পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পেঁয়াজ নিয়ে যে নৈরাজ্য শুরু হয়েছে তা চলছেই। সরকার দেশে পেঁয়াজের দাম কমিয়ে আনতে বিদেশ থেকে কার্গো বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানি করছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘বিমানে পেঁয়াজ এসেছে চিন্তার কারণ নেই।’ উড়াল পেঁয়াজ দেশে এলেও ভোক্তাদের দুঃশ্চিন্তা রয়েই গেছে। পেঁয়াজের মূল্য কিছুটা কমে আবার চড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে পেঁয়াজের কেজি এখনও ২৫০ টাকা। পেঁয়াজ নৈরাজ্য চলছেই; চলবে হয়তো আরও কিছুটা সময়। এটা দেখার কেউ নেই। সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস বাড়িয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটছে। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন আর পেঁয়াজ খেতে পারছে না। প্রশ্ন হলো, পেঁয়াজ নিয়ে ব্যবসায়ীদের নৈরাজ্য আর কতদিন চলবে?
আসলে এই দেশে সবাই রাজা! কারোরই যেন অর্থকড়ির অভাব নেই! তাই ১ টাকার জিনিস ২ টাকায় কিনতেও কোনো সমস্যা নেই। ভাবখানাতো এমনই। বাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে অবিশ্বাস্য দরে। ২৫ টাকার পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ২৫০ টাকারও বেশি মূল্যে। এতো বেড়েছে পেঁয়াজের দাম তবু কেনা কমেনি। জনগণ বাড়তি দামে পণ্য কিনছে। পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের এতো দাম! তবুও দেশের কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই। আমজনতার মুখে কুলুপ আঁটা।
ভাবা কি যায়, পেঁয়াজ কিছুদিনের ব্যবধানে ২২৫ টাকা কেজিতে বেড়েছে। কোনো কোনো পণ্য ৩০/৪০ টাকা থেকে লাফিয়ে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কাঁচামরিচ, বেগুন ও অন্যান্য সবজি সবটার দামই বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ তিনগুণ হয়েছে। ৩০ টাকার শসা বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা। কাঁচামরিচ আগে ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও এখন ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রী হচ্ছে। আর মাছ-মাংসের দামতো আগে থেকেই বেড়ে আছে। ভরমৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া। কেজি প্রতি পাঙ্গাস ১৪০-১৬০, সিলভার কার্প ১৬০-২০০, শিংমাছ ৬০০-৮০০, তেলাপিয়া ১৮০-২২০, দেশি মাগুর ৬০০-৮০০, চায়না পুঁটি ১৫৫-১৯০। দেশি আলু (লাল) ৩০-৪০, করলা ৬০-৮০, পটোল ৬০, কাকরোল ৫৫-৬০, চিচিঙ্গা ৫০-৬০, মিষ্টি কুমড়া (কাটা পিস) ২৫-৪০, লাউ ৪০-৬০, কচুর লতি ৫০-৬০, গাঁজর ৫০-৮০ টাকা, পেঁপে ৩০-৩৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এটাই বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের হালচিত্র। শুধু তরিতরকারি নয় ছোলা, ডাল, মাছ-মাংস সব কিছুর দামই এখন চড়া।
এখন দেশে অতি খরা হয়নি, নেই হরতাল-অবরোধও। তাহলে কেন এভাবে বাড়ছে পণ্যমূল্য? চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও তার সুফল অনেক সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় পরিবহন চাঁদাবাজি ও মজুদদারির কারণে। আগে বাজার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন নেই। দ্রব্যমূল্য এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সরকার কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। সারাদেশে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভাগীয় এবং জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। তাতেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর জেলাপ্রশাসনের তাবৎ হুমকি ধমকিকে পাত্তা দিচ্ছে না ব্যবসায়ীরা।
বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ভারতের বাজার থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে পেঁয়াজের দামে সর্বকালের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। ২৫ জুলাই খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। এখন ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। সরবরাহ বাড়াতে বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা না গেলে সামনে দাম আরো বাড়তে পারে।
প্রশ্ন হলো, তবে কি দেশে পেঁয়াজ মজুত নেই? বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারা গেছে, দেশে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করেই ইচ্ছা অনুযায়ী পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা অতি মুনাফা ছাড়াও সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের ষড়যন্ত্রও হতে পারে। সরকারকে বিব্রত করা এবং বিপদে ফেলাই মূল উদ্দেশ্য হতে পারে। বিষয়টি সরকারকে ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। মানুষের পকেট মেরে রাতারাতি বাড়ি-গাড়ি আর ব্যাংক ব্যালেন্স করার জন্যই এসব করা হচ্ছে। পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। ফি বছরধরেই হয়। তবে সকালে ৬০ দুপুরে ৮০ আর রাতে ১০০ টাকা এভাবে কি পৃথিবীর আর কোনো দেশে দাম বাড়ে? এটা নতুন নয় যে কোনো অজুহাত মানেই পণ্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়া। ভারত থেকে পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ হয়েছে তো খবর পেয়ে পেঁয়াজের দাম ব্যবসায়ীরা এক লাফে উঠিয়েছে আকাশ সমান। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, ডিম, আলু, খেজুর, মাছ, মাংস, মসলা, কাঁচামরিচ, শাকসবজি, ফলমূলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় হেন পণ্য নেই যে, গায়ে মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ নেই। তফাৎটা শুধু ডিগ্রির, কোনোটার বেশি কোনোটার কম। এবার নতুন বাজেটের পরও পণ্যবাজারে তার বিরূপ প্রভাব পড়েনি। তাই সরকারি মহল সেসময় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো। কিন্তু দু’ মাস পার না হতেই কারণ ছাড়াই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ লাগে। ব্যবসায়ী-মজুদদাররা মুনাফায় পকেট ভারি করার মওকা ছাড়ে না। সুযোগমত দু’টো পয়সা কামিয়ে নিতে এরা কোমর বেঁধে প্রস্তুতি নেয়। মজুদ গড়ে তোলে, দফায় দফায় মূল্য বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ে। মুনাফাখোররা এদেশের অসহায় মানুষের কথা ভাবে না। এখন নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের চাপিয়ে দেওয়া দাম দিয়ে খাবার কিনতে পারছে না। তারা দু’ বেলা পেট পুরে খেতে পারছে না। আসলে মানুষকে জিম্মি করে অধিক মুনাফা লাভের ব্যবসায়ীদের এই খেলা কোনো সরকারই বন্ধ করতে পারে না, একথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই খেলা বন্ধ করা অবশ্যই সম্ভব, কিন্তু এর জন্য সরকারকে অবশ্যই হার্ড লাইনে চলতে হবে। প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে অসাধু ব্যবসায়ীদের, যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের সকল বিবেকহীন আয়োজন সম্পূর্ণ করেছে।
অর্থনীতিতে একটা কথা আছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন যতো কম হবে পণ্যের দাম বাজারে ততো বেশি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও চারদলীয় জোট সরকার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের সময় দেখেছি, যতবার পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ততবার বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা সরকারকে বারবার আশ্বাস দিয়েছে, পণ্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবে তা তামাশা মাত্র! তার কোনো প্রভাব কখনই বাজারে পড়েনি বা পড়ে না। দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য অসৎ ব্যবসায়ীর সব সময়ই বেপরোয়া। তারা মন্ত্রী, সচিব, ডিসি, এসপিদের ছোঁড়া হুংকারকে দিব্যি উপেক্ষা করে চলে। অসৎ বৃহৎ ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠি বরাবরই পণ্যমূল্য বাড়িয়ে তাদের পকেট স্ফিত করে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ সরকারকে যেকোনো মূল্যে নিতেই হবে। এজন্য বিরোধীদলগুলোকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে অহেতুক পণ্যমূল্য বাড়ার ঘটনা বোধ করি কোনো সভ্য সমাজে ঘটে না। অন্য কোনো দেশেও তার নজির নেই। এভাবে আর চলতে পারে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনই ওদের রুখতে হবে।
যেকোনো মূল্যে মধ্যস্থানীয় শ্রেণির কারসাজি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য সামঞ্জস্য আছে কিনা নিয়মিত তা তদারকি করতে হবে। দোকানদারদের কাছ থেকে চাঁদাবাজদের চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। বাজারে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি, তা বেশি করে যোগান দিতে হবে। পাইকারি বাজার থেকে মধ্যশ্রেণি যাতে স্বার্থ হাসিল না করতে পারে, সেজন্য পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সরকারি নিজস্ব পরিবহন ও জনবলের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। তাতে করে চাঁদাবাজিও বন্ধ হবে। বেশি করে পণ্য আমদানি করে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা। আরো বেশি করে সরকারি বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি ব্যবসায়ীদের শপথ নেয়া উচিত ‘আমরা পণ্যসামগ্রী মজুদের মাধ্যমে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়াবো না এবং পণ্যসামগ্রীতে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করবো না।’
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।