শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ কিংবদন্তী একজন কথাশিল্পীর নাম। বাংলা কথাসাহিত্য, সংগীত, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণসহ সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় নিজের সোনালী হাতের স্বার্থক ছোঁয়ায় আলোকিত করে বাংলার মানুষের পরম ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন জনপ্রিয় এই লেখক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শেষ্ঠ ও জনপ্রিয় লেখক হিসেবে গন্য করা হয় হুমায়ূন আহমেদকে।
নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে ¯œাতকোত্তর পাশ করার পর প্রথমে বাংলাদেশ কৃষি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে নিয়োজিত হয়। এছাড়াও পরবর্তীতে তিনি আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিমার সায়েন্সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্র ছাত্রীদের কাছে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি আধুনিক কথাসাহিত্যিক হিসেবেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সাহিত্য রচনা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে একসময় তিনি অধ্যাপনার পেশা ছেড়ে দেন।
১৯৯৭১ খ্রি. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাকে আটক করে নিয়ে গিয়েছিল, শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিও চালিয়েছিল হানাদার বাহিনী, কিন্তু সৌভাগ্যবশত তিনি বেঁচে যান।
১৯৭২ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের মধ্যদিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যজগতে উদিত হন, এর পর থেকেই পর্যায়ক্রমে ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘লীলাবতী’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, বাদশা নামদারসহ বহু কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেন। মৃত্যু অবধি তিনি প্রায় দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন। অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে আধুনিক সাহিত্যের অনন্য রূপকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এই নন্দিত
লেখক।
পাঠকনন্দিত কথাকার হুমায়ূন আহমেদ এক কথায় বাঙালিদের বইপড়া শিখিয়ে গেছেন। ইন্টারনেটের বিস্ফোরণে যখন মানুষ বই পড়ার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে ওঠে ঠিক এমনই সময় হুমায়ূন আহমেদ তার লেখনির জাদুমন্ত্রে বাংলার মানুষের হাতে বই তুলে দিতে সক্ষম হন। নব্বই এর পর থেকে তার মৃত্যু অবধি বইমেলায় সর্বাধিক বই বিক্রিত লেখকের তালিকায় হুমায়ূন আহমেদ প্রথম স্থান অধিকার করে রেখেছেন; বর্তমান সময়েও তার পাঠপ্রিয়তায় এতটুকুও হ্রাস পায়নি।
অতি সাধারণ ঘটনা ও কথাকে অসাধারণভাবে প্রকাশ ও চিত্রকল্প তৈরি করার অনন্য দক্ষতা তাকে নন্দিত করে তুলে। অতিবাস্তব ঘটনাকে বিশ্বাসী ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনের দক্ষতা তার রচনায় সুস্পষ্ট; যাকে জাদু বাস্তবতা বলা হয়ে থাকে।
হুমায়ূন আহমেদ গল্প ও উপন্যাসের প্রাণ ছিল পাত্র-পাত্রীর মিথস্ক্রিয়া; ছোটো ছোটো সংলাপ দিয়ে তিনি গল্প লিখতেন, যা সহজেই ঘটনা এবং বক্তব্যকে পাঠকের কাছে বোধগম্য করে তোলে।
বিশেষকরে চরিত্র সৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদ জাদুমন্ত্রের মতো ক্ষমতা অর্জন করেন। হিমু চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি যুবকদের সন্মোহিত করে তুলেন। হিমুর বাবাকে তিনি উপস্থাপন করেছেন একজন বিকারগ্রস্ত মানুষ হিসেবে; যার বিশ্বাস ছিল যে, যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করা যায় প্রশিক্ষণের মধ্যামে তবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মহাপুরুষও তৈরি করা সম্ভব। তিনি মহাপুরুষ তৈরি করার জন্য একটি বিদ্যাপীঠ তৈরি করেন, যার একমাত্র ছাত্র ছিল তার নিজেরই সন্তান হিমু।
হিমুর আচার-আচরণও বিভ্রান্তিকর। সে বৈরাগ্যময় পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে উদ্দেশ্যহীনভাবে খালিপায়ে ঘুরে বেড়ায় শহরের পথে...। যদিও হিমু তার নিজের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কথা অস্বীকার করে, তবুও উপন্যাসে প্রায়ই হিমুর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। জাগতিক প্রেম, মায়া, ভালোবাসা ত্যাগ করে সে ধার্মিক মহাপুরুষ হিসেবে নিজেকে ভাবতে থাকে। মায়া কিংবা প্রেম ভালোবাসায় জড়িয়ে গেলেই সে অদৃশ্য হয়ে যায়। একমাত্র হিমুর ভক্তরাই তাকে মহাপুরুষ হিসেবে জ্ঞান করে থাকে।
বর্তমানে অনেক যুবকই নিজেকে হিমু হিমু কল্পনা করে হলুদ পাঞ্জাবি পরে
খালিপায়ে ভবঘুরের মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়ে বেশ আনন্দ উপভোগ করে থাকে।
এছাড়াও রহস্যময় আরেক চরিত্র মিসির আলী চরিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিসির আলী। চল্লিশোর্ধ বয়সের মিসির আলীর লম্বাটে মুখ, এলোমেলো কাঁচা-পাকা চুল; যাকে দেখলেই আত্মভোলা ও ভবঘুরে বলে মনে হয়। তবে তিনি মানুষের মন, স্বপ্ন ও রহস্যময়তা নিয়ে বেশ আগ্রহী। মিসির আলী ছিলেন মুলত একজন নাস্তিক, যদিও বিভিন্ন উপন্যাসে তার ঈশ্বরভক্তির প্রকাশ পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী ছিলেন না মিসির আলী।
এছাড়াও রূপার মতো ময়াবতী মনোহরী চরিত্র, শুভ্রর মতো পবিত্র চরিত্রগুলো সৃষ্টিতে অনন্য পারদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদ নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছে, বই পড়া, শিখিয়ে গেছেন আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জীবন বোধের মন্ত্রবাণী।
আশির দশকে তার প্রথম টিভি কাহিনীচিত্র ‘প্রথম প্রহর’ বিটিভিতে প্রচার শুরু হলেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাস্তবতানির্ভর নাটক রচনায়ও হুমায়ূন আহমেদ স্বার্থক।
চিত্রনাট্য ও পরিচালকের ক্ষেত্রেও হুমায়ূন আহমেদের অবস্থান তুঙ্গে। তার পরিচালনায় সিনেমাগুলো মধ্যে ‘আগুনের পরশমনী’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ প্রভৃতি দর্শক ও সমালোচকদের মন জয় করতে সক্ষম হয়।
সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কীর্তিমান এই কথাকার। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে জীবনাবসান ঘটে এই জনপ্রিয় কথাশিল্পীর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।