শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
১৯০৫ সালে জন্ম নেয়া জ্যাঁ পল সাঁত্রে ‘অস্তিত্ববাদগ্ধ নামক দর্শনের একজন মুখ্য প্রচারক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এক বন্দীর পালিয়ে যাওয়া এবং জার্মানীর বিরুদ্ধে
প্রতিরোধ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের ঘটনাই এ গল্পে লেখক তুলে ধরেছেন।
তারা আমাদের বড় এক সাদা চুনকাম করা কক্ষে বেশ জোরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিলো আর উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাবার দশা। ধাতস্থ হবার পর খেয়াল করলাম একটা টেবিল আর তার পেছনে উর্দি ছাড়া চারজন মনোযোগ দিয়ে কাগজে কিছু একটা দেখছে। সেখানে তাদের পেছনে আরও কিছু বন্দী ছিল আর আমরা তাদের টেবিলটাকে পাশ কাটিয়ে বন্দীদের সারিতে দাঁড়ালাম। বন্দীদের মধ্যে কয়েকজনকে আমি চিনি আর অন্যরা খুব সম্ভব ভিনদেশী। আমার সামনে দুজন লালচুলো গোল মাথাওয়ালা লোক একই রকম দেখতে। তবে বেঁটেটা বেশ উদ্বিগ্নতার সাথে তার পাজামা
বারবার টেনে তুলছে।
এভাবে ৩ টি ঘণ্টা পেরুল। সব কিছু এত দ্র‘ত ঘটে গেল যে,আমার মাথা কাজ করছিল না। কক্ষটা বেশ আরামদায়ক আর খেয়াল করলাম ২৪ ঘণ্টা ঠান্ডায় ভোগার পর ভালো অনুভব হচ্ছে। প্রহরীরা একে একে টেবিলের কাছে বন্দীদের আনছিল। চারজনই শুধু বন্দীদের নাম আর পেশা ছাড়া তেমন একটা ঘাঁটাচ্ছিল না। তারা মনে হয় একটি বিষয় নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিল, বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে জড়িত হয়ে কোনো দেশ বিরোধী ধ্বংসাত্মক কাজ তোরা করেছিস কি না, অথবা বিদ্রোহের নবম দিন সকালে কোথায় ছিলি আর কি কি অপকর্ম করছিলি। তাদের কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে কোন কিছুই শুনছে না। কিছু সময় নীরবতা আর তারপরই কাগজে মুখ গুঁজে লিখে চলেছে।
টম তুই যে আন্তর্জাতিক চক্রের সাথে জড়িত, এটা কি সত্যি ? টম মুখ খুলল না কারণ ইতোমধ্যেই ওরা এ সংক্রান্ত একটা চিঠি ওর কোটের পকেটে পেয়েছে। প্রহরীরা হুয়ানের নাম জিজ্ঞেস ছাড়া আর কোন আগ্রহই দেখাল না এবং কাগজে আবারো দীর্ঘ সময় নিয়ে লিখল। হুয়ান হঠাত্ বলে উঠল, আমার ভাই হোসে আতংকবাদী। তোমরা জানো, সে এখানে নেই।
আমি কোন দলের সাথে নেই। আর এসবের মাধ্যমে আমি কোন ফায়দাও হাসিল করিনি।
কারোও মুখে কোন রা নেই। হুয়ান বলেই চলল,
আমি কিছুই করিনি এবং সে কারণে অন্যের জন্য চরম মূল্য দিতেও আমি রাজি নই।
তার ঠোঁট কাঁপছে। এক প্রহরী তাকে চুপ থাকতে বলল আর সেখান থেকে নিয়ে গেল।
এরপর এল আমার পালা।
তোমার নাম কি পাবলো ইবিয়েটা ?
হ্যাঁ।
লোকটা কাগজের দিকে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, রামন গ্রিজ কোথায় ?
আমি জানি না।
তোমরা ওকে বাড়ীতে ১৪ দিন ধরে লুকিয়ে রেখেছ।
না।
তারা অল্প সময় কিছু লিখল আর আমাকে বাইরে নিয়ে গেল। বারান্দায় টম আর হুয়ানকে নিয়ে দুই প্রহরী অপেক্ষা করছে। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। টম একজনকে জিজ্ঞেস করল, তাহলে?
তাহলে কি ? প্রহরী উত্তরে বলল।
সাক্ষ্য প্রমাণ না কি রায় ?
রায়, প্রহরী আবারও জবাব দিল।
তারা কি ঘটাতে যাচ্ছে আমাদের ভাগ্যে ?
এবার কর্কশ স্বরে উত্তর এল, রায় তোমাদের কক্ষে ঘোষণা করা হবে।
সত্যি কথা বলতে, ভালো কক্ষগুলোর মাঝে আমাদেরটি অন্যতম। সাক্ষ্য প্রমাণ আর দলিল দস্তাবেজের খসখসানিতে ভেতরের পরিবেশ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। আমরা সারা রাত ঠান্ডায় কাঁপছিলাম আর এটা দিনের চাইতেও ভয়াবহ ছিল।
আমি বিগত পাঁচ দিন বড় এক কক্ষে ছিলাম সে ঘরের দেয়ালে অনেক যুগ আগের বড় একটা ফাঁক আছে।
স্বল্প জায়গায় অনেক কয়েদী ছিল আর তারা শেকল পরিয়ে এখানে ওখানে ফেলে রাখত।
আমি আমার কক্ষকে মিস করি না কিন্তু ঠান্ডায় আমায় খুব কষ্ট পেতে হয়নি যদিও আমি ছিলাম একা যা অনেক দিন পরে সত্যিই বাজে অভিজ্ঞতা। কক্ষে আমি সঙ্গ পেয়েছিলাম।
অল্প বয়সী হুয়ান এত ভয় পেয়েছে যে,আর কথাই বলতে পারছে না। কিন্তু টম বেশ ভালো বক্তা আর স্প্যানিশও ভালো জানে।
কক্ষটিতে একটা বেন্চ ও চারটে ম্যাট ছিল। তারা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে বসাল আর আমরা চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলাম।
বেশ কিছু সময় পর টম বলল, আমরা ঘোরের মধ্যে আছি।
আমিও বলে উঠলাম, তাই তো মনে হচ্ছে, কিন্তু ওরা কিশোরদের কোন ক্ষতি করবে না।
টম বলেই চলেছে , সে বিদ্রোহীর ভাই এছাড়া ওর বিপক্ষে প্রমাণ করবার কিছুই নেই তাদের।
আমি হুয়ানের দিকে ফিরলাম। কোন কথা তার কানে যাচ্ছে বলে মনে হয় না।
তোমরা জানো তো জারাগোজায় তারা কি করেছে?
এক মরোক্কান পলাতক বলেছে, তারা মানুষদের রাস্তায় শুইয়ে দিত আর ওপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে যেত। এতে নাকি গোলাবারুদের অপচয় কম হয়।
টমের প্রতি বিরক্ত হয়ে বললাম বায়ুমণ্ডলকে তো আর এভাবে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু এসব কথা না তোলাই ভালো।
টমের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বলেই চলেছে, রাস্তায় সেনা কর্মকর্তাদের টহল। সাহেবী ভঙ্গিমায় তারা চলাফেরা করছে আর সিগারেটে ফুঁকছে। তোমরা কি মনে করেছ, ওরা তাদের সহজে মেরে ফেলবে ? হায় খোদা, তা নয়। তারা তাদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা খেলছে, বিদ্র‘প করছে। এ দৃশ্য দেখে ঘৃণায় মরোক্কানটা বমিও করেছে।
আমি বিশ্বাস করি না যে তারা এখানেও এই কাজ করবে যতক্ষণ না গোলাবারুদ শেষ হয়।
কক্ষের চারটে ঘুলঘুলি দিয়ে দিনের সকালের আলোয় দিন শুরু আর প্রহরীরা ছাদের বামে আরেকটি ঘুলঘুলি তৈরী করল । এদিক দিয়ে আকাশটাও দেখা যায়। ফাঁদ পাতা এ গর্ত দিয়ে তারা কক্ষটিতে কয়লা ফেলত। নিচেই ধুলো কয়লার স্তূপ। কয়লাগুলো হাসপাতালকে আরামদায়ক রাখত কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার পরেই রোগীদের হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নেয়া হয় আর অব্যবহৃতই থেকে গেল কয়লার স্তূপ।
ফাঁদের আবরণ দিতে ভুলে গেলে কয়লা ধুয়ে যায়।
টম ভয়ে কাঁপতে শুরু করল আর বলতে লাগল, হে যীশু, আবার শীতশীত করছে আমার।
টম উঠে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করতে শুরু করেছে আর তার শার্টের ফাঁঁক দিয়ে বুকের সাদা চুল দেখা যাচ্ছে। এবার চিত হয়ে তার পা সাইকেলের মতো ঘুরোচ্ছে।
তার নিতম্বকে অতিকায় দেখাচ্ছে। অবশ্য টমের বেশ শক্তপোক্ত শরীর হলেও যথেষ্ট মেদবহুল।
গতিময় বুলেট কিংবা বেয়নেটের ধারালো খোঁচা মাখনের দলার মতো মাংসল শরীরে অনায়াসেই ঢুকে যাবে। তার পাতলা গড়নের শরীর হলে কি হতো তা আমাকে ভাবাচ্ছে না।
যদিও আমার তেমন ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে না তবু আমি হাত আর কাঁধের অস্তিত্ব অনুভব করছি না।
মাঝে মাঝেই একটা অস্থির ভাব করে আমার হারিয়ে ফেলা কোট খোঁজার চেষ্টা করছি আর পরক্ষণেই মনে পড়ছে তারা তো আমায় কোট দেয়নি। সে কারণে খুব অস্বস্তি লাগছিল। ওরা শুধু শার্ট ও গ্রীষ্মের সময় রোগীদের দেয়া ফিনফিনে প্যান্ট ছাড়া বাকী সব কাপড় খুুলে নিয়ে সৈনিকদের দিল। কিছু সময় পর টম উঠে এসে আমার পাশে বসে ভারী নিঃশ্বাস ছাড়ল।
উষ্ণতা অনুভব করছ ?
ওহ যীশু, না, তবে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
আনুমানিক রাত ৮টার দিকে দুজন ষন্ডা মার্কা ফ্যালানজিস্টসকে নিয়ে এক মেজর এক টুকরো কাগজ হাতে এল। প্রহরীকে হুংকার দিল, তিনজনের কি নাম ?
স্টেইনবক, ইবিয়েটা আর মিরবল।
চশমা পড়ে তালিকাটার ওপরে আবার চোখ বুলোতে বুলোতে স্টেইনবকের নাম নিল। এইতো পেয়ে গেছি, স্টেইনবক তোমায় মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। কাল সকালে তোমায় গুলি করে মারা হবে। সে অন্য দুজনের দিকে তাকাতেই মিরবল বলে উঠল, এটা হতে পারে না, আমি নই।
অবাক হয়ে মেজর ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম কি ?
হুয়ান মিরবল।
বেশ, তোমার নামও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় আছে ।
আমি তো কিছু করি নি।
মেজর কাঁধ ঝাঁকিয়ে টম আর আমার দিকে ফিরল।
তো তুমিই হলে বাস্কের অধিবাসী।
কেউই বাস্কের অধিবাসী নয়।
সে বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল, আমাকে তিনজন বাস্কবাসীর কথা বলা হয়েছে। শুধু শুধু তাদের পিছু নিয়ে সময় নষ্ট করব না। তাহলে তোমাদের জন্য কোন যাজকের প্রয়োজন হবে না ।
আমাদের মুখে ভাষা নেই।
একজন বেলজিয়ান ডাক্তার এখুনি আসবে। তোমাদের সাথে সে আজ রাত কাটাবে। কথা শেষ করেই মেজর স্যালুট নিয়ে প্রস্থান করল। (অসমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।