শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
যেকোন যুদ্ধই ভয়ঙ্কর। যুদ্ধ সভ্যতা ধ্বংস করে। যুদ্ধ নারীদের অবমাননা করতে শেখায়। যুদ্ধ এক নিষ্ঠুর খেলা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুরুষরা যেমন অংশ গ্রহণ করেছিল, তেমনি নারীরাও অংশ গ্রহণ করেছিল। বহু নারী যুদ্ধে নির্যাতিত হয়েছে, নিগৃহিত হয়েছে। সব কিছু হারিয়ে তাদের চোখে মুখে শুধু প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করেছে। নারীরা স্বাভাবিকভাবে কোমল স্বভাবের। তবে পশুদের আক্রমণ তাদের রুক্ষ, হীংগ্র করে তুলেছিল। আসলে এটাই হওয়া উচিত। সম্মান হারিয়ে, নিগৃহিত হয়ে আত্মহত্যা নয়। একজন শত্রুকে বধ করতে পারলেও সেটা প্রচণ্ড সার্থকতা। বাঙালি নারীরা তাই করেছিল। তারা থেমে থাকেনি। তারা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল। তারা জয়ী হয়েছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধা, তারা বীরাঙ্গনা। তারা আমাদের অহংকার। ১৮ নভেম্বর ২০১২ জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী , ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ২০৩ জন নারী অংশ নিয়েছিলেন । পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ২১ জন নারী ছিলেন দিনাজপুরের । এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৫ , যশোর ও গোপালগঞ্জে ৯ , সুনামগঞ্জ ও পঞ্চগড়ে ৮ , সিলেট ও বরিশালে ৭ জন নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন । এদের মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা ৩ জন।
অমানবিকতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে নারীর অবদান কোনো অংশেই কম নয়। ১৯৭১ সালে বীথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণা পাকিস্তানি সৈন্যদের গানবোট গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিলেন ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থের লেখক চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে নারীরা ও ছাত্রীসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। ১৯৬৯-এর ১৯ জানুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রীদের ওপর লাঠিপেটা করে সামরিক জান্তার সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। সেই সময় ছাত্রীরা সব মিছিল-আন্দোলনে সোচ্চার থেকেছেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে নারীসমাজ রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলনে, গণ-আন্দোলনে, মিছিলে প্রতিদিনই যোগ দিয়েছে। ১৯৬৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এই মহীয়সীর নেতৃত্বে সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আড়াই হাজার নারী সমাবেশ করেন, মিছিল করে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত যান। ২৪ মার্চ ১৯৬৯-এ প্রকাশিত আজাদ-এর তথ্য অনুযায়ী, বোরকা পরা হাজার হাজার পর্দানশিন নারীও যোগ দেন সেই মিছিলে। একাত্তরের উত্তাল মার্চের ৭ তারিখে তৎকালীন রেসকোর্স, বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঘোষণা দিলেন, ‘...আর যদি একটি গুলি চলে... প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, সেই সময়েও ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা’র কাজে উদ্ধুদ্ধ হয়েছিলেন নারীরা। ফলে দেখা যাবে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, ঈশ্বরদী, পাবনা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ সব জেলায় নারীসমাজের প্রতিবাদী সভা ও মিছিল হয়েছে। এ সময় তারা জেলায়, শহরে-শহরে, এলাকায়-এলাকায় সংগঠিত হয়ে কুচকাওয়াজ ও অস্ত্র চালনার ট্রেনিংও শুরু করে। ৯ মার্চ বাড়িতে বাড়িতে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়। এই কাজে নারীসমাজ ও ছাত্রসমাজ প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বহুমাত্রিকভাবে নারীরা সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব ধর্মের নারীই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কেবল বাঙালি নয়, সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আদিবাসী নারীরাও। যুদ্ধের সময় যদিও বাংলাদেশ সরকারের নীতিতে নারীদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া, গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং প্রশাসনিক কাজের নেতৃত্বে নারী সাংসদদের দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তারপরও এ ক্ষেত্রে নারীরা ছিলেন অনড়। তাঁরা সম্মুখসমরে অংশ নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন। কলকাতায় রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রতিনিধি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় গোবরা ক্যাম্পের ৩০০ তরুণীকে গোবরা ও ‘বিএলএফ’ ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এঁদের মধ্যে গীতা মজুমদার, গীতা কর, শিরিন বানু মিতিল, ডা. লাইলী পারভীন অস্ত্রচালনা শেখার পরও তাঁদের সম্মুখসমরে যেতে দেওয়া হয়নি। তারপরও আলমতাজ বেগম ছবি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বরিশালের করুণা বেগম ছিলেন অকুতোভয় মুক্তিসেনা। পুরুষের পোশাকে এ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করেছিলেন শিরিন বানু মিতিল, আলেয়া বেগম। নারী মুক্তিযোদ্ধারা পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন, তাঁরা অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার শত্রুদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাঁদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করা—রক্ত ঝরা একাত্তরে নারীদের এই সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল তাঁদের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার ২৯ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যক্ষ অবদানের স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন নারীরা। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিনজন—১৯৭২ সালে ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম; এরপর তারামন বিবি ১৯৭৩ সালে ও ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন কাঁকন বিবি।
বাংলাদেশ গেজেট অনুযায়ী ২০৩ জন নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর রয়েছে, শ্রীমতি তিত্ত বালা, সতী সাবিত্রী চক্রবর্তী, নিছতারা বিবি, শুকুরন নেছা, হাফিজা বেওয়া, সমলা বেওয়া, ছাপাতন বেওয়া, রাশিদা বেগম, রোকেয়া বেগম, কানন গোমেজ, মিনারা বেগম, সন্ধ্যা ঘোষ, আফিয়া বেগম, শেফালি বেগম, বিমলা রানী সরকার, আমিচা বেগম, দোলজান নেছা, রেজিয়া বেগম কমলা, সীতা হেমরান, মনোয়ারা, সন্ধ্যা রানী দেব, সালেহা বেগম, মোমেনা বেগম, মজিরন, ফেরদৌসী বেগম প্রমুখ। পুরুষরা যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় লাভ অসম্ভব ছিল। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ কোনভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বরং তারা নিজের সম্ভ্রম দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে ও সম্মুখ সমরে লড়ে এদেশের স্বাধীনতাকে উজ্জ্বীবিত করে রেখেছেন। আমরা কৃতজ্ঞভরা চিত্তে তাদের অবদানকে স্মরণ করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।