Inqilab Logo

বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাশ্মীর : বন্দুকের নল ও আজাদির স্বপ্ন

দ্বিতীয় কিস্তি

জাকারিয়া পলাশ | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৩:০৫ পিএম | আপডেট : ৩:১০ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

এই চরমপন্থার রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াও ছিল বন্দুক। বন্দুকের বিরুদ্ধে বন্দুক। সহিংসতার বিরুদ্ধে সহিংসতা। মহারাজার ভারতে যোগদানের শর্তে প্রথম ভারতীয় সৈন্যবাহিনী শ্রীনগরে পৌঁছেছিল ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর। পরে ১৯৫০ সালে অভ্যন্তরীণ আইনÑশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় আধাসামরিক সিআরপিএফ ব্যাটালিয়ন কাশ্মীরে যায়। ১৯৮৯ সালে বিদ্রোহ বেড়ে উঠলে ব্যাটালিয়নের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৯২ সাল নাগাদ ১২৯টি কোম্পানি সেখানে নিযুক্ত হয়। সম্প্রতি সেখানে ৪৭টি ব্যাটালিয়ন অবস্থান করছিল। গত ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সময়ে চলমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আরও ১০২টি কোম্পানি পাঠানো হয়। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে ইন্টারন্যাশনাল পিপলস ট্রাইব্যুনাল কাশ্মীর (আইপিটিকে) এবং এসোসিয়েশন অব প্যারেন্টস অব ডিসএপিয়ারড পারসনস (এপিডিপি) যৌথ উদ্যোগে মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করে। সে অনুসারে, এখনও ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিএসএফ, ইন্দো-তিব্বটিয়ান বর্ডার ফোরস (আইটিবিএফ), সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ), এবং জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ ফোর্স মিলে মোট নিয়োজিত সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ৬ লাখ ৫৬ হাজার ৬৩৮ থেকে ৭ লাখ ৫০ হাজার ৯৮১ জনের মতো। সে হিসেবে পুরো রাজ্যে গড়ে প্রতি ১৬/১৭ জনে একজন করে নিরাপত্তারক্ষী নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু, তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। বন্দুকের ব্যবহার কমলেও চরমপন্থা বেড়েছে। একজন ভারতীয় সেনা কমকর্তা একবার বলেছিলেন, ‘সৈন্যরা চরমপন্থীকে হত্যা করতে পারে কিন্তু চরমপন্থা হত্যা করতে পারে না’।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সশস্ত্র পন্থায় গিয়ে কাশ্মীরিদের কেমন মূল্য দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। নিহতের পরিসংখ্যান এখানে লেখা জরুরি নয়। তাছাড়া, পরিসংখ্যান নিয়ে রাজনীতি হয় সবচেয়ে বেশি। সংখ্যার চেয়ে গভীরতা অনুভব করাই শ্রেয়। তেমনই কিছু তথ্য তুলে ধরা যাক এবার।
১৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে। বারামুলা জেলার সোপুর এলাকার ঘটনা। মাগরিবের নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বেরিয়েছেন বশির আহমেদ। তিনি ৯০ দশকের শুরুতে ছিলেন হিজবুল মুজাহিদীনের যোদ্ধা। গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছিলেন তিন বছর। তারপর, জঙ্গি রাস্তা ছেড়ে গৃহস্থালিতে মন দিয়েছেন দেড় দশক আগে। বিয়ে করেছেন। ছেলে বুরহান তিন বছর পেরিয়ে স্কুলে যায়। স্ত্রীর কোলে ১৫ মাসের মেয়ে ‘হুরাইন’। ছেলেকে কোলে নিয়ে বশির যাচ্ছিলেন দোকানে। গ্রামের মধ্যেই, সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে অজ্ঞাতপরিচয় মোটরসাইকেল আরোহী গুলি করল বশিরকে। স্পটডেড! কোলে থাকা শিশু বুরহান কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় গুলি। শিশুটির তলপেটে ফেটে গিয়েছে। হাসপাতালে নেয়া হলো। রাতভর অপারেশন হলো। ডাক্তার বললেন, স্যরি!
স্বাধীনতার এক অদ্ভুত চেতনায় অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন বশির আহমদ আড়াই দশক আগে। ফের জীবনের টানে অস্ত্র ফেলে স্বপ্ন দেখলেন তিনি। ছেলের বাবা হলেন। মাটিতে মিশে গেল সব আশা। বাবার দাফন হয়েছে শুক্রবার। পরের দিন সন্তানের জানাজা হলো। স্কুলের শিশুরা তাদের বন্ধুর জানাজায় এসে হাজির হয়েছে দলবেঁধে। বশিরের ভাই খবরের কাগজকে জানায়, এর আগে মেজো ভাইকে হারিয়েছে তারা। তার নাম ছিল ফেরদৌস। অনেক দিন ছিল নিখোঁজ। খবর পেয়েছিল, রাজৌরির এক ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়েছে। একই পরিবারের দু’ভাই আর ছোট্ট ছেলে বুরহান হারিয়ে গেছে বুলেটের ঘায়ে। বাকি দু’ভাই এখন কী করবে? মৃত্যুর প্রস্তুুতি নেবে? নাকি স্বপ্ন দেখবে বেঁচে থাকার? এই দ্বিধা কাটছে না। কাশ্মীরে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, এখানে কে কাকে হত্যা করে তা কেই জানে না। বিশ্লেষকরা বলেন, এহলো একটি সীমিতমাত্রার যুদ্ধক্ষেত্র (খড়ি রহঃবহংরঃু ধিৎ ুড়হব)। এখানে যুদ্ধ ও চলছে জীবনও চলছে। মানুষের মৃত্যু সেখানে রুটিনাইজড।
এই লেখক কাশ্মীর পৌঁছে ৬ জুন, ২০১৪ তারিখে। এর তিন দিন পরই কাশ্মীরে হিজবুল মুজাহিদীনের এক কমান্ডার ক্রসফায়ারে মারা যান। ওই কমান্ডার নিহত হওয়ার কয়েক মাস আগে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। এমএ প্রথম বর্ষ শেষ করে সে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। ২৫ শে ফেব্রæয়ারি, ২০১৫ নিহত হওয়া আরেক তরুণ সোপিয়ান জেলার আশিক হোসেন দার। তুর্কিওয়াঙ্গাম গ্রামের ওই যুবক সেদিন প্রত্যুষে নিহত হন হেফ গ্রামে সংঘটিত এক ক্রসফায়ারে। ২০১৪ সালের মে মাসে সে ভিলেজ লেভেল ওয়ার্কারের চাকরিতে যোগ দিয়েছিল। তিন মাস পরই সে যোগ দেয় হিজবুল মুজাহিদীনে। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ও বিএড পাস করা ওই যুবক শিক্ষা বিভাগ, রেভিনিউ, সিপিএডি ও হর্টিকালচার বিভাগে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে প্রত্যেকটিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু, এসবের চেয়ে সশস্ত্র পথ তার কাছে আকর্ষণীয় হলো। সেখানেই ক্ষয়ে গেল তার জীবন। এই ঘটনার দুদিন আগে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চশিক্ষিত তরুণদের জঙ্গি দলে যোগদানের প্রবণতা খুবই ভয়াবহ ও উদ্বেগের বিষয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাশ্মীর


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ