন যে এ ধরনের ঘটনা দেশের বিচার ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করবে, বিশেষ করে সামরকি বাহিনীর ব্যাপারে।

এখন যেটা প্রয়োজন সেটা হলো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ যে সরকার সামরিক বাহিনীর নীতি লঙ্ঘনকারীদেরকে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যাপারে সিরিয়াস। স্পষ্টতই সামরিক বাহিনীকে এই বার্তা দেয়া হয়েছে যে, পরিস্থিতি অবশ্যই বদলাতে হবে:

‘মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা সার্ভিসের সদস্যরা যদি যুদ্ধাপরাধ করে থাকে, তাদেরকে আমাদের সামরিক বিচার ব্যবস্থার অধীনে বিচার করা হবে, আর সেটা হবে মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী’।

তিনি বলেন, ‘এটা অপরাধ বিচার কর্তৃপক্ষের বিষয় যে তারা পর্যালোচনা করে দেখবে যে বেসামরিক মানুষ আর আরসা যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে কি না, অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে কি না, মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে কি না, সম্পদ বিনষ্টে ব্যর্থ হয়েছে কি না, বা বেসামরিক মানুষদের জোরপূর্বক ঘরবাড়িছাড়া করা হয়েছে কি না’।

অং সান সু চি কার্যকরভাবে তাতমাদাওয়ের প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, পরিবর্তন প্রয়োজন এবং অবশ্যম্ভাবী। যদিও তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, বেসামরিক সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে এটা করতে হবে।

যেটা উল্লেখযোগ্য, সেটা হলো তিনি আদালতকে বলেছেন যে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করতে দিতে হবে, যার অর্থ হলো ২০০৮ সালের সংবিধানের বর্তমান সামরিক-মুখী সনদকে পরিবর্তন করা।

তবে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতাদের ঘাড়ে যদিও আন্তর্জাতিক ফাঁস আরও শক্ত হচ্ছে, এরপরও এত সহজে তারা নিরস্ত হবে না। সূত্র : এসএএম।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ